ভাগ্যের পরিহাস বলব কি না জানি না, ২১ এপ্রিল সকালে পড়ছিলাম সাত বছর আগে আনন্দবাজার পত্রিকা-য় শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে বিশ্বজিৎ রায়ের নিবন্ধ ‘শব্দ ও নৈঃশব্দ্যের কবি’ (৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪)। শিক্ষিত বাঙালি মননের কবি আজও স্বমহিমায় বিরাজমান, আজকের দিনেও অন্তত এক জন মানুষ ‘মনান্তর’ না রেখে ‘মতান্তর’ প্রকাশ করতে পারেন, এই প্রাপ্তিবোধ নিয়ে নিবন্ধটি পড়া শেষ করার ঠিক এক ঘণ্টার মাথায় বজ্রপাত। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে গিয়েছে শঙ্খ ঘোষকে। এতে যে শুধু বাংলা সাহিত্যসৃষ্টিই অনাথ হল তা নয়, রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা সংস্কৃতিতে ধৈর্যশীলতা, বিচক্ষণতা ও নিরহঙ্কার প্রজ্ঞার দীপ্যমান শিখাটি নিবল। হারিয়ে গেল রবীন্দ্রপাঠের এক জোড়া নিরলস চোখ। বিশ্বভারতীতে আমার মাস্টারমশায় অভিজিৎ সেন প্রায়শই বলেছেন, শঙ্খবাবু শুধু রবীন্দ্রনাথ পড়েই ক্ষান্ত হননি, তাঁর দর্শন নিজের জীবনপ্রবাহে ধারণও করেছেন। ২০১৪ সালে শঙ্খ ঘোষ প্রদত্ত ‘হওয়ার দুঃখ’ শীর্ষক সমর সেন স্মারক বক্তৃতাটি সে কথাই মনে করিয়ে দেয়। সে দিক থেকে তিনি শুধু বিদগ্ধ রবীন্দ্র-আলোচকই নন, রবীন্দ্রযাপীও বটে। তবে আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা সবচেয়ে হীন হলাম শঙ্খ ঘোষের একান্ত নিজস্ব এক বাঙ্ময় নিভৃতচারণের প্রয়াণে। নীরবতা চর্চা করতেন তিনি। সঠিক সময়ে তরঙ্গের মতো তাঁর উচ্চারণ এসে পৌঁছে যেত মরমে। আজ ড্রয়িংরুম থেকে শুরু করে জনসভা, সর্বত্র কুৎসিত ভাষায় আস্ফালন ও বিরোধিতার যুগে এমন আর কেউ সম্ভবত রইলেন না, যিনি মিতভাষের গুরুত্ব বোঝাবেন, সৌজন্য বজায় রেখে বিরুদ্ধতার শিক্ষা পাঠাবেন আমাদের এই অসহায় পরিসরে।
শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী, কলকাতা-৩১
দায়বদ্ধ
চলে গেলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। বাংলা কবিতার জগতে এক বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি হল। তাঁর কবিতার মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সমাজের বিবেক। কবিতার শুরু কোচবিহারে খাদ্যের দাবিতে মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত এক মেয়েকে নিয়ে লেখেন ‘যমুনাবতী’। সদ্য স্বাধীন দেশের অনাহার পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর কলম গর্জে উঠল, “পেশির দৃঢ় ব্যথা, মুঠোর দৃঢ় কথা, চোখের দৃঢ় জ্বালা সঙ্গে। চলল মেয়ে রণে চলল।” জরুরি অবস্থার সময়ে শাসকের কণ্ঠরোধ করার বিরুদ্ধে ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ’ লিখে তীব্র বিদ্রুপ ছুড়ে দেন। ‘সবিনয় নিবেদন’ কবিতায় ক্ষমতার লড়াইয়ের আগুনে সাধারণ মানুষের উৎসর্গ হওয়া নিয়ে লেখেন “আমি আজ জয়ী, সবার জীবন/ দিয়েছি নরক করে।” তাঁর কবিতা বিশেষ কোনও ঘটনা বা সময়ের উপর ভিত্তি করে লেখা হলেও আজকের দিনেও তাঁর কবিতা খুব প্রাসঙ্গিক। এখানেই তাঁর সার্থকতা। আসলে তিনি বরাবর সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন। তাঁর কবিতা ভীষণ ভাবে রাজনৈতিক হলেও তিনি কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের অনুগামী ছিলেন না। আজ সারা দেশ জুড়ে যখন ফ্যাসিবাদী শক্তির দাপাদাপি, তখন কবির প্রয়াণ অপূরণীয় ক্ষতি। তবে তাঁর কবিতা আমাদের ফ্যাসিবাদীদের বিরুদ্ধে লড়তে উৎসাহ দেবে।
অভিজিৎ ঘোষ, শ্যামনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
ব্যক্তিগত
কোনও প্রিয় কবি চলে গেলে মনে পড়ে অন্যান্য চলে যাওয়ার গল্প। শঙ্খ ঘোষের কথা ভাবতে ভাবতে কখন পৌঁছে গিয়েছি ১৯৭৪ সালে, আর মনে পড়েছে শঙ্খ ঘোষের প্রিয় বুদ্ধদেব বসুকে নিয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এলিজি-র লাইন, “ছেড়ে তো গেলে, কিন্তু কেন গেলে।” কবির স্মৃতি মানেই অতীতচারণ নয়। সে সত্তার পুষ্টি। ভবিষ্যতের পাথেয়। কবিতা যে পড়ে, শঙ্খ ঘোষ যে পড়ে, তার কাছে শঙ্খ ঘোষের উচ্চারিত শব্দের বিশিষ্ট ও ব্যক্তিগত অনুভব রয়েছে। তাঁর জন্যই বুঝতে পেরেছি, জীবন “আদিম লতাগুল্মময়।” সব কিছু স্বচ্ছ ভাবে বুঝে ফেলা যাবে, এ আশা বাতুলতা।
সুরঞ্জন চৌধুরী, কলকাতা-৯৭
শহর ও কবি
মননের কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁর কর্মজীবনের প্রথমার্ধে, অর্থাৎ ১৯৫৫-৫৬ সালে বহরমপুর গার্লস কলেজের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। তিনি বহরমপুর শহরের খাগড়া এলাকায় একটি ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। বহরমপুরে থাকাকালীন তিনি এই শহরের সাহিত্য জগতের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে সেই সময় নিবিড় বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিল সময় পত্রিকার সম্পাদক প্রয়াত উৎপলকুমার গুপ্তের। এ ছাড়াও বহরমপুর গার্লস কলেজে অধ্যাপনা করার সূত্রে কবির সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অন্যতম রূপকার, বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক অধ্যাপক ডক্টর রেজাউল করিমের।
বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে মিতবাক, আত্মপ্রচারহীন, নির্মোহ কবি শঙ্খ ঘোষ শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও বহরমপুরের সময় পত্রিকায় ২০১৮ সাল পর্যন্ত কবিতা লিখেছেন। কবির সঙ্গে বহরমপুর শহরের নিবিড় আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল আমৃত্যুকাল।
তুষার ভট্টাচাৰ্য, কাশিমবাজার, মুর্শিদাবাদ
জীবন শিল্পী
বিশাল মাপের সাহিত্যপ্রতিভা শঙ্খ ঘোষ। তাঁর ব্যক্তিত্বের আর একটি দিক হল অতিথিপরায়ণতা, যা তাঁর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিমাত্রেই অবগত আছেন। তাঁর কথাবার্তা, আচার-আচরণে কমবয়সিদের প্রতি যেন স্নেহবিকিরণ করতেন। সেই পরিচয় পেয়েছি প্রথম বার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে। এখনও পরিষ্কার কানে বাজে তাঁর কথাগুলো, “ক’চামচ চিনি দেব তোমার পেয়ালায়?” হ্যাঁ, ‘পেয়ালা’ শব্দটাই তিনি ব্যবহার করেছিলেন। তার পর, হতভম্ব আমি, দ্বিধাপূর্ণ বিস্ময়ে চায়ের কাপে চামচ নাড়াতে গিয়ে খটমট আওয়াজ করে ফেলি। শঙ্খস্যর সস্নেহে দেখিয়ে দিলেন, ঠিক কী ভাবে চামচ নাড়াতে হয়। এই অহংশূন্যতাও তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
তাঁর স্নেহভাজন হওয়ার সুবাদে দুমদাম নানা প্রশ্ন করতাম। কখনও বিরক্ত হতেন না। এক দিন তাঁর বইঘরে রাশি রাশি বইয়ের সংগ্রহ দেখে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আপনার কি ফোটোগ্রাফিক মেমরি? এত পড়া মনে থাকে কী করে?” হাসিমুখে বলছিলেন, “সব কি আর মনে থাকে? তবে, যতটুকু থাকে, কাজ চলে যায়।” আর এক দিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “কত বই পড়লে তবে লেখক হওয়া যায়?” কিছু ক্ষণ নীরব থেকে উত্তর দিলেন, “দেখো, বই পড়ে লেখক হয়তো অনেকেই হয়, কিন্তু রসের বিচারে তাদের রচনা পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে কি? সত্যিকারের সৃষ্টিশীল লেখা আসে জীবনবোধ থেকে, স্মৃতি থেকে, সংজ্ঞা থেকে।” মনে হচ্ছিল, এই জন্য বোধ হয় কবিগুরুকে ‘জীবন শিল্পী’ বলেছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায়।
অনিমেষ পাল, গোয়ালতোড়, পশ্চিম মেদিনীপুর
অকপট
অকপট সত্য কথা বলতেন কবি শঙ্খ ঘোষ। সে সত্য বলার জন্য অনেক সময় শাসক বা বিরোধী নেতা-নেত্রীরা তাঁকে বহু কটু কথা বলেছেন। তাতেও তিনি পিছিয়ে থাকেননি। এ অভাগা দেশে মাঝে মাঝেই সাধারণ মানুষের উপর নেমে এসেছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। অনেক কবি-সাহিত্যিক হয়তো জল মেপে চলেছেন সুযোগ-সুবিধা হারানোর ভয়ে। কিন্তু শঙ্খবাবুর প্রতিবাদ থেকেছে অনড়। এত ঋজু মেরুদণ্ড খুব কম মানুষের দেখা যায়। দেশের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর একদেশদর্শী ভূমিকা পালন যখন দেশকে রসাতলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তখন তিনি বার বার গর্জে উঠেছেন। আবার সেই মহাসঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দেশ। এই সময় তাঁর চলে যাওয়ায় দেশ, বিশেষ করে রাজ্যের শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি হল।
সফিয়ার রহমান, অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy