Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

ভ্রান্তিবিলাস

নাগরিক পঞ্জি প্রস্তুতির প্রয়োজনটি কেন অনুভূত হইয়াছিল, তাহা বোঝা সহজ। কোনও রাষ্ট্রের পক্ষেই অনন্ত কাল ধরিয়া অন্য দেশ হইতে আগত মানুষের স্রোতকে নিজের জনসমাজের অঙ্গীভূত করা সহজ নহে।

— ফাইল চিত্র

— ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:০২
Share: Save:

কেন্দ্রীয় বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সম্প্রতি ঢাকায় গিয়া মন্তব্য করিয়াছিলেন: এনআরসি ভারতের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ বিষয়। গত শনিবার এনআরসি চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর দেশব্যাপী যে সকল মৌলিক প্রশ্ন উঠিতেছে, সে সবের পরিপ্রেক্ষিতে মন্তব্যটি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। নাগরিকত্ব প্রমাণের নীতি ও পদ্ধতি যদি এমনই হয়, তাহা হইলে তো সংশয়ের অবকাশ থাকিবার কথা নহে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করিতে পারিবেন না। যাঁহারা স্মরণকালের মধ্যে অন্য দেশ হইতে আসেন নাই, তাঁহাদের নিকটও নিজেদের রাষ্ট্রীয় পরিচয় এই পদ্ধতিতে প্রমাণ করা সহজ কাজ নহে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল— এমনকি বিজেপিও অভিযোগ তুলিতেছে: এনআরসি ঠিক ভাবে করা হয় নাই, নাগরিক-অনাগরিক হিসাব সবই গুলাইয়াছে। যাঁহাদের নাম নাগরিক তালিকায় উঠিয়াছে, তাঁহাদের অনেকেই নাকি ‘বিদেশি’। আবার যাঁহাদের নাম নাগরিক তালিকায় ওঠে নাই, তাঁহারা নাকি নিশ্চিত ভাবে নাগরিক। অর্থাৎ নামের সংখ্যা প্রাথমিক খসড়ার চল্লিশ লক্ষ হইতে চূড়ান্ত তালিকায় উনিশ লক্ষে নামিলেও সেই সংখ্যাকে প্রামাণ্য বলিবার উপায় নাই। উনিশ লক্ষ ছোট সংখ্যা নহে। এই বিপুল সংখ্যক ‘অ-নাগরিক’কে লইয়া ভারতীয় রাষ্ট্র কী করিবে, তাহাও অত্যন্ত অস্পষ্ট। এনআরসি এ দেশের একান্ত ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ হইলে নিশ্চয়ই ‘বিদেশি’ হিসাবে চিহ্নিত মানুষগুলিকে বিদেশে পাঠানো হইবে না। এ দিকে নাগরিক তালিকা তৈরির পর নিশ্চয়ই নাগরিকদের সহিত তাঁহাদের কিছু পার্থক্যও করিতে হইবে। তবে? তবে কি বন্দিশিবিরই ইঁহাদের আজীবনের আশ্রয়? এত অস্পষ্ট নীতি লইয়া এই কাজে অগ্রসর হয় যে রাষ্ট্র, মানুষের জীবন লইয়া ছিনিমিনি খেলিবার নৈতিক অধিকার তাহার আছে কি? যে রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকতার শর্তগুলিই এত অস্বচ্ছ ও ভঙ্গুর, এমন বিপুল পরিমাণ মানবাধিকার কি সে ভঙ্গ করিতে পারে?

নাগরিক পঞ্জি প্রস্তুতির প্রয়োজনটি কেন অনুভূত হইয়াছিল, তাহা বোঝা সহজ। কোনও রাষ্ট্রের পক্ষেই অনন্ত কাল ধরিয়া অন্য দেশ হইতে আগত মানুষের স্রোতকে নিজের জনসমাজের অঙ্গীভূত করা সহজ নহে। কেবল ভারত কেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কিংবা ইউরোপের দেশগুলির দিকে তাকাইলেও তাহা বোঝা যায়। কিন্তু এই পথে কি সমস্যার সমাধান সম্ভব? এমন একটি ভ্রান্ত সমাধানপথ লইয়া বিজেপি এত দিন অসমে তাহার মুসলিমবিরোধী রাজনীতির নখদন্ত তীক্ষ্ণ করিয়াছে। এখনও যে এনআরসির চূড়ান্ত তালিকার বিরুদ্ধে তাহাদের তীব্র অভিযোগ, তাহা মুসলিমবিদ্বেষ হইতেই জাত। সেই কারণে এনআরসি-পর্বে ফরেনার্স ট্রাইবুনালের বিবেচনা এখনও বাকি থাকিলেও বিজেপির পক্ষ হইতে ইতিমধ্যেই জানানো হইয়াছে, তালিকা যেমনই হউক, ‘অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিতকরণ’ চলিতে থাকিবে।

এতদ্ব্যতীত, একটি গোড়ার ভাবনায় মস্ত গলদ রহিয়াছে। ধর্ম তো দূরস্থান, এমনকি কেবল ভূমি ও জন্মের বিচারেও নাগরিকত্ব নির্ধারণের প্রক্রিয়াটি অচিন্তনীয় রকমের সঙ্কীর্ণ। অন্যান্য সভ্য দেশের দিকে তাকাইলেও বিষয়টি বোধগম্য হয়। নাগরিকতা অর্জন করিবার বিষয়ও বটে। এবং যান্ত্রিক ভাবে কোনও বৎসরকে তাহার সীমারেখা হিসাবে নির্দিষ্ট করা যায় না। কোনও প্রগতিবাদী উন্নতিকামী রাষ্ট্র, যে নিজেকে (এখনও) লিবারাল বলিয়া পরিচয় দেয়, এই ভাবে নাগরিকতার সঙ্কীর্ণতম নীতিটি তাহাকে বরণ করিয়া লইতে দেখিলে হতাশায় গ্রস্ত হওয়া ছাড়া উপায় নাই। একটি সমুন্নত আদর্শের মাথা মুড়াইয়া তাহাকে দুই ধর্মসম্প্রদায়ের যুদ্ধভূমিতে পরিণত করিতে দেখিলে ভয়ে শিহরিত হওয়া ছাড়া উপায় নাই। ভারতীয় রাষ্ট্র কি বুঝিতেছে, কোন বিভীষিকাময় নৈরাজ্যের দিকে সে যাত্রা করিয়াছে?

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy