—প্রতীকী ছবি।
তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে বড় লগ্নি আসিতেছে, জানাইয়াছেন মুখ্যমন্ত্রী। সংবাদটিকে স্বাগত, এবং মুখ্যমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাইবার পর প্রশ্ন করা প্রয়োজন, এত দিন সময় লাগিল কেন? কার্যত এক দশক সময় তিনি পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ পদে আসীন। এবং, বিস্মৃত হইবার অবকাশ নাই যে, তিনি সেই মহাসিংহাসনে বসিয়াছিলেন শিল্পমেধ যজ্ঞের পর। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে বহু দিন সেই যজ্ঞের ক্ষত বহন করিয়াছিল, তাহার পর মাটিচাপা পড়িয়াছে রাজ্যের শিল্পসম্ভাবনার বিনষ্ট ভ্রূণটি। সেই ক্ষতি, সেই ক্ষত পূরণ করিতে মুখ্যমন্ত্রী সচেষ্ট হইবেন, রাজ্যবাসী এক দশক ধরিয়া এই প্রত্যাশা লালন করিয়াছে, এবং হতাশ হইয়াছে। তবে, সেই অতীত মুছিবার সুযোগ মুখ্যমন্ত্রী গড়িয়া লইয়াছেন। পশ্চিমবঙ্গে সিলিকন ভ্যালি গড়িবার উদ্যোগটি বহু অর্থে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, এই শিল্পে জমির প্রয়োজন তুলনায় অনেক কম। ফলে, তাহার রাজনীতির করালগ্রাসে পড়িবার আশঙ্কাও কম। দ্বিতীয়ত, দেশের যে প্রান্তেই তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের কেন্দ্র গড়িয়া উঠিয়াছে, মেধার একটি বড় অংশের জোগান দিয়াছে বাংলা। ফলে, এই রাজ্যে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের স্বাভাবিক সম্ভাবনা আছে। দেশের মহানগরগুলির মধ্যে কলিকাতার বাসযোগ্যতাও অগ্রগণ্য। এই শহরের রাস্তা তুলনায় গতিশীল, বাজার তুলনায় কম ব্যয়বহুল। ফলে, কলিকাতা ও সামগ্রিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গ লগ্নিকারীদের নিকট আকর্ষক বিকল্প।
কথাগুলি আজ যেমন সত্য, অতীতেও তেমনই সত্য ছিল। তবু এত দিন এই রাজ্যে বৃহৎ পুঁজি আসে নাই, তাহার প্রধান কারণ— ব্যবসা করিতে হইলে যে প্রশাসনিক সহযোগিতা ও সক্রিয়তা প্রয়োজন হয়, পশ্চিমবঙ্গে তাহা মিলিবে কি না, সে বিষয়ে লগ্নিকারীদের সংশয় ছিল। মুখ্যমন্ত্রী যে ভঙ্গিতে সিলিকন ভ্যালি গড়িবার প্রয়াস করিতেছেন, তাহা লগ্নিকারীদের আশ্বস্ত করিবে। সরকারের নিকট তাঁহাদের মূল প্রত্যাশা, সরকার শিল্পের প্রয়োজনগুলি বুঝিবে। লাল ফিতার ফাঁস এড়াইবে, পরিকাঠামোর ব্যবস্থা করিবে। সর্বোপরি, কোনও রাজনৈতিক কারণে যাহাতে বিনিয়োগ বাধাপ্রাপ্ত না হয়, তাহা নিশ্চিত করিবে। সিলিকন ভ্যালি বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত তৎপরতা আশ্বাসজনক। কোভিড-পরবর্তী সময়কে বলা হইতেছে ‘দ্য নেক্সট নর্মাল’— পরবর্তী পর্যায়ের স্বাভাবিকতা। রাজ্যবাসী আশা করিতে পারে, এই সক্রিয়তা ও সদিচ্ছাই পশ্চিমবঙ্গের পরবর্তী পর্যায়ের স্বাভাবিকতা হইবে। এই রাজ্যে লগ্নি করিবার পূর্বে বিনিয়োগকারীদের ভাবিতে হইবে না— তাঁহারা জানিবেন, যে কোনও প্রয়োজনে রাজ্য সরকার ও প্রশাসনকে পাওয়া যাইবে।
এই অবস্থাটি এখনও শুধু প্রত্যাশার স্তরেই আছে। কিন্তু, পরবর্তী স্বাভাবিকতার আর একটি চেহারা এখন প্রায় নিশ্চিত। তাহা হইল, গোটা দুনিয়া আরও অনেক বেশি করিয়া তথ্যপ্রযুক্তি-নির্ভর হইবে। অফিসের কাজ হইতে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা হইতে স্বাস্থ্য, সবই আরও বেশি তথ্যপ্রযুক্তি-চালিত হইবে। অর্থাৎ, এই ক্ষেত্রটি ভবিষ্যতে আরও অনেক বেশি বিস্তৃত ও গভীর হইবে। এই অবস্থায় যদি পশ্চিমবঙ্গ তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হইয়া উঠিতে পারে, তবে তাহার সুফল সুদূরপ্রসারী। বিপুল কর্মসংস্থান ও বিপুলতর আনুষঙ্গিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিসর হইয়া উঠিতে পারে পশ্চিমবঙ্গ। এখনই যে লগ্নির কথা শোনা যাইতেছে, তাহাতে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা প্রভূত। কিন্তু, শিল্পের উপযোগী পরিবেশ গড়িয়া তুলিতে পারিলে, আন্তর্জাতিক ‘হাব’ হইয়া উঠিতে পারিলে রাজ্যের যে ভবিষ্যৎ রচনা করা সম্ভব, এই মুহূর্তে তাহা অনুমান করাও দুষ্কর। সুযোগ বস্তুটি সচরাচর ফিরিয়া আসে না। ভাগ্যদেবী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে ইতিহাস রচনার সুযোগ করিয়া দিয়াছেন। এই মুহূর্তটিকে প্রাণপণ আঁকড়াইয়া ধরাই একমাত্র কর্তব্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy