Advertisement
২১ নভেম্বর ২০২৪
Bengali Language

সম্পাদক সমীপেষু: বাংলাও ধ্রুপদী

বাংলা ভাষা স্বাধীন ও স্বাবলম্বী। বাংলা ভাষার মাতৃস্থানীয় ভাষা নিয়ে বিতর্ক থেকেই গেছে। এক সময় সংস্কৃত ভাষাকে বাংলা ভাষার জননী বলা হত। বর্তমান কালে ভাষাতত্ত্ববিদগণ তা মানতে রাজি নন।

শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:৩৭
Share: Save:

ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা লাভ করেছিল সংস্কৃত, তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালয়ালম এবং ওড়িয়া। আরও কিছু ভাষাকে এই পর্যায়ভুক্ত করার দাবি উঠেছে। এ ব্যাপারে বাংলা ভাষার দাবি কোনও অংশে কম ছিল না।

বাংলা ভাষা ১৫০০ বছরেরও বেশি পুরনো। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও সুকুমার সেনের সূত্র ধরে বলা হয় যে, বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে দশম-দ্বাদশ শতাব্দীতে। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন ‘চর্যাগীতি’র কবিদের সময়কাল ধরে ড. শহীদুল্লাহ প্রমাণ করেছেন যে, চর্যার আদি কবি মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীননাথের সময়কাল সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়। অর্থাৎ, আনুমানিক ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ। তিনি বলেছেন, ‘পত্রসম্ভব’-এ উল্লেখ আছে শবরপা যখন তিব্বতে যান, তখন তাঁর সঙ্গে হে-দেউ-বচন রাজার সাক্ষাৎ হয়, যাঁর সময়কাল ছিল ৬০০-৬৫০ খ্রিস্টাব্দ বা তারও আগে থেকেই। সুকুমার সেন পরে আবার বলেছিলেন, “‘বিক্রোমোৰ্ব্বশী’ নাটকের অপভ্রংশ গানগুলি যদি সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর রচনা হইয়া থাকে, তাহা হইলে চর্যার গানগুলিও সেই সময়কালে পৌঁছাইতে পারে।” তাই ভারতীয় মানদণ্ডের প্রেক্ষাপটে বাংলা ভাষা ধ্রুপদী ভাষার দাবি করতেই পারে।

বাংলা ভাষা স্বাধীন ও স্বাবলম্বী। বাংলা ভাষার মাতৃস্থানীয় ভাষা নিয়ে বিতর্ক থেকেই গেছে। এক সময় সংস্কৃত ভাষাকে বাংলা ভাষার জননী বলা হত। বর্তমান কালে ভাষাতত্ত্ববিদগণ তা মানতে রাজি নন। পরিবর্তে তাঁরা সংস্কৃতকে বাংলার ভগিনীস্থানীয় ভাষা বলেই উল্লেখ করেছেন। এক সময় পূর্বাঞ্চলের ভাষা হিসাবে অসমিয়া-ওড়িয়া-বাংলা একই ভাষা-ভেদের অন্তর্গত ছিল। ক্রমে স্বতন্ত্র ভাষার মর্যাদা পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে গৌড়ীয় প্রাকৃতের পূর্বী শাখাজাত বাংলা ভাষার সহোদরা ওড়িয়া যদি ধ্রুপদী মর্যাদা পায়, তবে বাংলার দাবি অসঙ্গত ছিল না।

প্রথম এশীয়, প্রথম ভারতীয়, প্রথম বাঙালি কবি হিসাবে রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি-র জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তার পরেও এত দিন বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি না দেওয়াটাই ছিল বড় দুর্ভাগ্যের।

রমজান আলি,রাজবাটি, পূর্ব বর্ধমান

অপ্রতিরোধ্য

বাংলা ভাষা ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পেল। ‘...আ মরি বাংলা ভাষা!’ (৪-১০) শীর্ষক প্রতিবেদনটি পড়ে বাঙালি হিসাবে মনে হল, ‘আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে’!

উডস ডেসপ্যাচ বা মেকলে সাহেবের প্রস্তাবনায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কেরানি তৈরির লক্ষ্যে স্বতন্ত্র শিক্ষা বিভাগ আর ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন এ দেশে শুরু হলে ইংরেজ-ঘেঁষা বাঙালিরা সুযোগ পেলেন চাকরি বা কাজের ক্ষেত্রে। যাঁরা ইংরেজি ভাষাটা ভাল ভাবে জেনেছিলেন, তাঁরা মাতৃভাষা বা বাংলাটাকেও কখনও মন থেকে মুছে ফেলেননি বা পারেননি। নবজাগরণের সূচনা থেকেই সংস্কৃত, বাংলা প্রভৃতি দেশীয় ভাষার প্রতি অনুরাগ বাড়তে থাকাটা নিছক রাজনৈতিক ছিল না। এক দিকে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসাবে ইংরেজি, এবং অন্য দিকে বাংলার প্রতি অনুরাগ— দুই-ই প্রবহমান।

বাংলা ভাষা পৃথিবীর অনেক ভাষা থেকেই প্রয়োজনমতো সংশ্লেষণ করে নিজস্ব শব্দভান্ডারকে সমৃদ্ধ সঞ্জীবিত এবং ক্রম বহুজাতিকতার ঐক্যের মাধ্যম করে তুলতে লাগল। সূচিত হল তার বাক্য গঠনরীতির ক্রম রূপান্তর। বিদেশি পণ্ডিতরাও বাংলা ভাষা শিখে বাংলা সাহিত্য পাঠ করে বিদেশে তার প্রচার করতে লাগলেন। সেটা উইলিয়াম কেরির মতো স্থূল ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে নয়। আজ বাংলা ভাষায় সৃষ্টির দ্ব্যর্থহীনতা বিজ্ঞান, দর্শন প্রভৃতিতেও মান্যতা প্রাপ্ত। তাই এক সময়ে নতমস্তকে স্বীকৃতি দিতেই হল ভাষাটির বহুমুখী শক্তিকে। এখন দেখার, সার্বিক ব্যবহারে এই ভাষা কতটা আমরা অবলম্বন করতে পারি।

শান্তি প্রামাণিক,হাওড়া

গর্বের ভাষা

সম্পাদকীয় প্রবন্ধ ‘এ মণিহার’ (৬-১০)-এর পরিপ্রেক্ষিতে আমার এই চিঠি। ভারতবর্ষের ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি পেল আমাদের মাতৃভাষা। এই সংবাদ খুবই গর্বের। ১১টি ভাষার মধ্যে একটি হল আমাদের বাংলা। ধ্রুপদী ভাষার মাপকাঠি হিসাবে কোনও ভাষার দেড় থেকে দুই হাজার বছরের পুরনো প্রত্নপুরাণকে ধরা হয়। বাংলা ভাষার প্রাচীনত্ব নিয়ে অনুসন্ধান করে গবেষকরা দাবিপত্র পেশ করেন ২২০০ পৃষ্ঠার।

আমাদের বাংলা ভাষা সুইডিশ ন্যাশনাল এনসাইক্লোপিডিয়া-র হিসাবে বিশ্বের ১০০টি ভাষার মধ্যে সপ্তম, মানে সমস্ত ভাষাভাষীর সংখ্যা যদি গণনা করা যায়, তা হলে দেখা যাবে বাংলা ভাষার চেয়ে সংখ্যায় এগিয়ে মাত্র ছ’টি ভাষা।

একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপুঞ্জ যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করে, তার মূলেও বাংলার প্রতি ভালবাসা। এশিয়া মহাদেশে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান যে কবি, সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও সারা জীবন বাংলা ভাষাতেই লেখালিখি করেছেন। সমগ্র বিশ্বে এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নিয়েছে আমাদের বাংলা ভাষা।

আমাদের শান্তিপুরবাসীর কাছে বাংলা ভাষা আরও গর্বের। ষোড়শ শতাব্দীতে শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পর কয়েকটি প্রজন্ম ধরে নদিয়ার শান্তিপুরের বাচনভঙ্গিকে বাংলা ভাষার বাচন সৌন্দর্যের মাপকাঠি হিসাবে ধরা হয়।

কৌশিক চক্রবর্তী, শান্তিপুর, নদিয়া

পুজোর মিষ্টি

ষাট-সত্তরের দশকে দুর্গাপুজোর এমন ধুমধাম ছিল না। ছিল রীতি মেনে পুঁথি পড়ে পুজো। বিশেষত গ্রাম-গঞ্জে। সেই সময় অধিকাংশ পুজো ছিল পারিবারিক। কিন্তু অংশগ্রহণ ছিল সবার। ঘরে ঘরে মুড়কি তৈরি হত। বুটের মিঠাই, নারকেল নাড়ু, গুড়ের নাড়ু, গুড়পিঠে, চানার নাড়ু প্রত্যেকটি ঘরে তৈরি হত। ঠাকুমা, মা, দিদিদের হাতে তৈরি হত খাজা, গজা, খইয়ের নাড়ু, মন্ডা, বোঁদে। সে কী ব্যস্ততা। পুজো আসার বেশ কিছু দিন আগে থেকেই শুরু হত কাঠের উনুনে, মাটির খোলায় ধান থেকে খই ভাজা।

খই ভাজার পর ‘খইচালা’ নামক একটি বাঁশের খালুইয়ে ধানসুদ্ধ খই ঢুকিয়ে হাত দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ধান থেকে খই আলাদা করা হত। খইচালার কাজ ছিল ধানের খোসাগুলোকে বার করে দিয়ে খইগুলোকে পৃথক করা। তার পরেও ঘরের ছোট সদস্যদের লাগানো হত খইয়ে কোনও প্রকার ধান লেগে আছে কি না, তা দেখার জন্য। ধান লেগে থাকলে তাকে পৃথক করা হত। এর পর মাটির ‘খাপরি’-তে আখের শক্ত গুড় (ভেলিগুড়) আগুনের আঁচে বসিয়ে পাতলা পিটালি বা পাক তৈরি করা হত। সেই পাক ঠান্ডা হলে খইগুলোকে কাঠের লম্বা হাতা দিয়ে নাড়াচাড়া করে মাখিয়ে মুড়কি তৈরি করা হত। মুড়কির উপরে এলাচ বা কর্পূর মিশিয়ে সুস্বাদু করে তোলা হত। খুব মনে পড়ে গুড়পিঠের কথা। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চল পুরুলিয়া-বাঁকুড়াতে ভাদুপুজোর প্রাক্কালেই তৈরি হত সুস্বাদু এই ঘরে তৈরি মিষ্টি। মুড়কি ও গুড়পিঠে যখন গ্রাম-বাংলা জুড়ে তৈরি হত, তখন চার দিক মিষ্টি তৈরির গন্ধে ম-ম করত। এখন যেমন গুড়পিঠে তৈরি করতে বহু ধরনের উপকরণের কথা বলা হয়, তখন তা ছিল না। তখন গুড়পিঠে তৈরি করতে দেখেছি আতপচালের গুঁড়ি, আখের গুড় এবং সর্ষের তেল দিয়ে। আতপচালের গুঁড়ির সঙ্গে পরিমাণ মতো আখের গুড় মিশিয়ে পিটালি বা পিটুলি তৈরি করা হত। তাকে এক-দু’দিন রেখে, কড়াইয়ে সর্ষের তেল গরম করে তাতে পিটুলিকে লুই কেটে চ্যাপ্টা করে তেলে ছেড়ে দেওয়া হত। তেলে ফুটে লাল বর্ণ হলে ঝাঁঝরি করে তুলে একটি পাত্রে রেখে দেওয়া হত। দেখতে অনেকটা চপের মতো লাগে।

বর্তমান সময়ে দুর্গাপুজো বেশ জমজমাট হয়েছে। কিন্তু হারিয়ে যেতে বসেছে ঘরে ঘরে ভিয়েন বসিয়ে মুড়কি, গুড়পিঠে, বিভিন্ন ধরনের নাড়ু তৈরির সাবেক প্রথা।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়,এক্তেশ্বর, বাঁকুড়া

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Language Classical Language Bengali
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy