সত্য, বাহিরের চাপ প্রবল না হইয়া উঠিলে তিন তালাকের প্রথাটি বিলোপ করিবার তাগিদও হয়তো মুসলমান সমাজের ভিতরে অনুভূত হইত না। অন্তত এখনই নহে। কিন্তু, মৌলানা কাবলে সাদিকের আকস্মিক বিবৃতিতে বিজেপি-র যে নেতারা আত্মপ্রসাদ অনুভব করিতেছেন, তাঁহাদের দুইটি কথা স্মরণ করাইয়া দেওয়া যাউক। প্রথমত, অ্যাডাম স্মিথ তাঁহার ‘থিয়োরি অব মরাল সেন্টিমেন্টস’-এ যে নিষ্পক্ষ দর্শকের ধারণাটি আনিয়াছিলেন— এমন এক অস্তিত্ব, কোনও পক্ষের প্রতি যাঁহার পক্ষপাত থাকিবার কোনও কারণ নাই— তিন তালাকের প্রসঙ্গে বিজেপি সেই ধারণাটি হইতে সহস্র আলোকবর্ষ দূরে। তাহারা যখন তিন তালাক প্রথাটির বিরোধিতা করে, তখন যে তাহা মুসলমান সমাজের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের পরার্থপর তাগিদে করে না, নিজেদের রাজনৈতিক ঘুঁটি চালিতেই করে, এই কথাটি ভুলিয়া যাওয়া অসম্ভব। দ্বিতীয়ত, কোনও প্রকৃত নিষ্পক্ষ দর্শক যখন বিজেপি-র সমালোচনা করিবে, তখন হরেক জিগির তুলিয়া তাহাকে এড়াইয়া যাওয়ার নৈতিক অধিকার দলটির আর থাকিল না। হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারীরা মুসলমান সমাজের অভ্যন্তরীণ প্রশ্নে যেমন মতামত দিতে পারেন, চাপ তৈরি করিতে পারেন, তেমনই কোনও বিদেশি পর্যবেক্ষক ভারতে গোরক্ষার অলীক কুনাট্যকে প্রশ্ন করিলে সেই সমালোচনাকে অনধিকারচর্চা বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া চলিবে না। মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডের কর্তার মুখে তিন তালাক প্রথা বিলোপের প্রতিশ্রুতি শুনিবার পর নিশ্চয়ই বাহিরের চাপের কার্যকারিতা সম্বন্ধে তাঁহাদের আর সংশয় নাই। সেই চাপটি তাঁহাদের জন্যও সমান উপকারী হইবে।
মুসলমান সমাজের রক্ষণশীল অংশের প্রতিক্রিয়া বলিতেছে, কাবলে সাদিকের বিবৃতিই শেষ কথা নহে। নাগপুরের চাপে তিন তালাক বিলোপ করিবার সিদ্ধান্ত লইলে তাহা পরাজয় স্বীকার করিয়া লওয়া হইবে, এই ভীতিই বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়াকে শক্তিশালী করিতেছে। তাঁহারা স্মরণে রাখুন, এক্ষণে বিজেপি-র প্রসঙ্গটি গৌণ। আধুনিকতাকে স্বীকার করিতে হইলে কোনও একটি মুহূর্তে তিন তালাক প্রথাকে বর্জন করিতেই হইত। যাহা চলিতেছে, তাহাকে চলিতে দেওয়ার জাড্য প্রতিটি সমাজের ধর্ম। তাহাকে ভাঙিতে হইলে ধাক্কা প্রয়োজন হয়। কখনও সেই ধাক্কা সমাজের ভিতর হইতেই আসে। বহু ক্ষেত্রে বাহিরের ধাক্কার অপেক্ষায় থাকিতে হয়। ঘটনাক্রমে, মুসলমান সমাজও তেমনই একটি ধাক্কা খাইয়াছে। এবং, তিন তালাক বর্জনের দাবি যে শুধু বাহিরের, তাহা নহে— মুসলমান সমাজেরই বিভিন্ন অংশ হইতে দাবিটি উঠিয়া আসিতেছে। মুহূর্তটি ঐতিহাসিক। ক্ষুদ্র স্বার্থের হিসাব মিলাইতে তাহাতে বহিয়া যাইতে দেওয়া মারাত্মক ভুল হইবে।
ভারতীয় রাজনীতি অবশ্য একটি বৃহত্তর প্রশ্নের উত্তর খুঁজিবে। মুসলমান সমাজকে বাহির হইতে ধাক্কা দিতে হইলে সেই কাজটি কেন বিজেপি ভিন্ন অন্য কেহ করিতে পারে না? কংগ্রেস বা কমিউনিস্ট পার্টির ন্যায় যে দলগুলি মুসলমান সমাজের নিকট সঙ্গত কারণেই অধিকতর গ্রহণযোগ্য, তাহারা কেন এই প্রশ্ন তুলিতে পারে না? নাগরিক সমাজের প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ অংশটি কেন চুপ করিয়া থাকে? তাহাদের নীরবতার ফাঁক গলিয়াই যে বিজেপি তাহাদের প্রকট সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকেও প্রায় ‘বৈধ’ করিয়া তুলিবার অবকাশ পাইয়া যায়, সে পাপের দায় কি এই দলগুলি, এই নাগরিক সমাজ অস্বীকার করিতে পারে? ইহা প্রগতিশীল রাজনীতির মস্ত ব্যর্থতা। দুর্ভাগ্য, ভারতের তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক দলগুলির পক্ষেও মুসলমান সমাজের প্রেক্ষিতে অ্যাডাম স্মিথ-বর্ণিত নিষ্পক্ষ দর্শক হইয়া উঠা সম্ভব হয় নাই। যেখানে তাহাদের চোখে ভোটের স্বার্থই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে কি নিষ্পক্ষ হওয়া যায়?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy