Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Letters to the Editor

সম্পাদক সমীপেষু: সাহিত্যে মেরুকরণ

নির্যাতিতা নারীজীবনের কথা সুনীলের উপন্যাসের নারী-চরিত্রগুলিতে ধরা পড়েছে। সেই সময়-এর বাল্যবিধবা বিন্দুবাসিনী মনের মানুষ গঙ্গানারায়ণকে পায়নি।

শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০২৪ ০৮:৩৭
Share: Save:

যশোধরা রায়চৌধুরীর প্রবন্ধ ‘সাহিত্যের নারী: দুই মেরু’ (৫-৫) পড়লাম। ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক মেরুকরণের পরে এই প্রথম সাহিত্যে মেরুকরণের কথা শুনলাম। ‘মুগ্ধতা আর ঘৃণা/ হিংসা’ বা ‘বনলতা আর উৎপলা’— বাংলা সাহিত্যের আকাশ সত্যিই কি এই দুই মেরুতে বিভক্ত? এই ভাবে নিজস্ব অনুভূতির সাধারণীকরণের মাধ্যমে প্রবন্ধকার কি সত্যিই ‘নারীবাদী আন্দোলন’-কে পুষ্ট করতে চান? যে নারীবাদী আন্দোলন বহু ভাগে বিভক্ত? এই বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা করে গিয়েছেন মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী বিপ্লবী এবং নারীবাদী (অরুন্ধতী রায়ের মতে) অনুরাধা গান্ধী তাঁর প্রবন্ধ সঙ্কলন স্ক্রিপ্টিং দ্য চেঞ্জ গ্রন্থে। সাহিত্যে পুরুষই কি শেষ কথা? বাংলা সাহিত্যের বাইরে বিদেশি এলিয়টকে বার বার নিয়ে এসেছেন লেখক, কিন্তু ভারতের অন্য ভাষার সাহিত্যের ইসমত চুগতাই, রশিদা জাহানরা কোথায়? মহাশ্বেতা দেবী বা আশাপূর্ণা দেবী শক্তিশালী প্রতিবাদী সাহিত্যিক ছিলেন, কিন্তু মেরুকরণদুষ্ট হননি। মেরুকরণের কথায় আলোচ্য প্রবন্ধের সিংহভাগ জুড়ে আছেন জীবনানন্দ দাশ। বিক্ষিপ্ত ভাবে উঠে এসেছে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সমরেশ বসুর গদ্যসাহিত্য এবং শামশের আনোয়ারের কবিতা। শেষের দিকে রবীন্দ্রোত্তর যুগের বাংলার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্বন্ধে লেখা হয়েছে, ‘সুনীলের নীরা সিরিজ়ের মুগ্ধতা’। এই কি বাংলা সাহিত্যের সার্বিক ছবি? কোথায় রবীন্দ্রনাথ, কোথায় সৃষ্টি নিয়ে নজরুলের দাবি ‘অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’, কোথায় দিকপাল সাহিত্যিকরা?

নির্যাতিতা নারীজীবনের কথা সুনীলের উপন্যাসের নারী-চরিত্রগুলিতে ধরা পড়েছে। সেই সময়-এর বাল্যবিধবা বিন্দুবাসিনী মনের মানুষ গঙ্গানারায়ণকে পায়নি। সুনীলের নারী প্রতিদ্বন্দ্বী উপন্যাসের কেয়া চরিত্রকে হয়তো কিছুটা ছুঁয়েছে, বিপরীতে একই উপন্যাসের সুতপা চরিত্রটি সুনীলের ‘নারী’ বা ‘নীরা’ হয়ে উঠেছে অনস্বীকার্য ভাবে। মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে নারী-স্বাধীনতার অবমাননার শিকার সুতপা। উপন্যাসের দুই নারী-বান্ধবী কেয়া এবং নিজের বোন সুতপা— দুই চরিত্রকে সিদ্ধার্থ যেন আয়নার সামনে এবং পিছনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, আর সুনীল তাদের মধ্যে খুঁজছেন সেই নীরা/নারী’কে। এই ভাবে সুনীলের ‘নীরা’ শুধু মুগ্ধতার প্রতীক নয়।

আরও উদাহরণ আছে— মনের মানুষ উপন্যাসের কমলি ও ভানতি (ভানুমতী) চরিত্র দু’টিতে। অরণ্যের দিনরাত্রি-তে দুই বোন অপর্ণা আর জয়ার মধ্যে পুরুষতন্ত্রের দ্বারা নির্যাতিতের দ্বন্দ্ব। মেঘ বৃষ্টি আলো উপন্যাসে কলেজ অধ্যাপিকা অনুরাধা এবং বান্ধবী জয়শ্রীর মধ্যেও বাংলার সুনীল আবিষ্কার করেছেন আরও দুই নির্যাতিতা ‘নীরা’কে। কোথাও না আছে মুগ্ধতা না হিংসা।

‘নীরা’ চরিত্র নিয়ে এমন মূল্যায়ন আগে হয়নি। প্রবন্ধকারের ‘দুই মেরু’-র কোনওটিই সাহিত্যে নারীর প্রতি সহমর্মিতাকে ছোঁয়নি। মনে হয়, বাংলা সাহিত্যে নারীর প্রতি ঘৃণা বা হিংসা কখনও সাহিত্য সৃষ্টির কেন্দ্রে আসতে পারবে না, প্রান্তেই থাকবে।

পঙ্কজ কুমার চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা-১১৬

সীমাবদ্ধতা

পুরুষ ও নারী সাধারণত পরস্পরের পরিপূরক হয়ে, এক সঙ্গে চলায় বিশ্বাস করে। কবি ও গল্পকার নরনারীর জীবন যাপন থেকে সাহিত্যের উপাদান খুঁজে পান। অথচ, পুরুষ ও মহিলা সাহিত্যিকের রচনায় মেয়েদের প্রতি দর্শনে আশ্চর্য পার্থক্য দেখা যায়। যশোধরা রায়চৌধুরীর মতে, এই পার্থক্য ‘দেখা জরুরি’। তাঁর প্রবন্ধটিতে দেখা যাচ্ছে সাহিত্যিক হিসেবে পুরুষ বেশি সমালোচিত। কবিতায় নারীর চিত্রায়ণ সৌন্দর্যপ্রধান, যা তার অস্তিত্বের একমাত্র পরিচয়। অন্য পরিচয়ের অভাবে এই নারী পূর্ণাঙ্গ মানবী নয়, খণ্ডিত। গদ্যে নারীর সৌন্দর্য, নারীত্বের উপস্থাপনা জটিল ও সমস্যাসঙ্কুল। প্রথমেই বলি, এই আলোচনার জন্য উত্তর-সম্পাদকীয়ের আয়তন যথেষ্ট নয়। জীবনানন্দ দাশ, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সমরেশ বসু প্রমুখ মাত্র কয়েক জন পুরুষ-সাহিত্যিকই যথেষ্ট নন। মঙ্গলকাব্য রচয়িতা থেকে ভারতচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র প্রমুখকে এই আলোচনায় আনতেই হবে। অন্য দিকে, অখণ্ড ‘সাহিত্যিক’-সত্তা ও লিঙ্গ-বিভাজিত পুরুষ-মহিলা সাহিত্য-রচয়িতার সত্তার দ্বন্দ্বের বিশ্লেষণ দরকার। কারণ, দেশ-কালের পার্থক্যে এই ‘উল্টেপাল্টে দেখার বীক্ষণ’ বদলে যায়।

সম্প্রতি এক গল্প পাঠের আসরে গল্প পাঠ করলেন বাংলাদেশের দুই সাহিত্যিক, এক জন পুরুষ, অন্য জন মহিলা। পুরুষ গল্পকারের গল্পে ছিল অতীতের ‘কালেকটিভ মেমরি’-র মধ্যে বর্তমান পুরুষের বোধে নারীর অসহায়তা অনুভব, সহমর্মিতার আকুতি। আর নারী গল্পকারের গল্পে ছিল বর্তমানে নারীত্ববোধে অব-সহিত (সহিত থাকার প্রতি অসততা) পুরুষের অমানবিক অনুভব। গল্পপাঠের পর আলোচনায় এল এ-পার বা পশ্চিমবঙ্গের শ্রোতাদের উচ্ছ্বাস— আহা, এমন গল্প শুনিনি, এমনটা জানলাম। গল্পে দেখা গেল, যা হয়, শব্দসংখ্যা হিসেবে গদ্যের পরিসর অনেক বেশি। একাধিক নারীর সৌন্দর্যের প্রকাশের সঙ্গে তার সমগ্র, পূর্ণাঙ্গ মানবিক চরিত্রের আলো-আঁধারের জাদু দেখানো যায়। অন্য দিকে, কবিতার আয়তন সাধারণত অনেক কম। স্বল্প পরিসরে নারীর সৌন্দর্য প্রায়ই প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

রামায়ণ, মহাভারত, মঙ্গলকাব্য ইত্যাদি মহাকাব্য যেখানে নারীচরিত্রের বহুমাত্রিকতা পরিবেশনের সুযোগ পাওয়া যায়, তা আধুনিক সাহিত্যিকরা আর লিখবেন বলে মনে হচ্ছে না। এখন উপন্যাস, বড় গল্প পড়ার পাঠকের ধৈর্য কমে যাচ্ছে। গদ্যের দৈর্ঘ্য এখন সীমিত। সেখানে হয়তো সাহিত্যে নারীচরিত্রকে আত্মবলিদান দিতে হয়। কেউ বলতেই পারেন, এই ব্যাখ্যা অজুহাতমাত্র। এই প্রবন্ধে আধুনিক এমন গদ্যকবিতার উল্লেখ থাকলে ভাল হত।

শুভ্রাংশু কুমার রায় চন্দননগর, হুগলি

তারকা প্রার্থী

মোহিত রায়ের ‘প্রশ্নটা রাজনীতির আদর্শের’ (৩-৫) প্রবন্ধটি অত্যন্ত সময়োপযোগী। প্রবন্ধকার ঠিক জায়গাতেই অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন এবং তাঁর জিজ্ঞাসার সঙ্কেত সাধারণ মানুষের বুঝতে কোনও অসুবিধে হয় না। ভোটের সময়ে চলচ্চিত্র, স্পোর্টস বা অন্যান্য ক্ষেত্রের তথাকথিত তারকাদের নিয়ে রাজনৈতিক দলের নেতারা একটা হুল্লোড়ের বাতাবরণ তৈরি করেছেন। এই নাট্যরচনা দক্ষিণ ভারতে প্রথমে শুরু হয়েছিল, এখন তা উত্তর ভারত হয়ে পূর্ব ভারতেও যেন পা দিয়েছে। নির্বাচনে যে কেউই দাঁড়াতে পারেন, তাঁর রাজনৈতিক পশ্চাৎপট না-ই থাকতে পারে, তিনি অভিজ্ঞ না-ও হতে পারেন। কিন্তু অভিজ্ঞতার নিরিখে বলা যায়, রাজনৈতিক দলের নেতারা মনে করেন বাহ্যিক রূপ, আকর্ষণ এই সব দেখিয়ে তাৎক্ষণিকতায় মঞ্চ জয় করা যেতে পারে। এবং জনগণও পর্দায় দেখা সেই সব রুপোলি জগতের নায়ক-নায়িকাদের দেখে আপ্লুত হন।

কিন্তু বাস্তবে জনগণ বোকা নন। তাঁদের একটা বড় অংশ আগেই ঠিক করে রাখেন, কাকে ভোট দেবেন। মাঝখান থেকে যে সব নেতা-নেত্রী সারা বছর দলের জন্য ঘাম ঝরিয়ে কাজ করে যান, তাঁরা টিকিট না পেয়ে গুমরে মরেন। এখনকার রাজনীতি দেখে মনে হয়, কোনও নীতি নেই কর্মীদের। কোনও আত্মসম্মান নেই, কোনও শিক্ষারও দরকার হয় না। অনেক শিক্ষিত শহুরে মানুষ ইতিমধ্যেই ভোটকেন্দ্র থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন, ভোট দিতে যাচ্ছেন না। সবচেয়ে মুশকিল, যদি কোনও তারকা বাইরে থেকে এসে অচেনা কেন্দ্রে ভোটে দাঁড়ান, এবং তিনি যদি জিতে যান, পরবর্তী কালে তাঁকে সেই কেন্দ্রে দেখতে পাওয়া দুষ্কর। অচেনা কেন্দ্র নিয়ে তাঁর কোনও ধারণা থাকে না, অনুভবও থাকে না। তিনি তখন ব্যস্ত হয়ে পড়েন আগামী পাঁচ বছর তাঁর আখেরটি গুছিয়ে নেওয়ার জন্য। তাই প্রবন্ধকারের কথা অনুযায়ী ‘পাড়ার মঞ্চে ওঠার জন্য সেই মেয়েটি’ চিরকালই ফুলের তোড়া নিয়ে রাস্তার ধারেই অপেক্ষা করবে।

শ্যামলজিৎ সাহা চুঁচুড়া, হুগলি

অন্য বিষয়গুলি:

Saffronization Literature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy