আফরোজা খাতুনের ‘ভাষা যাতে না হারায়’ (২১-৫) শীর্ষক প্রবন্ধে বাংলা ভাষার উপর হিন্দি ও অন্যান্য ভাষার আগ্রাসনের যে দিকটি আলোচিত হয়েছে, তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও অনস্বীকার্য। তবে, বর্তমানে ইংরেজি ভাষার প্রতি বাঙালির দাস্যভাব বাংলা ভাষাকে যে ভাবে অসম প্রতিযোগিতার মুখে ঠেলে দিয়েছে, তাও আমাদের বিবেচনায় রাখা উচিত। ‘এক দেশ, এক ভাষা’-র ধারণা যে ভাবে ভারতীয় জাতিসত্তার সঙ্গে বেমানান; ঠিক তেমনই ‘এক বিশ্ব, এক ভাষা’-র মতো সাম্রাজ্যবাদী প্রচেষ্টার বিরুদ্ধেও সচেতন ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিত। আসলে হিন্দি ভাষার আগ্রাসনের নেপথ্যে যে ভোটকেন্দ্রিক রাজনীতি কাজ করে; ভোটের মুখে বাংলা ভাষার অস্মিতা জাগিয়ে তোলাও তেমনই নির্বাচনী কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভোট মিটে গেলেই আবার বাংলা ভাষা দুয়োরানি হয়ে যাবে। ব্যানারে, ফেস্টুনে, বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত ভুল বানান, ত্রুটিপূর্ণ বাক্য গঠন, হিন্দি বা ইংরেজি থেকে দায়সারা, বিকৃত, আক্ষরিক অনুবাদ, এ সব কিছুই তখন অবলীলায়, বিনা প্রতিবাদে চলতে থাকবে।
প্রবন্ধকার প্রাসঙ্গিক ভাবেই বলেছেন ভাষার প্রতি তাচ্ছিল্য আর উপেক্ষার কথা। ভাষাশিক্ষা যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে শুরু হওয়ার কথা, সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির উদ্যোগও তথৈবচ। অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী বাংলা যুক্তাক্ষর পড়তে পারছে না, অথবা নিজের নামের বাংলা বানানই ভুল লিখছে, এই ছবি প্রায়ই দেখা যাচ্ছে। আসলে, নিজের ভাষার প্রতি সম্ভ্রমের ভাব জাগিয়ে তুলতে পারলে, বাঙালি নিজের সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদেই ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখবে। রুখে দেওয়া যাবে যাবতীয় আগ্রাসনও।
অমিত ভট্টাচার্য, কলকাতা-৮৫
শুদ্ধ বাংলা
১৯ মে-র ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আফরোজা খাতুনের প্রবন্ধটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। বাংলা ভাষা কলকাতায় যে অবহেলিত, সে কথাও প্রবন্ধকার যথাযথ ভাবে উল্লেখ করেছেন। বাংলা ভাষা প্রসারের নানা সমস্যার কথাও তুলে ধরেছেন, যা মাতৃভাষাপ্রেমী বাঙালিমাত্রেই অনুভব করলেও বাস্তবে তারা যেন অসহায়! স্বাধীনতার পর এই বাঙালি জাতিটিকে মুখের ভাষা রক্ষা করার জন্য লড়াই করতে হচ্ছে। এক বার ও-পার বাংলায় ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, আর এক বার এ-পারে অসমে ১৯ মে ১৯৬১ সালে নিজের ভাষা রক্ষার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছিল বাঙালিকে। এর মধ্যে কমলা ভট্টাচার্য নামে এক জন স্কুলছাত্রী শহিদ হয়েছিলেন। ভাষার জন্য প্রাণ দানের এই ইতিহাস আজকের বাঙালি কতটুকু মনে রেখেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়।
প্রবন্ধকার ঠিকই বলেছেন যে, ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে তাকে অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। হালের বাঙালি রাজনীতিকরা এই বিষয়ে যদি মুখ লুকিয়ে থাকেন, তা হলে মুশকিল। জাতির ভাষাকে প্রতিষ্ঠা দিতে পারে সেই জাতির রাজনীতিকরাই। কেন জানি না, বাঙালি রাজনীতিকরা এ ব্যাপারটিতে বড়ই উদাসীন। আর পরিবেশ ও পরিস্থিতি বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির অনুকূলে নয় বলেই অধিকাংশ বাঙালি বাংলা ভাষার সঙ্গে হিন্দি বা ইংরেজি মিশিয়ে ফেলছে। অবিমিশ্র বাংলা এখন প্রায় শোনাই যায় না বাঙালির মুখে। পরিশীলিত বাংলা বলার অভ্যাসটাই তাদের নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই প্রয়োজন শিক্ষায় মাধ্যমিক স্তরে বাংলা ভাষাকে বাধ্যতামূলক করা। চাই সরকারি ও বেসরকারি নথিপত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার। ভাষা প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে হিন্দি আগ্রাসনের বিরোধিতা করা দরকার, ঠিক যেমনটি হয়েছে ওড়িশা এবং দক্ষিণ ভারতের নানা রাজ্যে। এই রাজ্যগুলিতে সরকার মাতৃভাষা সুরক্ষিত করেছে।
পশ্চিমবঙ্গের প্রধান ভাষা বাংলাকে শিক্ষা-কর্মে সর্বত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই রাজ্যের সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। তা হলেই পূরণ হবে আত্মবলিদান দেওয়া ভাষা-শহিদদের লক্ষ্য।
প্রেমানন্দ রায়, কলকাতা-১৩১
দেশপ্রেমিক
তাপস সিংহের ‘আজ যেন আরও জরুরি’ (১০-৫) শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু বক্তব্য। সরকারের সমালোচনা মানেই দেশের বিরোধিতা— গত বছর এক আলোচনা সভায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেন রিজিজুর এই স্পর্ধিত মন্তব্য জনমানসে আশঙ্কার উদ্রেক করে যে, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে কি গণতন্ত্র আদৌ সুরক্ষিত? স্বাধীনতার ৭৬ বছর পরেও এক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দিতে হয় যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিকরা রাষ্ট্রের প্রজা নয়, সম্মাননীয় সদস্য। সরকারের ভ্রান্তি প্রকাশ্যে আনা দেশপ্রেমিকেরই কাজ। বুদ্ধিজীবী, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সুশীল সমাজ, বিরোধী দল প্রমুখের আন্দোলন, প্রতিবাদ কখনও রাষ্ট্রদ্রোহ নয়। নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে অবস্থানগত মতান্তর গণতন্ত্রের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। মনুসংহিতায় উল্লিখিত হয়েছে যে, রাজাকে পক্ষপাতহীন ভাবে প্রজাদের মঙ্গলের কথা ভাবতে হবে। অশোক তাঁর দ্বাদশ শিলালেখতে বলেছেন, অন্য সম্প্রদায়কেও সর্বতোভাবে সম্মান করতে হবে। অ্যারিস্টটল নৈতিকতা ও কাজের সঠিক মিশ্রণকে প্রধান গুণ আখ্যা দেন। শাসক সেই লক্ষ্যে কাজ করবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ঘৃণার রাজনীতির প্রাবল্য বর্তমান ভারতে মেরুকরণকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করে চলেছে, খণ্ডিত হচ্ছে বাক্স্বাধীনতার পরিসর। ভিন্ন স্বরের কণ্ঠরোধ করার জন্য চলছে ইউএপিএ-র মতো আইনের যথেচ্ছ প্রয়োগ। তেলুগু কবি ভারাভারা রাও, অশীতিপর জেসুইট পাদরি স্ট্যান স্বামী (অসুস্থ অবস্থায় কারাগারেই মৃত্যু হয় তাঁর), দিল্লির সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িত থাকার সন্দেহে আটক জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা উমর খালিদ, হাথরস-এর মর্মান্তিক কাণ্ডের খবর করতে আসা কেরলের সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান, এমন বহু মানুষকে শুধুমাত্র অনুমানের ভিত্তিতে জামিন-অযোগ্য ধারায় গ্রেফতার করে রাখা হয়েছিল। সংবাদ পোর্টাল ‘নিউজ়ক্লিক’-এর কর্ণধার প্রবীর পুরকায়স্থকেও সঠিক ভাবে গ্রেফতারির কারণ না দেখিয়ে আটক করা হয়েছিল।
এ সমস্ত ঘটনা বারংবার এটাই প্রমাণ করে দেয় যে, সংবিধানে উল্লিখিত নাগরিকদের মৌলিক অধিকার আজ বিপন্ন। এম এম কালবুর্গি, গৌরী লঙ্কেশ, নরেন্দ্র দাভোলকরদের স্বাধীন চিন্তার মাসুল দিতে হয়েছে নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে। দ্য কাশ্মীর ফাইলস ছবির সমালোচনা করার অপরাধে বিশ্ববিখ্যাত ইজ়রায়েলি পরিচালক নাদাভ লাপিদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত পদক্ষেপ করার জন্য ভারতে ইজ়রায়েলের রাষ্ট্রদূতকে দিল্লির কড়া নির্দেশ দান, গুজরাত দাঙ্গা প্রসঙ্গে বিবিসি-র তথ্যচিত্র দ্য মোদী কোয়েশ্চেন-এর লিঙ্কটি যাতে কোনও ভাবেই সমাজমাধ্যমে আদানপ্রদান না হয়, তার জন্য বিদেশ মন্ত্রকের যুদ্ধকালীন তৎপরতা, পশ্চিমবঙ্গে দ্য কেরালা স্টোরি প্রদর্শনে রাজ্য সরকারের অহেতুক নিষেধাজ্ঞা, সমাজমাধ্যমে কার্টুন প্রকাশের জন্য অম্বিকেশ মহাপাত্রদের চূড়ান্ত সামাজিক হেনস্থা— এই সব ঘটনা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের অগণতান্ত্রিক মানসিকতারই পরিচয় বহন করে।
অথচ, কেশবানন্দ ভারতী বনাম কেরল রাজ্য সরকার মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল যে— সংসদ সংবিধান সংশোধন করতে সমর্থ হলেও, সংবিধানের ‘বেসিক স্ট্রাকচার’ বা মূল কাঠামো কখনওই পরিবর্তন করতে পারবে না। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের মতে, সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক ব্যক্তি অধিকারের মূল কাঠামোই হল ভারতীয় গণতন্ত্রের ধ্রুবতারা। বর্তমান ভারতীয় রাজনীতিতে বড়, ছোট, মাঝারি সব দলই কম বেশি অসহিষ্ণু, বলদর্পী, আচরণে দুর্মুখ, দুর্নীতির প্রশ্রয়দাতা। শৃঙ্খলিত কলম এবং কোলাপসিবল গেট দিয়ে আটকানো কি গণতন্ত্রকে প্রহসনে পরিণত করার পক্ষে যথেষ্ট নয়?
স্বাতী চট্টোপাধ্যায়, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy