Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Bengali

সম্পাদক সমীপেষু: জ্ঞানের পিপাসা

১৯৭৫ সালে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছিলাম, প্রধান বিভাগগুলিতে বাঙালির আধিপত্য। সংস্কৃতি ও শিক্ষার অহঙ্কার দোষের নয়।

An image of reading a book

হারিয়ে যাচ্ছে সেই জ্ঞানপিপাসু বাঙালি। ফাইল ছবি।

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০২৩ ০৫:৪৮
Share: Save:

সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘যাহা পায় তাহা খায়’ (১৬-৪) প্রবন্ধে যে বাঙালির কথা তিনি লিখেছেন, সেই বাঙালি বেছেবুছে খেত বলে সারা ভারতে নাম কুড়িয়েছিল। বাঙালি ঈর্ষার পাত্র হলেও সম্ভ্রম আদায় করে নিতে পেরেছিল। নবনীতা দেব সেনের লেখায় পড়েছিলাম যে, বিশ্বে এমন বিশ্ববিদ্যালয় সম্ভবত নেই যেখানে এক জন বাঙালি অধ্যাপক নেই। ১৯৭৫ সালে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছিলাম, প্রধান বিভাগগুলিতে বাঙালির আধিপত্য। সংস্কৃতি ও শিক্ষার অহঙ্কার দোষের নয়। অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, কেতকী কুশারি ডাইসন প্রমুখ বাঙালির জন্যে আজ আমাদের অহঙ্কার হয় না?

অতিমাত্রায় রবীন্দ্র-অনুরাগী বলে কেউ বিদ্রুপ করলেও বাঙালি ছিল অটল। রবীন্দ্রনাথ বাঙালিকে জিজ্ঞাসু করে তোলেন, সে পাঠ করে বিশ্ব সাহিত্য, ছবি দেখে রেনেসাঁস থেকে শুরু করে আধুনিকতম যুগের, ফিল্ম দেখে সারা পৃথিবীর, ফিল্ম-সোসাইটির আন্দোলনে মেতে ওঠে, নাটকে বিশ্বায়ন ঘটায়। বাঙালি জানার জন্যে ব্যাকুল, বিশ্বের যাবতীয় সাংস্কৃতিক মণিমুক্তোর সন্ধান পাওয়ার জন্যে ডুব দেয় গভীরতায়, সে শিক্ষিত হতে চায়, পয়সার জন্যে তার উৎকণ্ঠা নেই। কিন্তু হায়! হারিয়ে যাচ্ছে সেই জ্ঞানপিপাসু বাঙালি।

কলকাতায় আন্তর্জাতিক বইমেলা হয় ঠিকই, জেলাতেও হয়। কিন্তু সাহিত্যের আলোচনা তেমন মাতায় না। যেমন হত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, সমরেশ মজুমদার, বুদ্ধদেব গুহ, শঙ্খ ঘোষের সময়। সাহিত্য-বিমুখ বাঙালির বোধ ভোঁতা হতে বাধ্য। এখন সাহিত্যের নামে শুধু গোয়েন্দা গল্প, রান্নাবান্না, ঘর সাজানো ইত্যাদি। গোয়েন্দা-কাহিনি বিনোদন বটে, তবে মনের অসুখ লাঘব করতে পারে চলমান জীবন-জিজ্ঞাসার সাহিত্য। প্রকাশনায় এসে গেছে ‘প্রিন্ট অন ডিমান্ড’, অর্থাৎ ২৫ কপি বইও ছাপা হতে পারে।

সিনেমা ‘হিট’ করানোর জন্যে ভাল সাহিত্যের দরকার নেই। বিনোদনের ধারণাটাই বদলে যাচ্ছে। সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, দর্শকের রুচির জন্যে ছবির মান খাটো করা চলে না। থিয়েটারের অবস্থা ভাল নয়, যাত্রা তথৈবচ, বাংলা ভাষার প্রতি সচ্ছল বাঙালির উপেক্ষা, গল্পের খিদে মেটানোর জন্য সিরিয়াল-নির্ভরতা ইত্যাদি কারণে বাঙালির মননশীলতা নিম্নমুখী। টেলিভিশনের প্রভাবে ঘরে ঘরে মিশ্র সংস্কৃতি, যাতে থাকে অগভীর চটুলতা, পোশাকে খানিক পাশ্চাত্য, খানিক ভারতীয় কাটছাঁট, লেখাপড়াতে বাংলা ভাষার প্রতি আত্মঘাতী ঔদাসীন্য। ভাবখানা, বাঙালি আর প্রাদেশিক না, সে অনেক বড় ভারতীয়। তাতে আপত্তি নেই, কিন্তু শিকড়-বিচ্ছিন্ন হওয়া মানে বাংলা সংস্কৃতির অবলুপ্তি। পৃথিবীর অনেক ভাষা-সংস্কৃতি হারিয়ে যায় সবলের দখলদারিতে, এবং যথাসময়ে রুখে দাঁড়াতে না পারার জন্যে।

তরুণ কুমার ঘটক, কলকাতা-৭৫

ভ্রষ্টাচার

প্রেমাংশু দাশগুপ্তের চিঠির (প্রকট অসাম্য, ২৮-৪) সঙ্গে সহমত পোষণ করে আমার এই পত্রের অবতারণা। পত্রলেখক যথার্থ বলেছেন ‘ভারতের সম্মানহানি’ প্রবন্ধে প্রবন্ধকার স্বপ্নেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে দেশের সম্মান আর সরকারের সম্মান একাকার হয়ে গিয়েছে! প্রবন্ধকার মোদী ও বিজেপির কাজে আপ্লুত! বিজেপি-শাসিত রাজ্যে থেকে আমি বুঝি, বিজেপির সব স্লোগানই মিথ্যে। বিজেপি নাকি ‘ভ্রষ্টাচার’ খতম করবে! কিন্তু বিভিন্ন সরকারি অফিসে গেলে বোঝা যায়, ভ্রষ্টাচার রমরমিয়ে চলছে। টাকা ঘুষ না দিলে কোনও লাইসেন্স হয় না, অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীরা উপযুক্ত উপঢৌকন না দিলে পেনশন পান না। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় খেপে খেপে টাকা না দিলে ঘর দূর অস্ত্। পত্রলেখক আদানির অনাদায়ি ঋণের কথা উল্লেখ করেছেন। ভারতীয় উপমহাদেশের ব্যাঙ্কগুলোর অবস্থা করুণ করেছে এই আদানি, মেহুল চোক্সী— এঁদের মতো শিল্পপতি। তবুও যত দোষ ওই ব্যাঙ্কগুলোরই।

ভারতে অর্থনীতি এখন পুঁজিপতিদের হাতে। এ দেশের ১% ধনীর হাতে ৪০% সম্পত্তি বর্তমান। মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে ভারতের স্থান ১৩৯তম। ভারতের ধনিক শ্রেণির হাতে দেশের জিডিপি-র চাইতে কয়েক গুণ বেশি সম্পদ রয়েছে। সারদা কেলেঙ্কারির বহু নেতা লুণ্ঠন করে করে সাজা পাওয়ার ভয়ে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিয়ে বিজেপিতে ঢুকে কেউ মন্ত্রী, আবার কেউ বা মুখ্যমন্ত্রীও হয়েছেন। মোদীর মতে, রাহুল গান্ধীর বিদেশে গিয়ে বিজেপির সমালোচনা করা ‘দেশদ্রোহিতা’। কিন্তু মোদী যদি বিদেশ ভ্রমণ কালে দেশের বিরোধী পক্ষের সমালোচনা করেন, তাতে ‘দেশদ্রোহিতা’ হয় না! কিমাশ্চর্যম্! দেশের রাজনীতি ও অৰ্থনীতির বিকাশের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিজেপির ধর্মীয় বিভেদকামী নীতি। ভারতীয় জনতা পার্টির সরকারের পারফরম্যান্স-এর সামান্যতম সমালোচনা করলেই সর্বনাশ! কেননা, এতে গায়ে ‘দেশদ্রোহী’ তকমা এঁটে যাবে।

অসীম কুমার চক্রবর্তী, গুয়াহাটি, অসম

দীনেশচন্দ্র

অংশুমান ভৌমিকের ‘অবিভক্ত বাংলার উদার জীবনের প্রতিফলন’ (রবিবাসরীয়, ২৬-৩) শীর্ষক প্রবন্ধ সূত্রে কিছু কথা। নিঃসন্দেহে দীনেশচন্দ্র সেনের সুমহান কীর্তির অন্যতম নিদর্শন হল মূল্যবান ভূমিকা সম্বলিত মৈমনসিংহ-পূর্ববঙ্গগীতিকা’র সম্পাদনা। ময়মনসিংহের জলে-জঙ্গলে-হাওড়ে অনাদৃত অবস্থায় পড়ে থাকা লোকগাথা তাঁর উদ্যোগে-উৎসাহে বিশ্বের নানা স্থানে সমাদৃত হয়। হিন্দু-মুসলমানের অসাম্প্রদায়িক হৃদয়বৃত্তির অপূর্ব সমন্বয়বিশিষ্ট এ সব লোকগাথা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। সংগৃহীত এ সব পালার ইংরেজি অনুবাদ ইস্টার্ন বেঙ্গল ব্যালাডস পাঠে পাশ্চাত্যের পণ্ডিত-মনীষীরা উচ্ছ্বসিত ভাষায় তাঁকে অভিনন্দিত করেন। গাথার অনাবৃত সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ভগিনী নিবেদিতাও তাঁকে বলেছিলেন, “বড় বড় লম্বা শব্দ লাগাইয়া যাঁহারা মহাকবির নাম কিনিয়াছেন, পল্লীগাথার অমার্জিত ভাষার মধ্যে অনেক সময় তাঁহাদের অপেক্ষা ঢের গভীর ও প্রকৃত কবিত্ব আছে... তাহাদের মেঠো সুরে রাগিণী না থাকিলেও প্রাণ আছে, আর তাদের কুঁড়ে ঘরে সোনারূপার থাম না থাকিলেও আঙ্গিনায় সিউলি ও মল্লিকাফুলের গাছ আছে।” (দীনেশচন্দ্র সেন, ঘরের কথা ও যুগসাহিত্য)। অবশ্য বাংলাদেশের নানা মহলে গীতিকাগুলির প্রাচীনতা ও প্রামাণিকতা নিয়ে বিশেষ সংশয় উপস্থিত হয়েছিল। সুকুমার সেন-সহ নন্দগোপাল সেনগুপ্তও গীতিকায় হস্তক্ষেপ ঘটেছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তবে গীতিকার প্রাচীনত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেও নন্দগোপাল সেনগুপ্ত কাব্যধর্মে গীতিকার উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন। কবি জসিমুদ্দিনও প্রাথমিক ভাবে এ সব বিষয়ে সন্দিহান হলেও পরবর্তী কালে গানগুলির কবিত্ব গুণে মুগ্ধ হন এবং প্রামাণ্য বলে সাগ্রহে স্বীকার করেন।

আসলে আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন ছিলেন গভীর অনুভবী গবেষক, বরেণ্য ইতিহাসবিদ ও সাহিত্য সাধক। তিনি ধর্মসমাজ ইতিহাসভিত্তিক বাংলা সাহিত্যের যথাযথ ইতিহাস নির্ণয়ে সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর বঙ্গভাষা ও সাহিত্য পড়ে বিস্মিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “প্রাচীন বঙ্গসাহিত্য বলিয়া এতবড়ো একটা ব্যাপার যে আছে তাহা আমরা জানিতাম না”। সেই সঙ্গে ভারত উপনিবেশে দুয়োরানি বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল তাঁর হিস্ট্রি অব বেঙ্গলি লিটারেচার, দ্য বৈষ্ণব লিটারেচার অব মিডিয়েভাল বেঙ্গল, চৈতন্য অ্যান্ড হিজ় কম্প্যানিয়ন গ্রন্থসমূহ। একই সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতি ও জীবনচর্যার নিবিড় পরিচয়ে ঋদ্ধ তাঁর আর এক অসাধারণ সৃষ্টি হল রামায়ণী কথা। সেই পথেই এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেছিলেন গাথা-গীতিকার প্রচার-ব্যাখ্যানেও। আর আমরা মৈমনসিংহ-পূর্ববঙ্গগীতিকা’র মধ্য দিয়েই সন্ধান পেয়েছিলাম এক বিপুল গ্রামীণ ঐশ্বর্যের।

সুদেব মাল, খরসরাই, হুগলি

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy