দুর্গাপুজোর মহোৎসব পেরোল, এ বার কালীপুজো। যদিও বহু ঐতিহ্যশালী মন্দির বা পুজোতে পশুবলি আর হয় না, তবুও অনেক গ্রামগঞ্জে বা পারিবারিক পুজোয় পশুবলি এখনও চলে আসছে। এই বলিপ্রথা থামানোর অনিচ্ছার পিছনে কাজ করছে শাস্ত্রবাক্য, বহু দিন চলে আসা ঐতিহ্যের দোহাই, অথবা নিছক অমঙ্গলের ভয়।
এ কথা ঠিক যে, তন্ত্রশাস্ত্রমতে শক্তিপূজায় বলিদান লাগে। কিন্তু এটাও সত্যি যে, সনাতন ধর্মের শাস্ত্র যুগে যুগে বিবর্তিত হয়েছে। বৈদিক যজ্ঞে প্রচুর পশুবলি হত। কিন্তু এখন যদি কেউ সমস্ত বিধি মেনে যজুর্বেদের অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে যান, তা হলে তাঁকে বিরল ও সংরক্ষিত প্রাণিহত্যার অপরাধে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। এই বিবর্তনের পথ ধরেই প্রাচীনতম শাস্ত্র ঋগ্বেদের প্রধান দেবতা ইন্দ্র, অগ্নি, মিত্র, বরুণ জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর-দুর্গা-কালী-গণেশ-শীতলা-সন্তোষী মা প্রমুখ দেবদেবীকে। বৈদিক রুদ্র তাঁর ভীতিপ্রদ তির-ধনুক ছেড়ে জনমানসে ‘ভোলেবাবা’ রূপ নিয়েছেন। কয়েক বছর হল, গঙ্গায় দূষণ কমানোর জন্য চিরাচরিত দুর্গা প্রতিমা বিসর্জনের প্রথায় পরিবর্তন এসেছে। কাজেই তন্ত্রশাস্ত্র বর্ণিত বলিদান বদলে দিতে দ্বিধা কেন?
আসলে শাস্ত্রের বিধান যুগোপযোগী না হলে জীবনযাত্রা যে অচল হয়ে পড়বে, সেটা আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রকারগণও জানতেন। তাই তাঁরা বলে গিয়েছেন— মানুষকে যুগের উপযোগী হতে হবে (‘নৃণাং যুগরূপানুসারতঃ’, পরাশর স্মৃতি)।
কিছু ব্যক্তি পশুবলির পিছনে একটা প্রতীকী তাৎপর্য খুঁজে পান। তাঁদের মতে পশুবলি হচ্ছে কাম, পাপ ও হিংসাকে বলি দেওয়ার প্রতীক। তাঁদের কাছে প্রশ্ন, একটি নিরীহ ছাগশিশুকে টেনে হাড়িকাঠে চড়িয়ে, তার ব্যাকুল চিৎকার ঢাক-ঢোল-কাঁসরের আওয়াজে ঢেকে দিয়ে, খাঁড়ার একটি কোপে তার জীবন সাঙ্গ করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সমস্ত পাপ, কাম, হিংসা শেষ হয়ে যায়? যদি তা-ই হত, তা হলে দেশ থেকে দুর্নীতি উধাও হয়ে যেত।
পশুবলির বিরুদ্ধে বিভিন্ন শাস্ত্রে, যেমন— মনুস্মৃতি, পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, ভাগবতপুরাণ, ভবিষ্যপুরাণ, মহাভারত থেকে প্রচুর উদাহরণ দেওয়া যায়। কিন্তু সে সব শাস্ত্রীয় বিতর্কে না গিয়ে সবার কাছে একটি অনুরোধ রাখা যায় যে, দুর্গা বা কালীরূপে প্রকাশিত জগন্মাতা প্রতিটি জীবের মা। তাই তাঁর পুজো উপলক্ষে পশুবলির প্রথা বন্ধ হোক। তার পরিবর্তে কুমড়ো, আখ, মাছ, এমনকি পিঠের তৈরি পশু বলি শক্তিপূজায় সম্পূর্ণ শাস্ত্রসম্মত (কালিকাপুরাণ ৫৫-৪, ৬৭-১৫, ৬৭-২৩)। তাই এই ক্ষেত্রে অধর্মের ভয়ও নেই। পুজো হোক ভক্তি দিয়ে, জ্ঞান-বিবেক-বৈরাগ্যের সঙ্গে। অবলা পশুর রক্তক্ষয় করে নয়।
দিলীপ দাস
মিসৌরি, আমেরিকা
দুগ্ধবতী গাভী
‘শ্বেতহস্তী’ (২০-১০) সম্পাদকীয় নিবন্ধে এয়ার ইন্ডিয়াকে বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো হয়েছে। দুই দশক পর, তিনটি ব্যর্থ প্রচেষ্টার শেষে বিক্রি হয়ে গেল একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান সংস্থাটি।
সম্পাদকীয় নিবন্ধে মন্তব্য করা হয়েছে, “বিমান সংস্থা পরিচালনা করা সরকারের কাজ নয়”। তা হলে কি সরকারি নিয়ন্ত্রণই এই পতনের মূল কারণ? অথচ, ভারতের অন্যান্য বৃহৎ উড়ান সংস্থা, কিংফিশার, জেট এয়ারওয়েজ় তো বেসরকারি সংস্থাই ছিল। তা হলে কেন তাদের পাততাড়ি গোটাতে হল? সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে, ভুল কর্মনীতি, অদক্ষ পরিচালন ব্যবস্থা কি এই সমস্ত সংস্থার পতনের কারণ নয়? যে সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এখনও বিপুল মুনাফা কামাচ্ছে, যাদের মুনাফার একটা বড় অংশ প্রতি বছর কেন্দ্রীয় সরকার হস্তগত করছে রাজকোষের ঘাটতি মেটাতে, সেই সমস্ত দুগ্ধবতী গাভীদের কথা কি মনে নেই?
ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সকে এয়ার ইন্ডিয়ার সঙ্গে ২০০৬-০৭ সালে মিশিয়ে দেওয়ার পর থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার ঋণ হুহু করে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ৭৭০ কোটি টাকার দেনা মার্চ, ২০০৯-এ বেড়ে দাঁড়াল ৭২০০ কোটি টাকা! ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স ২০০৪ সালে ৪ নভেম্বর ৫০টি বিমান ক্রয় করে ৪৬ হাজার কোটি টাকার বিনিময়ে। এর মধ্যে ছিল ভিভিআইপিদের জন্য ১৮টি চার্টার প্লেন। বেশির ভাগ সময়ে যেগুলো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থেকে রক্ষণাবেক্ষণ খাতে খরচ বহু গুণ বাড়িয়েছে। এয়ার ইন্ডিয়ার পুনরুজ্জীবনের জন্য আর্থিক পুনর্গঠনের এক পরিকল্পনা হয়, যাতে ২০২১-এর আর্থিক বছরের মধ্যে ৩০,২৩১ কোটি টাকার ইকুইটি তার ধমনীতে সঞ্চালন করার প্রস্তাব ছিল। তার অডিট রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করে কেন্দ্রীয় অডিট সংস্থা ‘ক্যাগ’ কেন্দ্রীয় সরকারকে তুলোধোনা করে অনেকগুলো ফাঁকফোকর চিহ্নিত করেছে। দেখিয়েছে, কী ভাবে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোকে রূপায়িত না করে টাকার অপচয় করা হয়েছে।
প্রশ্ন ওঠে, যে সংস্থাটির বিদায়বেলায় মোট দেনার পরিমাণ ৬১,৫৬২ কোটি টাকা, যার প্রাত্যহিক ক্ষতির পরিমাণ ২০ কোটি টাকা, সেই ঋণে আকণ্ঠ নিমজ্জিত সংস্থাকে টাটা কিনল কোন যুক্তিতে? ২০১৯-২০ সালে, এয়ার ইন্ডিয়াকে বেচে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তে সিলমোহরের পর এয়ার ইন্ডিয়ার ‘অপারেটিং প্রফিট’ হয়েছিল ১,৭৮৭ কোটি টাকা। কিন্তু তার ব্যালান্স শিটে দেখা যায় যে, লোকসান হয়েছে ৭,৪২৭ কোটি টাকা। বিপুল সুদ পরিশোধ (৪,৪১৯ কোটি টাকা) এবং ডেপ্রিসিয়েশন বাবদ ৪,৭৯৫.৩০ কোটি টাকার জন্য।
পর্বতপ্রমাণ ঋণ এয়ার ইন্ডিয়ার ঘাড়ে চাপার পিছনে রয়েছে ভারত সরকারের কয়েক দশক ব্যাপী ভুল কর্মনীতি। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের সংযুক্তি যার অন্যতম কারণ। আকাশরেখাকে ক্রমে ক্রমে উন্মুক্ত করা এবং বেসরকারি সংস্থার স্বার্থে উড়ান নীতি ঢলে পড়তে থাকার কারণে লাভজনক আকাশপথ কব্জা করে নিতে থাকল বেসরকারি উড়ান সংস্থাগুলো। যেমন, বিভিন্ন বেসরকারি টেলিকম সংস্থা বর্তমানে যখন ৫জি স্পেক্ট্রামের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন ভারত সরকার বিএসএনএল-কে এখনও পর্যন্ত ৪জি স্পেক্ট্রামের অনুমোদনই দিল না।
যে সাতটি সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়া কিনতে ময়দানে নামে, তার মধ্যে পাঁচটিকেই সরকার অযোগ্য বিবেচনা করে বাতিল করে দেয়। বাকিদের মধ্যে এক জন হলেন অজয় সিংহ, স্পাইস জেট-এর চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর, বেশ কিছু দিন আগে যে সংস্থাটি দেউলিয়া হওয়ার দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছিল। অপরটি টাটা গোষ্ঠী, যা ১৮,০০০ টাকার দরপত্র দিয়ে হস্তগত করল এই সংস্থাটিকে। পরিহাস এটাই, এয়ার ইন্ডিয়ার দেনা ৬১,০০০ কোটি ছাড়ানো সত্ত্বেও টাটাদের উপর বর্তেছে মাত্র ১৫,৩০০ কোটি টাকার ঋণ। জলের দরেই বিক্রি হয়ে গেল বহু দশকের ঐতিহ্যবাহী ‘মহারাজা’। এর সঙ্গে টাটা পাচ্ছে এয়ার ইন্ডিয়ার বিশাল সম্পত্তি— ১৪১টি বিমান, যার মধ্যে ১১৮টি রীতিমতো উড়ানযোগ্য, হাতে পেল এয়ারবাস, বোয়িং ৭৩৭, দক্ষ কর্মী-বাহিনী, ৪,৪০০টি দেশীয় এবং ১,৮০০টি আন্তর্জাতিক উড়ান স্লট, ল্যান্ডিং লাইসেন্স। আর, ভিস্তারা এবং এয়ার এশিয়ার সঙ্গে এ বার এয়ার ইন্ডিয়ার মালিকানা চলে আসায় অসামরিক বিমানক্ষেত্রে টাটার একচেটিয়া আধিপত্য বেড়ে গেল।
কর্মীদের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকার (অন্তত আগামী এক বছরের মধ্যে কর্মী ছাঁটাই করতে না পারার শর্ত দেওয়া হয়েছে) কথা সরকার ফলাও করে বললেও, ২৯ সেপ্টেম্বরের এক বিজ্ঞপ্তি মারফত কেন্দ্রীয় অসামরিক বিমান মন্ত্রক জানিয়েছে, আগামী ৬ মাসের মধ্যে কর্মীদের জন্য বরাদ্দ আবাসন খালি করে দিতে হবে।
আজ শ্বেতহস্তীর অপবাদ যে সংস্থাকে দেওয়া হচ্ছে, তার কর্মীরাই কোভিড অতিমারির সময়ে ঘোষিত লকডাউনে আটক ভারতীয় নাগরিকদের উদ্ধার করেছেন নানা ঝুঁকির মধ্যে দিয়ে। কোভিড-উত্তর বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে যখন বিশ্ব জুড়েই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে মজবুত করার প্রয়োজনের বোধ আবার ফিরে আসছে, তখন বেসরকারি মালিকানার পক্ষে এই সওয়াল পশ্চাৎপদ চিন্তার প্রতিফলন।
অতনু চক্রবর্তী
সভাপতি, অল ইন্ডিয়া সেন্ট্রাল কাউন্সিল অব ট্রেড ইউনিয়নস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy