Advertisement
১৭ অক্টোবর ২০২৪
Contractual Staffs

সম্পাদক সমীপেষু: কেন এত পুনর্নিয়োগ?

পাবলিক সার্ভিস কমিশন প্রায় অস্তিত্বহীন। বাম জমানায় প্রতি বছরই সরকারি কর্মচারী নিয়োগের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা নেওয়া হত পিএসসি-র মাধ্যমে।

শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০২৪ ০৫:৫৪
Share: Save:

তূর্য বাইন তাঁর ‘চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে নানা প্রশ্ন’ (২৪-৯) প্রবন্ধে যথার্থই উল্লেখ করেছেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ও অবসরপ্রাপ্তদের পুনর্নিয়োগ স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও দক্ষ প্রশাসনের পরিপন্থী। অথচ, রাজ্যে আজ এটাই বাস্তব। পাবলিক সার্ভিস কমিশন প্রায় অস্তিত্বহীন। বাম জমানায় প্রতি বছরই সরকারি কর্মচারী নিয়োগের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা নেওয়া হত পিএসসি-র মাধ্যমে। প্রবন্ধে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে নির্দিষ্ট যে ক’টি পদের উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো বেশির ভাগটাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, এবং কোনওটাই পূর্ণ সময়ের পদ বলে তখনও স্বীকৃতি লাভ করেনি। যদিও এই অজুহাতে তৎকালীন সরকার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের অভিযোগ এড়িয়ে যেতে পারে না।

তবে বর্তমানে চিত্রটা সম্পূর্ণই আলাদা। বিভিন্ন সরকারি দফতরে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের রমরমা। সিভিক ভলান্টিয়ারদের নিয়োগ নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। বর্তমান সরকারের ১৩ বছরের মেয়াদকালের মধ্যে ইতিমধ্যেই পাঁচ জন অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য সচিবকে পুনর্নিয়োগ করা হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর বিভিন্ন পরামর্শদাতা হিসাবে। এ ছাড়াও অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস এবং সরকারি অফিসারদের পুনর্নিয়োগে প্রশ্ন উঠেছে— শুধুমাত্র তাঁদের কর্মদক্ষতা ও অভিজ্ঞতা, না কি কর্মজীবনে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি আনুগত্য, কোনটা পুনর্নিয়োগের প্রকৃত শর্ত? শুধুমাত্র নবান্ন বা সরকারি বিভিন্ন দফতরে নয়, বর্তমানে রাজ্যে সরকার পোষিত বা অধিগৃহীত সংস্থা ও বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পেও অবসরপ্রাপ্তদের নিয়োগ একটা অভ্যাসে পর্যবসিত হয়েছে। এর জন্য নতুন কর্মপ্রার্থীদের নিয়োগ অবহেলিত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই নতুন কর্মী নিয়োগের থেকেও বেশি অর্থ খরচ করে নিয়োগ করা হচ্ছে অবসরপ্রাপ্তদের। অথচ, অতিরিক্ত মুখ্যসচিব পদমর্যাদার অনেক সিনিয়র অফিসারকে নাকি ঠেলে রাখা হয়েছে তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ দফতরে। এই ধরনের নিয়োগে রাশ টানতে পারলে, এক দিকে যেমন অনাবশ্যক সরকারি খরচ কমানো যাবে, তেমনই তা সহায়ক হবে আগামী প্রজন্মের আস্থা অর্জনে।

অশোক দাশ,রিষড়া, হুগলি

সুরক্ষার ঠিকা

আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে কর্মরত অবস্থায় ডাক্তার-ছাত্রীর নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড ঘিরে সুপ্রিম কোর্টে যে বিচার চলছে, তাতে চিকিৎসকদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগের ব্যাপারে রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন বিচারপতিরা। এর যুক্তিসঙ্গত নানা কারণ আছে। এমনিতেই স্থায়ী-প্রকৃতির কাজে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ করা যায় না। কিন্তু ব্যয়সঙ্কোচকে সর্বত্র পাখির চোখ করার কারণে শিক্ষিত, যোগ্য যুবক-যুবতীদের স্বল্প পারিশ্রমিকে খাটিয়ে নেওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে সর্বত্র। চুক্তিভিত্তিক কর্মী ছড়িয়ে পড়েছে সরকারি-বেসরকারি প্রায় সমস্ত কর্মস্থলের নানা ক্ষেত্রে।

আর জি কর কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, নিরাপত্তায় ঠিকাকর্মী কেন? এখন বেশির ভাগ কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা কর্মীরা হলেন ঠিকাকর্মী। নিরাপত্তার জন্য ঠিকা নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ করে নিরাপত্তাকে যে সুনিশ্চিত করা সম্ভব নয় তা কেবল হাসপাতাল নয়, সব ক্ষেত্রেই কম-বেশি সত্য। প্রায় সমস্ত সরকারি অফিস, রেল, ব্যাঙ্ক, বিদ্যুৎ, ইস্পাত, কয়লা, এমনকি প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও ক্রমবর্ধমান চুক্তিভিত্তিক কর্মী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতেও আজকাল চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের উপস্থিতি। ব্যাঙ্কের উদাহরণই ধরা যাক। ব্যাঙ্কে কেবল নিরাপত্তা রক্ষী নয়, চতুর্থ শ্রেণির কর্মী, পরবর্তী পর্যায়ে তৃতীয় শ্রেণির কর্মী, এমনকি আধিকারিকদের একাংশকেও চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ করা হচ্ছে। ব্যাঙ্কের এটিএম থেকে শুরু করে বিভিন্ন শাখার টাকার ভল্ট, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় মোটা অঙ্কের টাকা পরিবহণের সময়, সোনাদানা গচ্ছিত রাখার লকারের নিরাপত্তার দায়িত্বও দিনে দিনে স্থায়ী কর্মীদের হাত থেকে বাইরের ঠিকাদারদের অধীনে কর্মরত ঠিকাকর্মীদের হাতে ন্যস্ত হচ্ছে। লক্ষ্য, খরচ কমানো।। ‘সম কাজে সম বেতন’ নীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে স্থায়ী কর্মীদের তুলনায় অনেক কম বেতনে কাজ করতে বাধ্য করা হয় এই ঠিকাকর্মীদের। কোথাও কোথাও বাধ্য করা হয় ৮ ঘণ্টার জায়গায় ১২-১৪ ঘণ্টা কাজ করতেও।

এই নিরাপত্তা কর্মীদের চাকরির নিরাপত্তা বলতে কিছু নেই। যখন-তখন চাকরি চলে যাওয়ার ভয় তো আছেই, তার সঙ্গে ন্যায্য, ন্যূনতম মজুরিও বিভিন্ন কারণে পাওয়া যায় না। ইউনিয়ন করলে বা কোনও অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে শ্রম আদালতের দ্বারস্থ হলেও বিভিন্ন দিক থেকে ‘হুমকি’-র মুখে পড়তে হয়। অধিকাংশ ঠিকাদার ‘ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না’ ভাবনাকে সযত্নে লালন-পালন করেন। দায়বদ্ধতার তারতম্যের কারণে এর পরিণামও মন্দ হতে বেশি সময় নেবে না। এ সব যে সীমাহীন দুর্নীতি এবং জনসাধারণের দুর্ভোগের উৎস, তা নিবন্ধেই উল্লেখ করা হয়েছে। সে কারণে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেই জনকল্যাণে ও প্রকৃত নিরাপত্তার স্বার্থে বর্তমান ঠিকাকর্মীদের যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষার মাধ্যমে স্থায়ী কর্মীতে রূপান্তরিত করার কাজটি খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, এমনকি অবসরপ্রাপ্তদের পুনরায় নিয়োগ স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও দক্ষ প্রশাসনের পরিপন্থী বলে যে যুক্তি বিভিন্ন মহল থেকে তোলা হচ্ছে, তাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

গৌরীশঙ্কর দাস, সম্পাদক, আইডিবিআই ব্যাঙ্ক কন্ট্র্যাক্ট এমপ্লয়িজ় ইউনিয়ন, পশ্চিমবঙ্গ

চুক্তি-বিপত্তি

‘চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে নানা প্রশ্ন’ প্রসঙ্গে বলতে চাই, চুক্তিতে নিয়োগের সমস্যা অনেক। এক, সাধারণত শাসকের অনুগতরা এর সুবিধা পেয়ে থাকেন। ফলে এই কর্মীরা সচরাচর দায়বদ্ধ, দায়িত্বশীল হন না। কাজে ফাঁকি দেওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। দ্বিতীয়ত, সামান্য বেতন, এবং স্থায়ী কর্মীদের সঙ্গে বেতন-বৈষম্যের জেরে চুক্তিকর্মীদের একাংশকে দুর্নীতির আশ্রয় নিতে দেখা যায়। শিক্ষা, খাদ্য ও স্বাস্থ্যের সঙ্গে যাঁরা ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে পড়েছেন, তাঁরা অধিকাংশই চুক্তিভিত্তিক কর্মী। তৃতীয়ত, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, দফতরে আসা-যাওয়ার উপরেও কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব থাকে না। মাথায় শাসকের হাত থাকে বলে ক্ষেত্রবিশেষে এঁরাই কর্তৃত্ব করেন। এঁদের দুর্বিনীত নজরদারি দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তারই দৃষ্টান্ত আর জি কর হাসপাতাল। চতুর্থত, চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের সঙ্গে স্থায়ী কর্মীদের সম্পর্ক প্রায়ই পৌঁছয় তলানিতে। স্থায়ী কর্মীরা প্রায়ই মনে করেন, চুক্তিকর্মীরা শাসকের দূত, দফতরের ভিতরের সংবাদ যথাসময়ে শাসককে দিচ্ছেন। এই অবস্থায় কাজের পরিবেশ বিঘ্নিত হয়।

সূর্যকান্ত মণ্ডল, কলকাতা-৮৪

খেসারত

তূর্য বাইনের প্রবন্ধটি পড়ে মনে পড়ল চুক্তিতে কর্মী নিয়োগের ফলে ঝকমারির একটি খবরের কথা। ঘটনাটি ঘটে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে। রাশিয়ার ইয়েলৎসিন সেন্টার শিল্প সংগ্রহশালায় ছবি দেখতে গিয়ে দুই দর্শক লক্ষ করেন, শিল্পী আনা লেপর্সকায়ার ‘থ্রি ফিগার্স’ তৈলচিত্রে তিনটি চোখ-নাক-ঠোঁটহীন অবয়ব দু’টির মুখে কে যেন পেন দিয়ে চোখ এঁকে রেখেছে। কর্তৃপক্ষকে জানাতে তাঁরা অনুসন্ধান করে জানতে পারেন, এ হল চুক্তিতে নিয়োজিত এক নিরাপত্তা রক্ষীর কাজ। বল পয়েন্ট পেন দিয়ে তিনি তৈলচিত্রে কলম চালান। একটি বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থার মাধ্যমে তাঁকে নিয়োগ করা হয়েছিল। তৈলচিত্রটি মেরামত করতে মিউজ়িয়মকে তিন হাজার ডলারেরও বেশি খরচ করতে হয়েছিল।

রুমেলা মিত্র,কলকাতা-৬৮

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE