সত্যজিৎ রায়।
কয়েক বছর ধরে একটি ছবি মুক্তি পাওয়ার আগেই সমাজমাধ্যমে ছবিটি বয়কটের ডাক দেওয়ার যে প্রথা শুরু হয়েছে, তা আজ যেন এক অভ্যাসে এসে দাঁড়িয়েছে। ছবির পোস্টার, ট্রেলার অথবা ফার্স্ট লুক দেখেই এক দল মানুষ একটি ছবিকে কোনও এক কারণে আপত্তিজনক বলে মনে করেন, এবং ছবিটির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার কাজে লেগে পড়েন। একটি ছবির বিষয়বস্তু কারও আপত্তিজনক মনে হতেই পারে, একটি ছবি কোনও মানুষের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত দিতে পারে, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু, ছবি মুক্তির আগেই যদি ছবিটিকে বাতিল করে দেওয়া হয়, তা হলে তো মানুষ ছবিটিকে বিশ্লেষণ করার সুযোগটুকুও পাবেন না।
বর্তমানে এই বয়কট প্রথা যে চেহারা নিয়েছে, তা ভবিষ্যতের জন্য এক অশনিসঙ্কেত। একটি ছবি তৈরি করার পিছনে থাকে সেই ছবির নির্মাতা এবং কলাকুশলীদের ভাবনাচিন্তা ও পরিশ্রম। যে কোনও মুক্তমনের দর্শকের উচিত আগে ছবিটি দেখা, তার পরে সেই ছবি নিয়ে মন্তব্য করা। আমরা ক্রমাগত আমাদের দেশের ছবির গুণাগুণ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে থাকি, কিন্তু ছবি মুক্তির সময় যদি সামান্যতম উদারতাটুকুও দর্শক হিসেবে আমরা না দেখাতে পারি, তা হলে ভারতীয় ছবি তার হারানো সিংহাসন ফিরে পাবে, তা আশা করা যায় কী করে?
অকারণে একটি ছবিকে এক দল প্রতিক্রিয়াশীল মানুষের হাতে পর্যুদস্ত হতে দেখলে, নিজেদের মূল্যবোধকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে। এই মানুষেরা তো অতীতেও ছিলেন। কিন্তু তখন মুক্তির আগেই ছবিকে বাতিল করে দেওয়ার জন্যে কেউ সরব হতেন না। অর্থাৎ, আজ যদি সত্যজিৎ রায় গণশত্রু তৈরি করতেন, তা হলে তাঁকেও কি এই ফাঁপা, ভিত্তিহীন দাবিগুলির সামনে পড়ে অপদস্থ হতে হত? মুঠোফোনে চটজলদি একটি টুইট করে বয়কটের ডাক দেওয়াটা আমাদের কাছে বিজ্ঞানের অভিশাপ ছাড়া আর কিছুই নয়।
শিল্পীদের স্বাধীনতা হরণের চেষ্টা করলে তা কী ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, তা তো আমরা অনেক দেশেই দেখেছি। ইরানের কথাটা মাথায় আসে সবার আগে। যাঁরা ছবির তত্ত্ব নিয়ে কথা বলেছেন এবং নানা তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন, তাঁরা একাধিক বার বলেছেন যে, ছবির আলাদা আলাদা ভাষা হয় না, ছবির ভাষা একটাই, তাকে আমরা ‘সিনেম্যাটিক ল্যাঙ্গোয়েজ’ বলতে পারি। এ কথা সত্যজিৎ রায় সহজ ভাবে অনেক বার বলেছেন। এই সময়ে এই কথাটা বোঝা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, যে ভাবে শিল্পীদের মুখ বন্ধ করে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা সারা বিশ্বে চলছে, তাতে ভবিষ্যতে যেন একটি শিল্পমাধ্যম হিসেবে সিনেমাকে বিপদের মুখে না পড়তে হয়। সিনেমা যেন এক দল মানুষের প্রোপাগান্ডা তৈরির যন্ত্রে রূপান্তরিত না হয়ে যায়। তাই আমাদের দ্রুত, দেশ কালের সীমানা অতিক্রম করে, চিত্রনির্মাতা ও বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন দর্শকদের মধ্যে ঐক্য তৈরি করতে হবে।
সৌমাল্য চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা-৩২
খলনায়ক
চলতি বছরের শুরুর দিকে রকেট বয়েজ় নামে একটি ওয়েব-সিরিজ় আসে একটি বেসরকারি চ্যানেলের ওটিটি প্ল্যাটফর্মে। বিষয় ছিল ভারতে স্বাধীনতার আগের ও পরের কয়েকটি দশকে বিজ্ঞানের বিপুল অগ্রগতি— নিউক্লিয়ার ফিজ়িক্স এবং স্পেস সায়েন্সে। এই সিরিজ়ের প্রধান চরিত্র দুই পদার্থবিদ, হোমি ভাবা আর বিক্রম সারাভাই। ‘টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ’ তৈরিতে ভাবা-র অবদান, ভারতকে নিউক্লিয়ার শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার নিরন্তর চেষ্টা রয়েছে এক দিকে। অন্য দিকে, সারাভাইয়ের একের পর এক প্রতিষ্ঠান তৈরির স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করা, ভারতের প্রথম স্পেস প্রজেক্টে তাঁর অবদান। সেই সঙ্গে দু’জনেরই ব্যক্তিগত জীবন, এই দুই পদার্থবিদের মধ্যে সম্পর্ক ও পরমাণু বোমা তৈরি নিয়ে তাঁদের মতান্তরের কথাও আছে। কিন্তু ভালকে ভাল বলতে গেলে এখনও আমাদের তার পাশে মন্দকে খাড়া করতে হয়। রেজ়া মেহেদি এই সিরিজ়ের খলনায়ক। এই সিরিজ়ে দেখানো হয়েছে, তিনি এক জন বাঙালি পদার্থবিদ, তৎকালীন অ্যাটমিক রিসার্চ কমিটির সদস্য। কলকাতায় একটি নিউক্লিয়ার ফিজ়িক্সের গবেষণাকেন্দ্র তৈরি করেছেন। সেখানে বানিয়েছেন ভারতের প্রথম সাইক্লোট্রন। লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে পার্লামেন্টে সরকারের একটি শিক্ষানীতির কড়া সমালোচনাও করেছেন।
রেজ়া মেহেদি সম্পর্কে সিরিজ়ের এই সব ক’টি তথ্য দুর্ভাগ্যজনক ভাবে মিলে যায় বাঙালি পদার্থবিদ মেঘনাদ সাহার জীবনের সঙ্গে। ভারতের প্রথম সাইক্লোট্রন (তেজষ্ক্রিয় নিউক্লীয় কণা উৎপাদনকারী যন্ত্র) তৈরি হয়েছিল কলকাতায় মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে, তাঁর প্রতিষ্ঠিত বর্তমানের ‘সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজ়িক্স’ নামক দেশের অন্যতম গবেষণা কেন্দ্রে। অ্যাটমিক রিসার্চ কমিটির সদস্য সাহা ভারতে শিক্ষা-প্রকল্প, কৃষি, শিল্পায়ন, স্বাস্থ্য, নদী-প্রকল্প, উদ্বাস্তু-সমস্যা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সরাসরি কাজ করার জন্য ১৯৫২ সালে উত্তর-পশ্চিম কলকাতা কেন্দ্র থেকে ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে লড়েছিলেন। সাংসদ থাকাকালীন, ১৯৫৬ সালে তাঁর অকালমৃত্যু পর্যন্ত লাগাতার সরকারের বিভিন্ন নীতির গঠনমূলক সমালোচনা করে গিয়েছেন সংসদে। ভারত-সহ গোটা বিশ্বের পদার্থবিদ্যা চর্চায় তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। দেশে-বিদেশে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক অথবা স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশোনা করতে গেলে আমাদের পড়তেই হবে ‘সাহা আয়োনাইজ়েশন ইকুয়েশন’। ভারতের নদী-বিজ্ঞান আর নদী-প্রকল্পের অন্যতম স্থপতি মেঘনাদ সাহা সারা পৃথিবীর নদী সংরক্ষণ, নদী-সংলগ্ন এলাকার রক্ষণাবেক্ষণ, বাঁধ বানানো, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী থেকে শক্তি উৎপাদন বিষয়ক কাজকর্ম বিস্তারিত চর্চা করে দামোদর ভ্যালি প্রকল্পে প্রয়োগ করেন। পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুদের অবস্থার উন্নতির জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে সরব হন তিনি। ভারতের দারিদ্র, বেকারত্ব ইত্যাদি সমস্যার সমাধানে এবং সার্বিক উন্নয়নের জন্য বৃহৎ শিল্পায়নের সমর্থক মেঘনাদ সাহার জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে অনেক বিষয়ে মতান্তর ছিল।
কোন অভিপ্রায়ে, কিসের ভিত্তিতে, শুধুমাত্র নাম ভাঁড়িয়ে এই অবিস্মরণীয় পদার্থবিদের জীবনের আধারে তৈরি করা হল ভারতের পদার্থবিদ্যার স্বর্ণযুগের উপর তৈরি একটি ওয়েব-সিরিজ়ের খলনায়কের চরিত্র? এই খলনায়কের কী ভূমিকা ছিল এই সিরিজ়ে? নিরন্তর হোমি ভাবাকে হিংসে করে যাওয়া, তাঁকে টক্কর দিয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার চেষ্টা, তাঁর পথে বাধা সৃষ্টি করা। সিরিজ়ের একেবারে শেষে গিয়ে মেহেদি আর ভাবা-র পারস্পরিক শ্রদ্ধার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। বাস্তবে, সাহা আর ভাবা-র পারস্পরিক শ্রদ্ধার একটি উদাহরণ দিই। ১৯৫৪ সালে ‘ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটমিক এনার্জি’-র সেক্রেটারি ভাবা, সাহার গবেষণা কেন্দ্রের জন্য ৫০ লক্ষ টাকা অনুদান দেওয়ার প্রস্তাব দেন, এবং সাহা তা গ্রহণ করেন। জওহরলাল নেহরুর প্রিয়পাত্র ভাবা অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন (এইসি)-এর সভাপতি হওয়ায় মেঘনাদ সাহা খুশি ছিলেন না ঠিকই। এই কমিশন নিয়ে সমালোচনামূলক মন্তব্যও করছেন তিনি। কিন্তু তাঁর মাপের এক জন মানুষের এই ধরনের সঙ্কীর্ণতা থাকা কি সম্ভব, যা এই সিরিজ়ে দেখানো হয়েছে? এ কি তাঁর চরিত্রের চরম অবমাননা নয়? প্রসঙ্গত, গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে নমশূদ্র পরিবারে জন্মানো এক বিজ্ঞানী, সাহার সাফল্যের লড়াই কিন্তু কোনও ভাবেই অভিজাত পার্সি পরিবারে জন্মানো হোমি ভাবার সঙ্গে তুলনীয় নয়।
হোমি ভাবা আর মেঘনাদ সাহা পদার্থবিদ্যার দুই স্তম্ভ। একটি রোমাঞ্চকর সিরিজ় বানানোর লক্ষ্যে নায়ক হোমি ভাবা-র মহত্ত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাকে খাটো করা সিরিজ়-নির্মাতার ব্যর্থতারই পরিচায়ক। রকেট বয়েজ় ওয়েব-সিরিজ়ের দ্বিতীয় সিজ়ন এবং মেঘনাদ সাহার ১২৯তম জন্মদিন আসার প্রাক্কালে এই মহান বাঙালি পদার্থবিদের এ-হেন অবমাননার প্রতিবাদ জানালাম এক জন বাঙালি, ভারতীয় ও বিজ্ঞানের ছাত্রী হিসেবে।
স্বাগতা দাশগুপ্ত, কলকাতা-৬৪
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy