নবনীতা দেবসেন। ছবি: আনন্দবাজার পত্রিকার আর্কাইভ থেকে
বিদ্রোহের সরবতাই বিপ্লবের আগমনী বার্তা বয়ে আনে। অথচ সেই সরবতা উচ্চকিত না হয়েও যে বৈপ্লবিক চেতনার বিস্তার করা যায়, তা সদ্য প্রয়াত লেখিকা নবনীতা দেবসেন দেখিয়ে দিয়েছেন। নারীবাদী লেখিকা হিসাবে কখনই তিনি সরব হয়ে ওঠেননি। অথচ, তার অবকাশ ছিল। তাঁর পরিবারের মধ্যেই সে রসদ মজুত ছিল। সে কথাই আলোচনা করছি।
নবনীতার মা রাধারানি দেবী (১৯০৩-১৯৮৯) ছিলেন রক্ষণশীল পুরুষশাসিত সমাজের প্রগতিশীল নারীকণ্ঠের উজ্জ্বল প্রতিভূ। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশনে আয়োজিত বিতর্কসভায় ‘ডিভোর্স উচিত কিনা’ বিষয়ে অনুরূপা দেবীর বিপক্ষ বক্তব্যকে খণ্ডন করে তাঁর সপক্ষে জোরাল বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন তেরো বছর বয়সে বাল্যবিধবা হওয়া রাধারানি দেবী। রাধারানি নিয়মিত সাহিত্যচর্চা করতেন। শরৎচন্দ্রদের আপত্তিকে অতিক্রম করে নারী হিসাবে ‘রবিবাসর’-এর সাহিত্যের আড্ডায় তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, নারীকণ্ঠেও তাঁর আত্মমর্যাদাবোধকে দিয়েছেন বনেদি আভিজাত্য।
রাধারানি দেবী ‘অপরাজিতা’ ছদ্মনামে কাব্যচর্চা করে সাড়া জাগিয়েছিলেন। ‘অপরাজিতা’র আড়ালে কে রয়েছেন, অনেকদিন তা জানা যায়নি। অন্য দিকে, তাঁর কাব্যচর্চার উৎকর্ষ ছিল ক্রমশ শ্রীবৃদ্ধিমান। ‘পুরবাসিনী’ (১৯৩৫) কাব্যে তা আরও তীব্র কৌতূহলের বিষয় হয়ে ওঠে। কাব্যটি কোনও পুরুষ কবির লেখা সম্ভব নয় বলে প্রমথ চোধুরীই জানিয়ে দেন। কাব্যটি আবার রাধারানি দেবী ও নরেন্দ্রনাথ দেবকে উৎসর্গিত। শেষে অপরাজিতা রাধারানি দেবীর সাক্ষাৎ মেলে।
অন্য দিকে, সাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ দেবের ‘কাব্য-দিপালী’ পত্রিকাটি সম্পাদনায় সাহায্য করতে গিয়ে তাঁদের মধ্যে হার্দিক সম্পর্ক বিবাহে গড়িয়ে যায়। দু’জনের বয়সে পনেরো বছরের ব্যবধান। তার উপর পারস্পরিক প্রতিকূল আবহ। সে-সব শুধু উপেক্ষিতই হল না, কন্যাসম্প্রদানেও নজির তৈরি করল। নিজেই নিজেকে সম্প্রদান করলেন রাধারানি দেবী। ১৯৩১-এ ৩১মে সেই বিয়ের পরের দিন সংবাদপত্রে লেখা হয় ‘রাধারানি-নরেন্দ্র দেব বিবাহ: কন্যার আত্মসম্প্রদান’। সেই রাধারানির প্রথম সন্তানের অকালপ্রয়াণ হওয়ায় নরেন্দ্র দেব কলকাতার হিন্দুস্থান পার্কে স্বাস্থ্যকর খোলামেলা আবহাওয়ায় ‘ভালো-বাসা’ নামে নতুন আবাস তোলেন।
সেই ‘ভালো-বাসা’র মুক্ত ও প্রশস্ত পরিসরেই তাঁদের ‘খুকু’ তথা শরৎচন্দ্রের ‘অনুরাধা’ শেষে রবীন্দ্রনাথের ‘নবনীতা’র বেড়ে ওঠা। তিনি যে তাঁর মায়েরই মেয়ে, সে কথার স্পষ্টবাক্মূর্তি তাঁর কথাতেই শুধু প্রতিমায়িত হয়নি, সুযোগ্যা উত্তরসূরি হিসাবেও সমীহ আদায় করে নিয়েছে। অথচ তাঁর নারীবাদী চেতনা কখনও উগ্র প্রকাশ পায়নি।
লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় (পিএইচডি) থেকে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নবনীতার প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষা ও গবেষণার ব্যাপ্তিই শুধু নয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সুদীর্ঘকাল (১৯৭৫-২০০২) অধ্যাপনার পাশাপাশি আমেরিকার কলোরাডো কলেজে মেটাগ প্রফেসর থেকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রাধাকৃষ্ণণ স্মারক লেকচারার সর্বত্র বিদ্যাচর্চায় স্বমহিমার বিস্তারিত হয়েছেন। শুধু তাই নয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েই আত্মতৃপ্ত হননি, স্বভাবসুলভ ভাবেই নিজেকে উচ্চশিক্ষার সোপানে শামিল করেছিলেন। হিন্দি, ওড়িয়া, অসমীয়া, সংস্কৃত, জার্মান, হিব্রু এবং ইংরেজি প্রভৃতি ভাষায় তাঁর বিদুষী প্রকৃতির অনন্যতা আপনাতেই সবুজ সজীবতা লাভ করে।
ব্যক্তিত্বের বহুমুখী বিস্তারে নবনীতা রাধারানিকেও ছাপিয়ে যান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অবিসংবাদিত নারীব্যক্তিত্বের উৎকর্ষমুখর প্রকৃতি পুরস্কার-সম্মাননায় (‘পদ্মশ্রী’, ‘সাহিত্য অকাদেমি, বিদ্যসাগর পুরস্কার, দেশিকোত্তম প্রভৃতি) স্বীকৃতি লাভ করে।
তাঁর মধ্যে পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের বৈষম্যপীড়িত জীবনবোধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদী চেতনায় নারীবাদের পরিচয় নানা ভাবেই প্রকাশমুখর। ছোটবেলায় ছোট ভাই দিদিকে মারলেও দিদি মারতে পারবে না, দিদিকে তা সহ্য করার চেতাবনির মধ্যে তাঁর মেয়েদের অন্যচোখে দেখার চেতনা জেগে উঠেছিল। সমাজে পুরুষের আধিপত্যে নারীদের আনুগত্যবোধের মধ্যে তাঁর প্রতিবাদী চেতনাই তাঁর বৈদগ্ধপূর্ণ বনেদি অবস্থানে আত্মপরিচয়ের সোপান হয়ে উঠতে পারত। সেখানে তাঁর আমৃত্যু ডাকাবুকো চরিত্রপ্রকৃতিই তাঁর সঙ্গতের পক্ষে যথেষ্ট সরব ছিল। বাংলার রক্ষণশীল সমাজে নবনীতা আজীবন ডানপিটে পরিচয়ে সমুজ্জ্বল ছিলেন।
হাসতে হাসতে এক কাপড়ে ট্রাকে চড়ে অরুণাচল সীমান্তে ভারত-চিনের ম্যাকমোহন লাইন ছুঁয়ে এসেছিলেন। তাঁর ভ্রমণকাহিনি ‘ট্রাকবাহনে ম্যাকমোহনে’। আবার হায়দরাবাদে সেমিনারে গিয়ে কুম্ভমেলায় গিয়েছেন একাকী। তাঁর লেখনীর পরশে তাই ‘করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে’ ভ্রমণসাহিত্যে প্রতিমায়িত হয়েছে। এ ভাবে দুরারোগ্য ব্যধিকে উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়েছেন পৃথিবীর দুর্গম পথে, বাংলা সাহিত্যে তার বিচিত্র অভিজ্ঞতায় অসংখ্য ফসল ফলিয়েছেন অবলীলায়।
স্বাধীনতাপ্রিয় নবনীতার আপসহীন যাপনে অবশ্য স্বেচ্ছাচারের বিকার ছিল না। আত্মসংযমী প্রকৃতির উদাতায় তাঁর নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অনন্যতা লক্ষণীয়। সে শিক্ষাও তাঁর মায়ের কাছেই পেয়েছিলেন। রাধারানি দেবী মেয়েকে আঁচলে করে মানুষ না করলেও প্রেমে স্বাধীনতা দিয়েও তার যাপনের সীমারেখা টেনে দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময় অমর্ত্য সেনের সঙ্গে নবনীতার প্রেম নিবিড় হয়ে ওঠে সেখানে মেয়ের প্রতি মায়ের নির্দেশ ছিল: ‘তিনটি জায়গায় যাওয়া যাবে না। পর্দা টাঙানো কেবিনওয়ালা রেস্তরাঁয়, সন্ধ্যার পরে লেকের ধারে আর সিনেমায়।’
সেই প্রেম বিবাহে গড়ায় ১৯৫৯-এ এবং সতেরো বছরে ১৯৭৬-এ বিবাহবিচ্ছেদও ঘটে। অথচ সেই আঘাত নবনীতাকে নারীবাদী বিদ্রোহে সক্রিয় করেনি। বরং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ অটুট ছিল আজীবন। ১৯৯৮-এ অমর্ত্য সেনের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তিতে নবনীতার আনন্দোচ্ছ্বাসে অভাব ছিল না। অমর্ত্য সেনকে নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। আবার সে-সময়ের প্রেক্ষিতে একটি স্মরণীয় ছোটগল্পও লেখেন ‘জরা হটকে, জরা বাঁচকে, ইয়ে হ্যায় নোবেল মেরি জান’। অন্য দিকে, সেই সময়ে তাঁর সমসাময়িক বলিষ্ঠ নারীকণ্ঠ কবিতা সিংহের মৃত্যুতেও শোকপ্রকাশে এগিয়ে গিয়েছেন। সর্বত্র তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ, স্বাধীনচেতা মনের প্রকাশ, বিদ্রোহহীন বিপ্লবের প্রয়াস আজীবন সচল ছিল।
লেখক শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়, পুরুলিয়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy