ছবি: সংগৃহীত
শক্তিনগর জেলা হাসপাতাল চত্বরে অনেক সময়ই ব্যবহৃত রক্ত মাখা তুলো, ব্যান্ডেজ, ক্যাথিটার নিয়ে পথ কুকুরদের টানাটানি করতে দেখা যায়। এমন দৃশ্য চোখে পরে জেলা সদর হাসপাতালের পাশাপাশি অন্যান্য মহকুমা, ব্লক স্তরের হাসপাতাল গুলোতেও।
এটা কী করে সম্ভব? দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নির্দেশে এবং নির্দিষ্ট আইনের ভিত্তিতে এই মেডিক্যাল বর্জ্য সাধারণ ভ্যাটে ফেলার কথাই নয়। আলাদা-আলাদা রঙের প্যাকেটে আলাদা-আলাদা বর্জ্য রাখা থাকবে এবং তা প্রতিদিন সংগ্রহ করে নিয়ে যাবে সরকার নিযুক্ত সংস্থা। তার পর নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় ওই বর্জ্য নষ্ট করে ফেলার কথা। কারণ, এই সব বর্জ্য থেকে সংক্রমণ ছড়াতে পারে।
হাসপাতাল সূত্রের খবর, কলকাতার সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে তবু নিয়মিত এই বর্জ্য সাফ করা হয়। কিন্তু জেলাগুলির অবস্থা একেবারেই ভাল নয়। সেখানে মেডিক্যাল বর্জ্য নিয়মিত সংগ্রহ করে নষ্ট করা হয় না। হাসপাতাল চত্বরেই সংক্রমণের যাবতীয় আশঙ্কা নিয়ে পড়ে থাকে সেই বর্জ্যের স্তূপ।
বিগত কয়েক বছরে রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলোর চেহারার আমূল পরিবর্তণ হয়েছে। তৈরি হচ্ছে ঝকঝকে ভবন। বসছে টাইলস। নতুন যন্ত্রপাতি বসছে। বহিরঙ্গে চোখ ধাঁধানো বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে তা পাল্লা দিচ্ছে। কিন্তু গোড়ায় গলদ থাকছে। ঝকঝকে হাসপাতাল চত্বরে নিয়ম মেনে মেডিক্যাল বর্জ্য সাফ হচ্ছে না। তাতে পচন ধরছে। সেই সঙ্গে পাল্লা গিয়ে ছড়াচ্ছে সংক্রমণ। তা নিয়মিত রিসাইকেল করা বা নষ্ট করা হচ্ছে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দাবি, হাসপাতাল বর্জ্য থেকে রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা অত্যন্ত বেশি। স্বাস্থ্য দফতর নির্ধারিত ‘বায়োমেডিক্যাল ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট রুল’ অনুযায়ী, এই বর্জ্য অন্য ময়লার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া যাবে না। হাসপাতালের ওয়ার্ডে রোগীর দেহাংশ, টিউমার, থুতু, দেহরস, মলমূত্র, কফ, রস, রক্ত বা পুঁজ লেগে থাকা বর্জ্য ফেলতে হবে হলুদ প্লাস্টিকে। এবং সেই বর্জ্য মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে এর থেকে। লাল প্লাস্টিকে সিরিঞ্জ, ক্যাথিটার, ইন্ট্রাভেনাস টিউব, গ্লাভস, স্যালাইন বোতল ফেলতে হবে। নীল রঙের প্লাস্টিকে থাকবে কাচ ও ধাতব বর্জ্য। কালো রঙের পাত্রে থাকবে সাধারণ বর্জ্য। একমাত্র কালো প্যাকেট সাধারণ ভ্যাটে ফেলা যাবে। বাকিগুলো কোনও ভাবেই তা করা যাবে না।
এই বায়োমেডিক্যাল ওয়েস্ট রিসাইকেল বা নষ্ট করার দু’টি পর্যায় আছে। এক, এগুলিকে সঠিক ভাবে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে রাখা। আর দুই, সেগুলিকে হাসপাতাল ও নার্সিংহোম থেকে সংগ্রহ করে নষ্ট বা রিসাইকেল করা। প্রথম প্রক্রিয়ার জন্য চাই কর্মী, নার্সদের সচেতনতা আর দ্বিতীয়টার জন্য চাই উপযুক্ত পরিকাঠামো। কিন্তু বাস্তবে দু’টি ক্ষেত্রেই চরম অব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে। আর এর পিছনে হাসপাতালের কর্মী, নার্স ও চিকিৎসকদের এতাংশের সদিচ্ছার অভাব ও পরিবেশ ভাবনার অভাব কাজ করছে বলে স্বাস্থ্যভবন সূত্রের খবর।
স্বাস্থ্য দফতর থেকে হাসপাতাল কর্মী, নার্সদের মেডিক্যাল বর্জ্যের ব্যাপারে আলাদা করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সচেতন করা হচ্ছে। কিন্তু তার পরও বিভিন্ন হাসপাতালে এই সংক্রান্ত নিয়ম বা নির্দেশিকা মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ। আগে ডে কেয়ার সেন্টার বা রোগী ভর্তি থাকে না এমন মেডিক্যাল কেন্দ্রকে এর বাইরে রাখা হয়েছিল। এখন সেগুলিও আইনের আওতায় এসেছে। কিন্তু তাতে কী? নজরদারির অভাবে আইনের সঠিক বাস্তবায়ন এখনও অধরা। জেলা হাসপাতালে যখন অহরহ নিয়ম ভাঙার নজির তৈরি হয় তখন মহকুমা, ব্লক ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলির অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা যায় যে, গোটা রাজ্যে এই হাসপাতাল বর্জ্য সংগ্রহ ও রিসাইকেল করার জন্য দু’টো মাত্র সংস্থা আছে। অনেক সময় স্বাস্থ্য কর্তারাই প্রশ্ন তোলেন, এত কম সংস্থার পক্ষে এতগুলো সরকারি, বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিং হোমের বায়োমেডিক্যাল ওয়েস্ট সংগ্রহ করে রিসাইকেল করা কতটা সম্ভব। যেমন নদিয়া জেলায় একটি মাত্র সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাদের ‘প্লান্ট’ কল্যাণীতে। কল্যাণী থেকে করিমপুর পর্যন্ত সমস্ত হাসপাতাল ও নার্সিং হোমের বজ্য পদার্থ কি একটি সংস্থার পক্ষে সংগ্রহ ও নষ্ট করা সম্ভব? ৪৮ ঘন্টার মধ্যে বর্জ্য সংগ্রহ করার কথা। কিন্তু বাস্তবে যে তা হয় না সেটা স্বীকার করে নেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ফলে অনেক সময় বর্জ্য পড়ে থাকে হাসপাতাল চত্বরেই। আবার অনেক সময় রাস্তার কোথাও তা ফেলে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। তবে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্যদ জানিয়েছে, এই সমস্যার জন্যেই সংস্থার সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে।
সেটা কি শুধু আর্থিক কারণ? নাকি এর পিছনেও আছে সেই সঠিক উদ্যোগের অভাব কারণ? নাকি আসলে সরকারি স্তরে রয়ে গিয়েছে পরিবেশ ভাবনার অভাব? শুধু মাত্র প্রচার করে, সেমিনার করে, ফ্লেক্স টাঙিয়ে, কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এই সমস্যার সমাধন করা সম্ভব না। সরকারকেও উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে উদ্যোগী হতে হবে। গুরুত্ব দিতে হবে পরিবেশ ভাবনাকে। এগিয়ে আসতে হবে নাগরিক সমাজকেও। প্রশাসনের উপরে তাদের চাপ তৈরি করতে হবে। তা না হলে মানব সমাজকে ভয়াবহ বিপদের মুখোমুখি হতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy