অমিতাভ গুপ্তের ‘এমন আপন কেহ নাই’ (৩-১০) শীর্ষক প্রবন্ধটি গাঁধীজি ও নেতাজির সম্পর্কের কথা মনে করিয়ে দেয়। গাঁধীজির কাছে নেতাজিই একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন, যিনি সরাসরি তাঁর বিরোধিতা করার সাহস ও শক্তি রাখতেন। কিন্তু দু’জনের একে অপরের প্রতি মনের দিক থেকে গভীর টান ছিল, যা পরস্পরকে লেখা চিঠিপত্র থেকে বোঝা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নেতাজি যখন জার্মানির সাহায্য চান দেশ স্বাধীন করতে, সেই সময় আমেরিকার সাংবাদিক লুই ফিশার গাঁধীজিকে প্রশ্ন করেন, নেতাজি সম্পর্কে তাঁর কী ধারণা? উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘বোস ওয়াজ় আ পেট্রিয়ট অ্যামং পেট্রিয়টস।’’
অন্য দিকে, গাঁধীজির নেতৃত্বের প্রতি নেতাজি এতটাই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন যে, তিনি বলতেন, যদি ইংরেজদের বিরুদ্ধে আবার সংগ্রাম ঘোষণা করেন গাঁধীজি, তা হলে তিনি সব ভুলে মহাত্মার এক জন সৈনিক হিসেবে সব কিছু, এমনকি প্রাণ দিতে রাজি। নেতাজি আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করে রেডিয়ো মারফত গাঁধীজিকে প্রথমেই প্রণাম জানিয়ে ভারতের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ১৯৪৪ সালে আজাদ হিন্দ রেডিয়ো মারফত নেতাজি গাঁধীজিকে ‘ফাদার অব দ্য নেশন’ সম্বোধন করেন। শেষের দিকে গাঁধীজির সঙ্গে কংগ্রেসের যে সম্পর্ক দাঁড়িয়েছিল, তার নিরিখে বলা যায়, নেতাজিই গাঁধীজির সবচেয়ে আপন ছিলেন।
জয়দেব জানা
কলকাতা-৮
নিকটজন
‘এমন আপন কেহ নাই’ আজকের দিনে বেশ প্রাসঙ্গিক। ভিন্ন ভাবনায় বিশ্বাসী, দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান সত্ত্বেও নেহরু ও গাঁধী কী ভাবে প্রায় তিন দশক একসঙ্গে চলেছেন, তা অভাবনীয়। এই দুই বিপরীত প্রান্তের মানুষের মিলনের এক ব্যাখ্যা হতে পারে, তাঁদের পরস্পরের প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধা। আর এক তত্ত্ব হচ্ছে, দু’জনেরই দেশকে স্বাধীন করার তীব্র আবেগ।
নেহরু ও গাঁধী কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকেও, কৃষকদের সমস্যাকে স্বাধীনতার দাবির সঙ্গে নিয়ে এক বৃহত্তর আন্দোলনের পটভূমি তৈরি করতে পারেননি। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মুসলিম লিগ ও তফসিলি সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব ভারতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করে। সঙ্গে পেয়ে যায় মুসলমান ও নিম্নবর্গের হিন্দু কৃষকদের, যাঁদের থেকে কংগ্রেস বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এ ব্যর্থতাও তাঁদের কাছাকাছি এনেছিল।
সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা-৫৭
লৌকিক ভাষা
আবদুল কাফি (‘দূরে দূরে থাকি তাই’, ৪-১০) লিখেছেন, ‘‘শব্দ কুড়োচ্ছেন বিদ্যাসাগর, রাস্তাঘাটে মাঠে-ময়দানে, হাটে-বাজারে—যেখানে যা পাওয়া যায়।’’ এই ধরনের ভাষাগত বা আভিধানিক শব্দ-সংগ্রহকে লৌকিক শব্দকোষ বলা চলে, আর কাজটিকে চিহ্নিত করা হয় ‘ক্ষেত্র-ভাষাবিজ্ঞান’ নামে। যদিও তিনি ক্ষেত্র-ভাষাবিজ্ঞানের উপাত্ত ব্যবহার করে কেবল অভিধান লিখতে চেয়েছিলেন, সাহিত্যে প্রয়োগ করতে সে ভাবে চাননি, কিংবা বাংলা ব্যাকরণ বা ভাষাতত্ত্ব প্রণয়ন করতেও চাননি। তবে এমন কর্ম প্রায় সমকালে বা অব্যবহিত পরে বিবেকানন্দ করেছিলেন তাঁর পরিব্রাজক বইতে, ‘জাহাজী পারিভাষিক শব্দ’ সংগ্রহ এবং লেখায় এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে।
তাঁর সময়ে সাহিত্যে প্রচলিত শব্দ ব্যবহারের যথেচ্ছ উপস্থিতি বিদ্যাসাগরের শব্দমঞ্জরী-তে লব্ধ। এটি তৎসম শব্দের অসম্পূর্ণ অভিধান। তাঁর মৃত্যুর পর বর্ণানুক্রমিক শব্দ-সংগ্রহ, যা সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, তা-ও ছিল অসম্পূর্ণ। পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক জানিয়েছেন, ‘‘শুনা যায়, একখানি বৈজ্ঞানিক-প্রণালী-সম্মত বাঙ্গালা অভিধান প্রণয়ন তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল।’’ বিজ্ঞানসম্মত বাংলা ব্যাকরণের যে প্রস্তাব হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় করেছিলেন, তা পূর্বেই আভাসিত হয়েছিল শব্দমঞ্জরী-তে। আর শব্দ-সংগ্রহ সঙ্কলনে ৭০৭১টি শব্দের মধ্যে প্রায় ১০৯৬টি আরবি-ফারসি শব্দ যুক্ত হয়েছিল। কারণ তিনি লোকব্যবহৃত, মৌখিক, প্রচলিত শব্দগুলিকে প্রাধান্য দিতে চেয়েছিলেন। অতি অল্প হৈল, আবার অতি অল্প হৈল, ব্রজবিলাস ইত্যাদি গ্রন্থেও এ জাতীয় কিছু শব্দের প্রয়োগ তিনি করেছিলেন। এ যেন তাঁর নিজেরই সৃষ্ট সংস্কৃতায়িত বাংলা ভাষা ও রচনারীতির বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী জানিয়েছেন একটি ঘটনার কথা— বঙ্কিম ও বিদ্যাসাগরের রচনা থেকে ‘র্যানডম চয়েস’-এর মাধ্যমে সংস্কৃত শব্দের উপস্থিতির হার যাচাই। সেটি ঘটে বিদ্যাসাগরের সামনে। দেখা যায়, বঙ্কিমের এমন শব্দের হার ৬৫ শতাংশ, কিন্তু বিদ্যাসাগরের হার সেখানে ৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রচলিত শব্দ ব্যবহারে তিনি এগিয়ে ছিলেন।
শব্দমঞ্জরী ও শব্দ-সংগ্রহ-তে বিদ্যাসাগর বিশেষ ধরনের বানানবিধি (ই-কার যুক্ত বানান) প্রচলিত করার চেষ্টা করেন— যথা, আসামি, কেরানি, খুনি, পাখি ইত্যাদি। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় জাতি, ব্যক্তি, ভাষা, বিশেষণ, স্ত্রী ইত্যাদি বাচক শব্দে ঈ-কার চালু করে। ১৯৯২-এ বাংলাদেশের বাংলা একাডেমী এবং ১৯৯৭-এ পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি বিদ্যাসাগরীয় বানানরীতি অনেকখানি গ্রহণ করে। বোঝা যায়, বাংলা বানান নির্ধারণে তিনি কত আধুনিক ছিলেন।
শ্যামলচন্দ্র দাস
তারাবাগ, বর্ধমান
গানের মোহর
১৯৬২ সাল। রবীন্দ্রশতবর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত বিরাট অনুষ্ঠানে শান্তিনিকেতনে আমন্ত্রিত কবি, সাহিত্যিকদের সই নিতে সারা দিন ভিড় জমে আছে পূর্বপল্লির অতিথিশালায়। সেই কচিকাঁচাদের ভিড়ের মধ্যে থেকে একটি চুড়ি পরা হাত এগিয়ে এল সই নেওয়ার উদ্দেশ্যে। এই হাত তো বালিকাসুলভ নয়! মুখ তুলে চাইতেই সকলে বাক্যহারা। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এসেছেন তাঁদের সই নিতে। এও সম্ভব? সই নেবেন তো তাঁরাই। অপ্রস্তুত সকলকে সে দিন সইয়ের খাতায় নিজেদের নাম লিখতে হল। গানই তাঁর জীবনের পাঠ। ১২ অক্টোবর, ১৯২৪ সালে তাঁর জন্ম।
রবীন্দ্রশতবর্ষের সেই সভাতেই শান্তিনিকেতনের ইংরেজির অধ্যাপক কবি সুনীল চন্দ্র সরকার রবীন্দ্রসঙ্গীতের মান-বিভ্রাট বিষয়ে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘বাইরের দোষ দিয়ে আর কী হবে, আজকাল মোহরও মাঝেমাঝে…।’’ সভা ভাঙার শেষ বীণাতে সত্যিই সে দিন চঞ্চল তান লেগেছিল। সহস্র গুঞ্জনধ্বনির মাঝে সে দিনই বিশ্বভারতীর পদ থেকে চিরমুক্তি চেয়েছিলেন মোহর। পরে যদিও সে মেঘ সুনীলবাবুই কাটিয়ে দেন। বার বার দুঃখ পেয়েছিলেন বলেই হয়তো কাউকে দুঃখ দিতে চাইতেন না। ‘তুমি পারবে না’ বা ‘হয়নি’ এই কথা বোধ হয় ছাত্রছাত্রীরা তাঁর মুখ থেকে শোনেনি।
সাজতে ভালবাসতেন। ফুলপাতাই ছিল তাঁর সাজের সামগ্রী। যেটাই করতেন, সুচারু ভাবে। বলতেন, সংসারও শিল্প। তাই যেমন নিখুঁত সুর লাগিয়ে সান্ধ্য-আড্ডায় গান গাইতেন, তেমনই পাঁঠার মাংস রান্নায় মেথি ফোড়ন ব্যবহারের রহস্যও তাঁর জানা ছিল। সংসার, প্রতিবেশী, বন্ধুতা সমস্ত কর্তব্য পালন করেই বরাবর সঙ্গীতকে সময় দিয়েছেন। এই ‘আকবরি মোহর’-কে বহির্বিশ্ব কতটুকু চেনে, বলা যায় না। কিন্তু শান্তিনিকেতনের প্রতিটা মেঠোপথ, বনপুলকের গাছের কাছে সে চিরচেনা। মোহর যে তাদেরই।
অঙ্কন চট্টোপাধ্যায়
পালসিট, পূর্ব বর্ধমান
অন্যরাও থাক
মহাত্মা গাঁধী স্থান পেয়েছেন ভারতের টাকার নোটে। কিন্তু এ দেশে আরও অনেক মনীষী আছেন। তাঁদেরও ভারতীয় মুদ্রায় ও নোটে স্থান দেওয়া উচিত। সুভাষচন্দ্র বসু, আব্দুল কালাম, অম্বেডকর প্রমুখের ছবি থাকলে তাঁদেরও আমরা সম্মান জানাতে পারি।
সুজিত কুমার ভৌমিক
চণ্ডীপুর, পূর্ব মেদিনীপুর
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy