সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে যশোধরা রায়চৌধুরীর ‘কবিতা যে নিজেই রাজনীতি’ (৭-৯) শীর্ষক প্রবন্ধে স্বাভাবিক ভাবেই এসেছে কৃত্তিবাস প্রসঙ্গ। বাংলা কবিতার ইতিহাসে বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকার পর কৃত্তিবাস অবশ্যই একটি মাইলস্টোন। কৃত্তিবাস যদিও নিরবচ্ছিন্ন ভাবে সুনীলের একক সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়নি, কৃত্তিবাস-গোষ্ঠীর বিভিন্ন কবিরা বিভিন্ন সময়ে সম্পাদনার দায়িত্ব সামলেছেন, তবুও বাংলা কবিতা পাঠকের স্মৃতি ও চেতনায় সুনীল ও কৃত্তিবাস প্রায় অভিন্ন। কৃত্তিবাসী কবিদের ‘রাজনৈতিক কবিতা লেখার পথে’ না যাওয়ার কথা লিখেছেন যশোধরা। দলীয় রাজনীতির সঙ্কীর্ণ পথটির কথাই বোঝাতে চেয়েছেন তিনি। কারণ লেখার শুরুতেই দেওয়া সুনীলের উদ্ধৃতিটি, ‘আমরা চেয়েছিলাম এস্টাবলিশমেন্টের দখল নিতে’, রাজনীতির ভাষাতেই কথা বলে, যদিও তা কোনও রাজনৈতিক দলের রঙে চোবানো রাজনীতি নয়। ক্ষমতা দখলের লড়াই যদি রাজনীতির লক্ষ্য হয়, তবে তা চলেছে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। কবিতার ইতিহাসও তার ব্যতিক্রম নয়। সুনীলের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতামত এখানে বিচার্য নয়। প্রবন্ধটি পড়ে আবারও মনে হল কৃত্তিবাস-এর ‘রাজনীতি’ কত বেশি অভিনিবেশ দাবি করে।
১৯৯২ সালে যখন মিহির রায়চৌধুরীর ‘ষাটের দশকের কৃত্তিবাস’ প্রকাশিত হয়, তখন তার ভূমিকা লিখেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সেখানে তিনি আর এক বার কৃত্তিবাস-এর জন্মলগ্নটির দিকে ফিরে তাকান ও সেখানে অবধারিত ভাবে আসে রাজনীতির প্রসঙ্গটি: “দল-মত নির্বিশেষে কথাটা আমাদের ক্ষেত্রে খাঁটি ছিল। বামপন্থী দক্ষিণপন্থী বলে কিছুই ছিল না, কবিতা বিষয়ে কোনও ফতোয়া দেওয়া হয়নি।” স্পষ্টতই কোনও পার্টির ছত্রছায়ায় থাকেনি কৃত্তিবাস। তার পরই সুনীল লিখছেন, “তবে এক ধরনের প্রতিবাদ, ব্যক্তিগত দুঃখ ও সামাজিক অবিচারকে পাশাপাশি রাখা, ফর্ম নিয়ে পরীক্ষা, এইগুলি ছিল সাধারণ লক্ষণ।” ‘প্রতিবাদ’, ‘ব্যক্তিগত দুঃখ’ ও ‘ফর্ম’-এর কথা এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করে সুনীল বুঝিয়ে দিলেন তাঁদের আন্দোলনের চরিত্রটিকে। শুধু টালমাটাল সময়ের বর্ণনা নয়, শুধু ব্যক্তিগত দুঃখের কাহিনি নয়, ফর্মের নিরালম্ব পরীক্ষানিরীক্ষা নয়। এরা পরস্পরে অনুস্যূত; ‘ভাষাগত দায়বদ্ধতা’ তাই বৃহত্তর অর্থে ‘রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা’রই এক রূপ।
তীর্থঙ্কর দাশ পুরকায়স্থ, কলকাতা-৪৭
রাজনৈতিক?
‘কবিতা যে নিজেই রাজনীতি’ লেখাটি সম্পর্কে এই চিঠি। প্রবন্ধটির শেষে যশোধরা রায়চৌধুরী লিখেছেন, “বড় বাণী বা আদর্শের ব্যবহারের জন্য কবিতা নয়, কবিতা যে নিজেই রাজনীতি।” তাঁর এই বক্তব্য মনে করিয়ে দেয় যে, কৃত্তিবাস পত্রিকাটি রাজনৈতিক কবিতার পথে না গিয়ে নিজেই কী ভাবে রাজনীতি হয়ে উঠেছিল। কোনও কোনও কাব্য সমালোচকের মতে, কবিতার সঙ্গে রাজনীতির সহাবস্থান থাকতে পারে না, কারণ ঐতিহ্যগত ভাবে কবিতার সংজ্ঞার মধ্যে বা তার অনুষঙ্গরূপে রাজনীতি অন্তর্ভুক্ত নয়। এ এল ফ্রেঞ্চ তাঁর ‘স্টাডিজ় ইন ইংলিশ লিটারেচার: রেস্টোরেশন অ্যান্ড এইটটিন্থ সেঞ্চুরি’ প্রবন্ধে দাবি করেছেন যে, ইংরেজ কবি জন ড্রাইডেন তাঁর কবিতায় যে প্রশংসা পেয়েছেন, তার বেশির ভাগটা রাজনৈতিক বার্তার কারণে, কবিতার উৎকর্ষের জন্য নয়। ফ্রেঞ্চের যুক্তি, আক্ষরিককে (রাজনীতি) অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াস দেখা যায় রাজনৈতিক কবিতায়, যা কবিতার নির্মাণে কল্পনা ও বিচিত্র অবাস্তবতার বিনাশ ঘটায়। রাজনৈতিক বিষয়বস্তু এবং কাব্যিক অবয়ব আসলে সাহিত্য ও প্রোপাগান্ডার কেন্দ্রবিন্দুতে বর্তমান।
রাজনৈতিক কবিতা অবশ্য প্রায় সব দেশেই লেখা হয়ে আসছে। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তার বিচার হয়। পাঠকদের মতে রাজনৈতিক কবিতা রাজনীতির দৃশ্যরূপকে প্রকাশ ও বহন করে, যা কবিতাটি কী ভাবে পড়া হবে তার রূপরেখা স্থির করে। পাঠক বা শ্রোতার কাছে কোনও কবিতা ‘রাজনীতি-ঘেঁষা’ মনে হতে পারে, যদিও তার লেখক হয়তো আদৌ কোনও রাজনৈতিক বার্তা বা মূল্যবোধের কথা ভেবে কবিতাটি রচনা করেননি।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি বলেছিলেন, “যদি আরও বেশি রাজনীতিক কবিতা জানতেন, এবং আরও বেশি কবি রাজনীতি জানতেন, তা হলে পৃথিবীটা যে আরও বেশি বাসযোগ্য হত, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।” পাঠকের অভিজ্ঞতা ও আবেগকে ছুঁতে পারা কবিতার কাজ। অন্য দিকে রাজনীতি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শ্রোতা ও দর্শকদের মধ্যে প্রত্যয় বা বিশ্বাস জাগায়। এই দু’ধরনের আইডিয়া রাজনৈতিক কবিতায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে এমন কিছু সৃষ্টি করে, যা পাঠক বা শ্রোতাদের প্রভাবিত করার সঙ্গে কবিতার মূল বিষয়বস্তু সম্পর্কে তাদের প্রত্যয়িত করে। বিশ্ববিখ্যাত কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস বিশ্বাস করতেন, “বাক্কুশলতার (রেটোরিক) শিকড় অন্যের সঙ্গে আমাদের বোঝাপড়ায়, আর কবিতার উৎস আমাদের নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়ায়।”
প্লেটো কবিদের রিপাবলিক থেকে নির্বাসিত করতে চেয়েছিলেন, কারণ কবিরা মিথ্যাকে সত্যের মতো গড়ে তুলতে পারেন। অন্য দিকে, পার্সি বিশ শেলি মনে করতেন কবিরা হলেন ‘বিশ্বের স্বীকৃতিবিহীন আইনপ্রণেতা’ (পোয়েটস আর দ্য আনঅ্যাকনলেজড লেজিসলেটর্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড)।
আজকের দিনে রাজনৈতিক কবিতা কাকে বলা হবে? কবিরা কী ভাবে সংবাদ ও তথ্য, মতামত ও বোধ, দর্শন ও নন্দনতত্ত্বের মধ্যে ভারসাম্যকে উপলব্ধি করবেন, ও অভিজ্ঞতায় জারিত করে বর্ণনা করবেন, তা নির্ধারণ করবে, কী ভাবে আমরা একটা কবিতা পড়ি, এবং সেই কবিতা আমাদের আদৌ ‘রাজনৈতিক’ মনে হয় কি না।
মনোজ ঘোষ, কলকাতা-৬১
মধ্যমণি
যশোধরা রায়চৌধুরীর প্রবন্ধে ধরা পড়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কৃত্তিবাস পত্রিকার জন্মলগ্নের ইতিহাস ও তার ধারাবাহিকতার উন্মেষ। কলেজে পড়াকালীন সুনীলের স্বীকারোক্তি— “কলেজে সদ্য ভর্তি হয়ে আমি খাতার পর খাতা কবিতা লিখে ভরিয়ে দিয়েছিলাম। সেগুলি ছাপার জন্য কোথাও পাঠাইনি— মনে হত এগুলি আমার একান্ত নিজস্ব, লোকচক্ষুর গোচরে এলেই এদের পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যাবে।” পরে কৃত্তিবাস-কে কেন্দ্র করে শুরু করেছিলেন তাঁদের যাত্রা। চলমান নদী যেমন খাত পরিবর্তন করে, তেমনই তাঁদের কবিতা স্বতন্ত্র পথের ঠিকানা পেতে ‘নরম ডানায় আগুন’ ছড়াতে পেরেছিল। আগে ও পরের মাঝে একটা দেওয়াল তুলে দিয়েছিল। সুনীলের স্বীকারোক্তি, “এক হিসেবে কৃত্তিবাসের মূল্য ঐতিহাসিক। কারণ, এখানে ভবিষ্যৎ বাংলা কবিতার গতিপথের চিহ্ন রইল।” এই গতিপথেই উঠে এলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, তারাপদ রায়, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, কবিতা সিংহ, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়; শুরু হল তাঁদের যৌথযাপন। আর এঁদের মধ্যমণি হয়ে বিরাজ করলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
পঞ্চাশের মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং দ্বিখণ্ডিত স্বাধীনতায় ছিন্নমূল মানুষের ঢল নেমেছিল বঙ্গ জুড়ে। আর এমনই বিধ্বস্ত পরিমণ্ডলের আগুনে তাঁরা ঝলসে উঠলেও সমকালের রাজনীতির দায়বদ্ধতা থেকে বড় হয়ে উঠেছিল ভাষাবদলের দায়বদ্ধতা। দু’পার বাংলার কবিকুলের যৌথ প্রয়াসে রচিত হয়েছিল এক স্বতন্ত্র দিকবলয়। সুনীল দেখেছেন, “ধানক্ষেতে চাপ চাপ রক্ত/ এইখানে ঝরেছিল মানুষের ঘাম/ এখনো স্নানের আগে কেউ কেউ করে থাকে নদীতে প্রণাম।/... যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো/ আমি বিষ পান করে মরে যাব।” নবীন পাঠক-পাঠিকা আজও সুনীলের কবিতার রহস্যময়তায় বুঁদ হয়ে আছেন। তাঁর ৯০তম জন্মদিবসে আমাদের প্রার্থনা, “তুমি একটু কেবল বসতে দিয়ো কাছে...”।
সূর্যকান্ত মণ্ডল, কলকাতা-৮৪
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy