Advertisement
২০ ডিসেম্বর ২০২৪

গুরুদেবের কাছে মহাত্মা

গাড়ি রাখা ছিল স্টেশনে। কিন্তু প্রথমবার সস্ত্রীক শান্তিনিকেতনে এসে ছাত্রদের সঙ্গে হেঁটেই শান্তিনিকেতনে পৌঁছন মহাত্মা গাঁধী। ফুল দিয়ে বরণ করা হয়। লিখছেন মাধব ভট্টাচার্য

মাধব ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯ ০১:১০
Share: Save:

গুরুদেবের উদ্দেশে মহাত্মাজির টেলিগ্রাম যখন শান্তিনিকেতনে এসে পৌঁছল, সেই ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯১৫ তারিখে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ছিলেন না। টেলিগ্রামটি পড়ে জানা গেল, দু’দিন পরেই অর্থাৎ ১৭ তারিখ মহাত্মা গাঁধী শান্তিনিকেতনে আসছেন সস্ত্রীক।

ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী মহলে সেই খবর ছড়িয়ে পড়ল সঙ্গে সঙ্গেই। আশ্রমে যথোচিত মর্যাদায় তাঁদের অভ্যর্থনা জানানোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। আশ্রম প্রাঙ্গণে তোরণ তৈরি হল। রাস্তা পরিষ্কার হল, অভ্যর্থনার আসন-বেদি তৈরি হল। বৈদিক রীতি অনুযায়ী আলপনা আঁকা মাটির আসন। আসন বেদির চার কোণে চারটি কলাগাছ, আমের পল্লব ও পদ্মফুল-সহ জলপূর্ণ মাটির ঘট।

নির্দিষ্ট দিনে অধ্যাপক সি এফ অ্যান্ড্রুজ ও অধ্যাপক সন্তোষচন্দ্র মজুমদার বর্ধমান স্টেশনে পৌঁছে গিয়েছেন অতিথিদের স্বাগত জানাতে। অ্যান্ড্রুজ সাহেব মহাত্মা গাঁধীর পরিচিত। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবিদ্বেষী সরকারের বিরুদ্ধে যখন গাঁধীজি সংগ্রাম করে চলেছেন, গোপালকৃষ্ণ গোখলের নির্দেশে তখন গাঁধীজিকে সাহায্য করার জন্য অধ্যাপক অ্যান্ড্রুজ ও অধ্যাপক পিয়ার্সন কলকাতা থেকে জাহাজে চেপে ১৯১৪-র ১ জানুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছন এবং কিছু দিন গাঁধীজির সঙ্গে থাকেন।

বর্ধমান থেকে ট্রেনেই গাঁধীজিকে নিয়ে তাঁরা বোলপুর স্টেশনে পৌঁছন। বোলপুর স্টেশনেও আশ্রমের একদল ছাত্র উপস্থিত ছিল। অতিথিরা ট্রেন থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই মহাত্মার জয়ধ্বনি দিতে দিতে তারা স্টেশন চত্বর মুখরিত করে তোলে।

গাঁধীজির জন্য বোলপুর স্টেশনে একটি গাড়ি রাখা ছিল। কিন্তু তিনি গাড়িতে না উঠে, ছাত্রদের সঙ্গে সস্ত্রীক হেঁটেই শান্তিনিকেতন আশ্রমে পৌঁছন।

তোরণের কাছে আসতেই তাঁদের ফুল ও চন্দনের ফোঁটা দিয়ে বরণ করা হয়। সঙ্গীতাচার্য ভীমরাও শাস্ত্রী গান ধরেন, সেতার ও এস্রাজ বাজে সঙ্গে। এর পর তোরণ পেরিয়ে তাঁরা যখন আশ্রমগৃহের মুখে, তখন জল ঢেলে তাঁদের পা ধুইয়ে দেওয়া হয়। তার পর বসানো হয় সেই মাটির তৈরি আসন-বেদিতে। পঞ্চপ্রদীপ জ্বেলে, আবার ডালা সাজিয়ে তাঁদের বরণ করা হয়। গলায় মালা পরানো হয়, কস্তুরবা গাঁধীর কপালে সিঁদুর পরিয়ে উপহার দেওয়া হয় উভয়ের হাতে।

ক্ষিতিমোহন সেন সংস্কৃত শ্লোক পাঠ করেন। মহারাষ্ট্রীয় দুই অধ্যাপক রাজাঙ্গম আয়ার ও দত্তাত্রেয় বালকৃষ্ণ কালেলকর সেগুলি গুজরাতি ভাষায় অনুবাদ করে শোনান। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচালনায় আশ্রম-ছাত্ররা গান শোনায় ও শিল্পী অসিতকুমার হালদার নিজের আঁকা ছবি উপহার দেন মহাত্মাকে।

সংবর্ধনার উত্তরে গাঁধীজি দেশীয় রীতি অনুযায়ী এই অভ্যর্থনার জন্য তাঁদের কাছে আনন্দ প্রকাশ করেন। গাঁধীজির প্রথমতম শান্তিনিকেতন দর্শনের এই ছিল আনন্দময় স্মৃতি।

এর কিছু আগেই দক্ষিণ আফ্রিকার আন্দোলন শেষ হলে, অসুস্থ শরীর নিয়ে মহাত্মা গাঁধী বোম্বাই ফিরে এসেছিলেন ১৯১৫-র ৯ জানুয়ারি। দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর গড়া ফিনিক্স বিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে সমস্যা হবে ভেবেই রবীন্দ্রনাথের অনুমতিক্রমে অধ্যাপক অ্যান্ড্রুজের সহযোগিতায় তাদের শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমে রেখে পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা হয়েছিল।

গাঁধীজি চেয়েছিলেন, পঠনপাঠনের সঙ্গে সঙ্গেই আত্মনির্ভরশীল কর্মী গড়ে তোলা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শ বন্ধনহীন আত্মবিকাশের শিক্ষা। গাঁধীজির ইচ্ছা ছিল, শান্তিনিকেতনে কিছু দিন থেকে যাবেন, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করে তবে ফিরবেন। কিন্তু ২০ ফেব্রুয়ারি খবর এল, গতরাতে গোপালকৃষ্ণ গোখলে মারা গিয়েছেন। এই মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পরই গাঁধীজি সস্ত্রীক পুণে রওনা হয়ে গেলেন।

গাঁধীজি এর পর শান্তিনিকেতনে আসেন ৬ মার্চ। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ। এ যাত্রায় তিনি ১০ মার্চ পর্যন্ত থাকেন এখানে। ফিনিক্স ছাত্রদের স্বাবলম্বন প্রক্রিয়া নিয়ে শিক্ষক ও কর্মচারীদের সঙ্গে তাঁর আলোচনা হয়। তিনি বুঝতে পারছিলেন, বেশ কিছু শিক্ষক এর বিরোধী। তাঁর ‘স্বাবলম্বন’ শিক্ষাদর্শের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ শিক্ষাদর্শের পার্থক্য রয়েছে।

এই প্রসঙ্গে গাঁধীজি তাঁর আত্ম-জীবনীতে এক জায়গায় লিখছেন—‘‘আমার স্বভাব অনুযায়ী আমি বিদ্যার্থী ও শিক্ষকদিগের সহিত মিলিয়া গিয়াছিলাম। আমি তাহাদের সহিত আত্মনির্ভরতা সম্বন্ধে আলোচনা করিতে আরম্ভ করিলাম। বেতনভোগী পাচকের পরিবর্তে যদি বিদ্যার্থী-শিক্ষকেরা নিজেরাই রান্না করেন, তবে ভাল হয়। এই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথকে জানাইলে তিনি বলিলেন, শিক্ষকেরা যদি অনুকূল হন, তবে এ পরীক্ষা তাহার নিজের খুব ভাল লাগিবে। বিদ্যার্থীদিগকে তিনি বলিলেন, ইহাতেই স্বরাজের চাবি রহিয়াছে।’’

রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখছেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথের অনুমোদন পাইয়া ছাত্ররা (১০ মার্চ ১৯১৫) স্বেচ্ছাব্রতী হইয়া আশ্রমের সকল প্রকার কর্ম করিবার দায় গ্রহণ করিল—রান্না করা, জল তোলা, বাসন মাজা, ঝাড়ু দেওয়া, এমন কি মেথরের কাজ পর্যন্ত। অধ্যাপকদের মধ্যে সন্তোষচন্দ্র মজুমদার, অ্যান্ড্রুজ, পিয়ার্সন, নেপালচন্দ্র রায়, অসিত-কুমার হালদার, অক্ষয়চন্দ্র রায়, প্রমদা রঞ্জন ঘোষ ও জীবনী লেখক প্রভৃতি অনেকেই সেদিন সহযোগিতা করিয়াছিলেন। করেন নাই এমন লোকও ছিলেন। ১০ মার্চ দিনটি এখনো ‘গান্ধী পুণ্যাহ দিবস’ বলিয়া শান্তিনিকেতনে পালিত হয়। সে দিন প্রাতে পাচক, চাকর, মেথরদের ছুটি দিয়া ছাত্র ও অধ্যাপকেরা সকল প্রকার কাজ আপনাদের মধ্যে ভাগাভাগি করিয়া লইয়া মহোৎসব করেন।’’

এর পর গাঁধীজি আসেন ৩১ মার্চ অসুস্থ ছাত্র যাদবকে দেখতে। রবীন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে ডা. প্রাণকৃষ্ণ আচার্যকে আনিয়ে তার চিকিৎসা করাচ্ছিলেন। টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত যাদব ১০ এপ্রিল মারা যায়। অধ্যাপক পিয়ার্সনকে তার মৃত্যুশোক এতটাই আঘাত দিয়েছিল যে, আমেরিকায় গিয়ে অর্থ সংগ্রহ করে যাদবের নামে হাসপাতাল গড়ে তোলেন শান্তিনিকেতনে—পরে যার নামকরণ হয় ‘পিয়ার্সন হাসপাতাল’।

এর পর আবার গাঁধীজি ১৯২৫ সালের মে মাসে শান্তিনিকেতনে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করলে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে আমন্ত্রণ জানান। ২৯ মে রাতে গাঁধীজি বোলপুর স্টেশনে পৌঁছলে অ্যান্ড্রুজ মোটরে চড়িয়ে তাঁকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসেন। তাঁর সঙ্গে এ বারে সস্ত্রীক সতীশ দাশগুপ্ত, মহাদেব দেশাই, প্যারেলাল এঁরাও আসেন। তাঁদের সবার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল ‘শান্তিনিকেতন’ বাড়ির দোতলায়।

বাড়িটির ভেতরে আলপনা দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছিলেন প্রতিমা দেবী ও ক্ষিতিমোহন সেনের স্ত্রী কিরণবালা সেন। গাঁধীজি পৌছেই উত্তরায়ণে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করে আসেন। পরদিন সকালে প্রথমেই গাঁধীজি দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে যান এবং তার পরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেন একাকী। তাঁদের মধ্যে ঘণ্টা তিনেক আলোচনা হয়। আলোচনার বিষয়বস্তু কেউ জানতে পারেননি। সন্ধ্যায় উত্তরায়ণ প্রাঙ্গণে ‘চণ্ডালিকা’ নাটক দেখে মুগ্ধ হন গাঁধীজি। ৩১ মে সকালে শ্রীনিকেতন পরিদর্শনে যান তিনি। এর পর ১ জুন সোমবার থাকায় নিয়মানুযায়ী সারাদিনই তিনি মৌন অবস্থায় কাটান এবং অবশেষে ২ জুন সকালে কলকাতা রওনা হন তিনি, ওখান থেকে দার্জিলিংয়ে গিয়ে অসুস্থ চিত্তরঞ্জন দাশকে দেখার জন্য।

শেষবারের মতো শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন গাঁধীজি ১৯৪৫ সালের শেষের দিকে। তার আগে আসেন ১৯৪০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। আর ১৯ ফেব্রুয়ারি তিনি শান্তিনিকেতন ছাড়ার আগে রবীন্দ্রনাথ গাঁধীজির হাতে একটি চিঠি তুলে দিয়ে অনুরোধ করেন—তাঁর অবর্তমানে তিনি যেন বিশ্বভারতীর প্রতি দৃষ্টি রাখেন। তার উত্তরে গাঁধীজি জানান, বিশ্বভারতীর স্থায়িত্বের বিষয়ে তিনি যথাসাধ্য করবেন। পরে গাঁধীজি রবীন্দ্রনাথের দেওয়া চিঠিটি আবুল কালাম আজাদকে দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রতি দৃষ্টি রাখবার অনুরোধ করেন। আজাদ সাহেব শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পর ১৯৫১ সালে বিশ্বভারতীকে কেন্দ্র সরকারের তত্ত্বাবধানে আনার ব্যবস্থা করেন। তখন অবশ্য রবীন্দ্রনাথ ও গাঁধীজি দু’জনের কেউই আর বেঁচে নেই।

তথ্যসূত্র:

রবিজীবনী-প্রশান্তকুমার পাল ৭ম খণ্ড, পৃ: ৮৮-৮৯/ ৯ম খণ্ড, পৃ: ২২৪, রবীন্দ্রজীবনী প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ৪র্থ খণ্ড, পৃ: ২১৩, পশ্চিমবঙ্গ: গাঁধীসংখ্যা, জানু-ফেব্রু ১৯৯৫ পশ্চিমবঙ্গ: বীরভূম জেলা সংখ্যা, পৃ: ১৩৪

লেখক আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক ও সাহিত্যিক, মতামত নিজস্ব

অন্য বিষয়গুলি:

Rabindranath Tagore Mahatma Gandhi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy