‘শ্রীসুব্রত মুখোপাধ্যায় (১৯৪৬-২০২১)’ (৬-১১) শীর্ষক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, “তবে এও ঠিক, দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ‘সুযোগ’-এর স্বার্থে ভারসাম্যের খেলা খেলেছেন অনেক। কখন কোথায় ব্যক্তিগত ভাবে ‘লাভবান’ হতে পারবেন, হিসাব কষেছেন অবিরত।” ভারসাম্যের খেলায় সুযোগের অপর পিঠে থাকে হিসাবের প্রয়োজনীয়তা। এই দুইয়ের দ্বন্দ্বকে দারুণ কাজে লাগিয়েছেন সুব্রত। ব্যক্তিগত রাজনৈতিক জীবনে সুব্রত মুখোপাধ্যায় সফল। কিন্তু সামগ্রিক রাজনৈতিক জীবনের হিসাবের আগে আসে দল, দেশ। ব্যক্তি থাকে এর মধ্যেই। সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের জীবন এই সামগ্রিক রাজনীতিতে ব্যর্থ।
হয়তো আজ ব্যক্তিস্বার্থের আগে রাজনীতিকে স্থান দেওয়া অরাজনৈতিক কষ্টকল্পনামাত্র। ১৯৬০-৭০ কালে পশ্চিমবঙ্গে ছাত্র রাজনীতিতে বামপন্থীদের উত্থানের বিপরীত মেরুতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে সংগঠিত ও গঠনমূলক রূপ দিতে পারত ‘প্রিয়-সুব্রত ম্যাজিক’। কিন্তু বামপন্থী ছাত্র-যুব সংগঠনগুলির সমর্থক ও সদস্যদের প্রতি তাঁদের নিষ্ঠুরতা রাজনীতির এক অসামাজিক রূপ সামনে নিয়ে এল। রাজনীতির হিংস্রতা এবং মেরুকরণের ফলে বাংলার সমাজ আক্রান্ত হল আত্মঘাতী গৃহযুদ্ধে। ইমার্জেন্সির সময়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী, মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় কার্যত এক লাইনে ব্যক্তিগত হিসাব কষেছেন। এতে পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন কংগ্রেস তো বটেই, ভারতের জাতীয় কংগ্রেস তথা ভারতের জাতীয় রাজনীতির ক্ষতি হয়েছে। বামপন্থীদেরও ক্ষতি হয়েছে মারাত্মক ভাবে।
জাতীয় কংগ্রেসে থেকেই দিল্লির হাই কমান্ডের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের অনেক কংগ্রেস নেতা বিদ্রোহ করেছেন। প্রিয়-সুব্রত কংগ্রেস ভাঙেননি। সুব্রত মুখোপাধ্যায় হিসাব কষছিলেন। কারণ, এর মাঝেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভেঙে আঞ্চলিক তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি হল। জাতীয় কংগ্রেস দুর্বল হল। কিন্তু আঞ্চলিক তৃণমূল কংগ্রেস ক্রমশ সবল হল। সুব্রত জাতীয় কংগ্রেসে থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এগিয়ে দিলেন। প্রিয়-সুব্রত যা করতে পারেননি, তা করল সুব্রত-মমতা রসায়ন। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট তথা সিপিআই(এম)-এর ৩৪ বছরের নিরঙ্কুশ আধিপত্য খর্ব করে আজ একটানা ১৫ বছর রাজত্ব করছে তৃণমূল কংগ্রেস। এই অভাবনীয় সাফল্য উড়িয়ে দিতে পারল না জাতীয় কংগ্রেসের দিল্লির হাই কমান্ড। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই পর্বের পরিচালক হলেও, চিত্রনাট্য যাঁরা লিখেছেন তাঁদের অন্যতম সুব্রত। মনে রাখতে হবে, নারদ তদন্ত থেকে তাঁর নাম বাদ গেল মৃত্যুর কারণে। মাস কয়েক আগে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল বেআইনি আর্থিক লেনদেনের অভিযোগে।
টাকা নেওয়ার ছবি, চার্জশিটে নাম থাকার কলঙ্ক, সব থেকে গেল ইতিহাসে। ‘কথায় বেপরোয়া, চিরযৌবনের প্রতিনিধি’ মূল্যায়ন সান্ত্বনা মাত্র।
শুভ্রাংশু কুমার রায়
চন্দননগর, হুগলি
বর্ণময়
সুব্রত মুখোপাধ্যায় রাজনীতি ছাড়াও বিভিন্ন দিকে বহু উল্লেখযোগ্য কাজের স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন। যেমন, বাংলার লোকশিল্প যাত্রাজগতের উন্নতিকল্পে ও সুষ্ঠু প্রসারের জন্য তাঁর অবদান এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত অগণিত মানুষ কোনও দিন ভুলবে না। সত্তরের দশকে তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী হিসাবে তিনি অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেন সংস্কৃতি জগতে। যাত্রাজগতের উন্নতিবিধানে তিনি একগুচ্ছ সদর্থক পরিকল্পনা গ্রহণ করে মুমূর্ষু যাত্রাজগৎকে প্রাণবায়ু জুগিয়েছিলেন। তা ছাড়া গ্রুপ থিয়েটারের প্রেক্ষাগৃহ ব্যবহারের ক্ষেত্রে নির্ধারিত প্রমোদ করে বিরাট ছাড় ঘোষণা করেছিলেন। সেই সময় মাত্র ১ টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে গ্রুপ থিয়েটারের নাটক মঞ্চস্থ হতে পেরেছে শুধুমাত্র তাঁর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। সুস্থ সংস্কৃতির অনুরাগী এই বর্ণময় ব্যক্তিত্বকে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করি।
চন্দন দাশ
নাট্য সম্পাদক, শৌভনিক
ভদ্রতার দৃষ্টান্ত
চলে গেলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। অনেকে হয়তো ভাবছেন, তাতে কী-ই বা ক্ষতি হল! সপ্রতিভ হলেও, ৭৫ বছর বয়স তো হয়েছিল। ছিলেন তো পঞ্চায়েত দফতরের মন্ত্রী, এমন কিছু গুরুদায়িত্বও পালন করতেন না। দলের হয়ে খুব যে প্রচারে বা সামনে আসতেন, তা-ও নয়। কিন্তু ব্যাপারটা এ রকম নয়। তাঁর মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি হল। ক্ষতি হল বাঙালির, বাঙালির পরিচয়ের। আমি এক জন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ নাগরিক, যদি এখন কোনও রাজনৈতিক দল নিরপেক্ষতা সম্ভব বলে বিশ্বাস করে না। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এমন জায়গায় চলে গিয়েছে, কোনও দলের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বা ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে কেউ সমালোচনা করলেই সে বিরোধী দলের লোক বলে চিহ্নিত হয়ে যাবে, আর প্রশংসা করলেই সেই দলের লোক বলে দাগ লেগে যাবে। তা-ও বলব, সুব্রতবাবুর চলে যাওয়া তাঁর দলের ক্ষতি কি না, তা দলের নেতারাই বলতে পারবেন, কিন্তু সাধারণ নাগরিকের ক্ষতিটাও স্বীকার করে নিতে কোনও দ্বিধা নেই। গত বিশ-পঁচিশ বছর যাবৎ রাজনৈতিক নেতারা সর্বসমক্ষে যে ভাষায় কথাবার্তা বলছেন, তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা চলছে এবং চলাই উচিত। তবে এ ব্যাপারে সুব্রতবাবু ছিলেন ব্যতিক্রম। সুব্রতবাবু চলে গেলেন, সঙ্গে চলে গেল ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত ভদ্রলোক বাঙালি মন্ত্রীর সেই ভাবমূর্তি।
একটা প্রচলিত কথা বাংলায় চালু আছে, মৃত ব্যক্তির নিন্দা করতে নেই। প্রশংসা করতে কোনও অসুবিধা নেই। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সুব্রতবাবুর নিন্দা কম হয়নি। ১৯৭২ সালে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মন্ত্রিসভায় পুলিশমন্ত্রী হয়ে প্রিয়-সুব্রতর নকশাল দমনের রসায়ন, বিভিন্ন সময় সুযোগ বুঝে দলবদল, শিক্ষাঙ্গনে অবাধ নকল করার ছাড়পত্র, সিপিএম-এর সঙ্গে গোপন ঘনিষ্ঠতার জন্য ‘তরমুজ’ পরিচিতি, নারদা মামলায় জড়িয়ে পড়া ইত্যাদি নানা অভিযোগ উঠেছে। তবে এক সময়ে ইন্দিরা গাঁধীর প্রিয়পাত্র হয়েও, তাঁর গুরু প্রিয়রঞ্জন দিল্লি গেলেও, সুব্রতবাবু রাজ্য রাজনীতি ছেড়ে, কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে যাননি। নিজের দুর্বলতা বুঝতেন, যা দূরদর্শিতার শিক্ষণীয় নিদর্শন।
প্রশাসক হিসাবে তিনি যথেষ্ট সফল। ২০০১-২০০৫ মেয়র হিসাবে কলকাতা পুরসভার সম্পূর্ণ ভোল বদলে দেওয়া বোধ হয় তাঁর সেরা কৃতিত্ব, যা নিয়ে লিখেছেন আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় (‘স্বাতন্ত্র্য দিয়েছিলেন অফিসারদের’, ৬-১১)। আমি বাবার ডেথ সার্টিফিকেট পেতে আবেদন করে সুফল পেয়েছি। সর্বান্তঃকরণে বাঙালিদের রক্ষায় সচেষ্ট বাঙালি, সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য, এমন দক্ষ প্রশাসক আজ বিরল।
সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা-৫৭
অজানা রইল
দীপাবলির রাতে অন্ধকারময় দুঃসংবাদ এল (‘দীপ নিভল সুব্রতের’, ৫-১১)। বাংলার রাজনীতির উত্তাল সময়ের দিনগুলো থেকে হাল আমলের সংসদীয় গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো— এই সুবিস্তৃত প্রেক্ষাপটে কখনও সরকার, কখনও বিরোধী পক্ষের অংশ ছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তাঁর চলে যাওয়ায় তাই ইতিহাসের একটি অধ্যায় শেষ হল। এই প্রসঙ্গে এক অতি বিতর্কিত পর্বের কথা মনে করাই। বাঙালির আবেগ-জড়ানো ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানটি সরিয়ে ‘দেবী দুর্গতিনাশিনী’ নামে নক্ষত্রখচিত এক আলেখ্য ১৯৭৬ সালে, অর্থাৎ জরুরি অবস্থায় সম্প্রচারিত হয়েছিল, যা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। ওই সময়ে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মন্ত্রিসভার তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের মন্ত্রী ছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তাঁর চলে যাওয়ার ফলে মহালয়ার ভোরের ওই অনুষ্ঠানের পরিবর্তনের কারণ চিরতরে অধরা রয়ে গেল। বেঁচে থাকলে হয়তো স্বভাবসুলভ হাসিঠাট্টায় ইতিহাসের সেই বিবর্ণ পাতায় আলো ফেলতেন।
অঞ্জন কুমার শেঠ
কলকাতা-১৩৬
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy