মোহিত রায় লিখিত প্রবন্ধ ‘প্রশ্নটা রাজনীতির আদর্শের’ (৩-৫) বিষয়ে এই চিঠি। রাজনীতি সময় ও সমাজের ফসল। তা লক্ষ্যের দিকে চালিত হয় নেতৃত্বের কৃতিত্বে। ব্রিটিশরা যখন জাঁকিয়ে বসেছে এ দেশে, তখন প্রথমেই ‘ভারত ছাড়ো’ বা পূর্ণ স্বরাজের দাবি ওঠেনি। মতিলাল নেহরু, বদরুদ্দীন তৈয়বজি প্রমুখ স্বশাসনের দাবি তুলেছিলেন। এ ভাবে নরমে গরমে চলতে চলতে ব্রিটিশ-ঘেঁষা উচ্চশিক্ষিত ভারতীয়রা প্রথমের দিকে খুব কড়া বিরোধিতা করেননি। এই এলিট শ্রেণির মধ্যে জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসুরা পড়লেও পরবর্তী কালে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সুভাষের মতপার্থক্য শুধু যে ছিল তা নয়, ধীরে ধীরে তা বাড়তেও থাকে।
প্রথম দিকে কিঞ্চিৎ বিচ্ছিন্ন ভাবে হলেও গান্ধী যখন ভারতে এলেন, স্বাধীনতার আন্দোলন ভিন্নমাত্রা পেল। গান্ধী তো শুধুমাত্র রাজনীতিক নন, একই সঙ্গে দার্শনিকও। তাঁর মাধ্যমে দেশের মানুষ একটা দাঁড়ানোর জমি পেলেন। যা-ই হোক, স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত সামাজিক আন্দোলনের লক্ষ্য মোটামুটি ভাবে একমুখীই ছিল বলা যায়। একে অপরের প্রতি নেতৃবৃন্দের শ্রদ্ধা এবং স্নেহের সম্পর্কও ছিল।
স্বাধীনতা লাভের পর্বে দেশভাগের দাঙ্গা ও তার পরিণতিতে শরণার্থী আগমন দেশকে ক্রমশ বিপর্যস্ত করে তোলে। ইতিহাস বলে, জওহরলাল নেহরু বাংলার শরণার্থী মোকাবিলার জন্য ততটা সক্রিয় হননি, যতটা হয়েছিলেন পঞ্জাবের ক্ষেত্রে। গান্ধী ও নেতাজির অনুপস্থিতি সমস্যা আরও জটিল করে তোলে। অনেক আঞ্চলিক ও প্রাদেশিক দল যেমন গজিয়ে ওঠে, তেমনই উঠে আসেন সেখানকার নেতারা। এক সময়ে যে ঐক্য এবং জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে ছোটখাটো ভিন্নতা ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়া যেত, সেই পরিস্থিতি আর রইল না। নেতৃত্বের ক্ষুদ্র ও ব্যক্তিস্বার্থ এসে গেল। বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে অ্যাজেন্ডা-ভিত্তিক রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হল। সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে যেমন নেতারা উঠে এলেন, মানুষ সরিয়ে দিলেন আগেকার মতো উচ্চশিক্ষিত এলিট নেতাদের। পরিবর্তে স্থানীয় ও স্বল্পমেয়াদি উদ্দেশ্য পূরণ অগ্রাধিকার পেল। আদর্শের উপর নির্ভর করা কোনও গভীর সমাজবোধের আর জায়গা হল না। কেননা তত দিনে সময় সমস্যা ও জটিলতা নিয়ে ভারাক্রান্ত।
তনুজ প্রামাণিক, হাওড়া
অশ্রদ্ধা
‘জিঘাংসার ভাষা’ (৪-৫) শীর্ষক সুচিন্তিত ও সময়োপযোগী সম্পাদকীয় পাঠ করে বিস্মিত হলাম। কেন্দ্রীয় শাসক দলের দুই সুপরিচিত মন্ত্রীর মুখে বিরোধীদের উল্টো করে ঝুলিয়ে সোজা করার কথা ঘোষিত হয়েছে। এই রকম হুমকিমূলক বাক্য উক্ত নেতাদের অভ্যন্তরীণ হিংস্রতাকে প্রকাশ করে না কি? সারা দেশে যখন দফায় দফায় ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া চলছে, তখন বাকি ভোটগ্রহণ পর্ব রক্তপাতহীন, শান্তিপূর্ণ হোক— এটা সমগ্র দেশবাসীর একান্ত কামনা। কিন্তু এই কামনা বাস্তবায়িত করতে যাঁদের একেবারে পুরোভাগে থেকে উদ্যোগ করা উচিত, তাঁদেরই এই রকম বেহিসাবি ব্যবহার সাধারণ মানুষের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে। সংবাদপত্র বা বৈদ্যুতিন মিডিয়া খুলে আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি, তাঁদের একটা সুবৃহৎ অংশ নির্বাচনী প্রচারকে উপলক্ষ করে পরস্পরের প্রতি যে ধরনের অসম্মানজনক ও উস্কানিমূলক কটূক্তি প্রয়োগ করে চলেছেন, তা সমগ্র দেশবাসীর পক্ষে খুবই লজ্জাজনক। কিন্তু ওঁরা এই রকম কটু শব্দ বা বাক্য প্রয়োগ করে বিন্দুমাত্র লজ্জিত না হয়ে, বরং গর্বিত বোধ করেন, যা আমাদের কাছে হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
রাজনীতিতে আসা সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গও যখন তাঁদের নিজস্ব পেশাদারি ক্ষেত্রের কথা ভুলে গিয়ে, পরস্পরের প্রতি অশ্রদ্ধাজনক কটুবাক্য প্রয়োগ ও কাদা ছোড়াছুড়িতে লিপ্ত হয়ে পড়েন, তা তাঁদের নিম্নরুচির পরিচয় বহন করে। পরস্পরকে ‘তুই’ সম্বোধন, বিরোধীদের পশুদের সঙ্গে তুলনা করা, মৃত্যু কামনা করা ইত্যাদি তাঁদের মুখে সত্যিই বেমানান লাগে। নির্বাচনী প্রচারের নামে অপশব্দের এমন প্রাচুর্য, সমগ্র দেশের রাজনৈতিক সাম্য ও শান্তি রক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিকূল বাতাবরণ সৃষ্টি করে। প্রশ্ন থেকে যায়, নেতারাই যদি এই ভুল পথের প্রদর্শক হন, তা হলে তাঁদের দ্বারা প্রভাবিত আমজনতার মধ্যে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পেলে তার দায়ভার কে গ্রহণ করবে?
অতীতে রাজনৈতিক বিশিষ্টজনদের মধ্যে অনেক প্রতিযোগিতা, রেষারেষি দেখা গেলেও বিরোধী দলনেতাকে আক্রমণ করার আগে, বাগ্যুদ্ধ করতে গিয়ে পরস্পরের প্রতি অশ্রদ্ধা কখনও প্রকাশ পেত না। কিন্তু এখনকার নেতাদের মধ্যে অপশব্দ প্রয়োগের যে ভয়াবহ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা সামগ্রিক ভাবে দেশের রাজনীতির মানকে ভীষণ ভাবে কলুষিত করে দিচ্ছে। তাঁদের সরাসরি প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয় যে, এ ভাবে দেশের রাজনৈতিক সম্মান ও ঐতিহ্যকে ধূলিসাৎ করার অধিকার আপনাদের কে দিল? আপনারা কি এইটুকুও জানেন না যে, নির্বাচনী আচরণবিধি অনুসারেও ব্যক্তিগত আক্রমণ বা বিদ্বেষমূলক প্রচার নিষিদ্ধ? আপনাদের এই অনৈতিক ও রুচিহীন আচরণ, নব প্রজন্মের কাছে কী বার্তা বহন করে নিয়ে যাচ্ছে?
পরিশেষে, দেশের সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকের তরফ থেকে সকল রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে আমার অনুরোধ, শেষ কয়েক দফার নির্বাচন প্রক্রিয়াগুলিকে অহিংস ও শান্তিপূর্ণ রাখতে, পরস্পরের প্রতি অপশব্দের প্রয়োগ ও উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলা থেকে বিরত থাকুন ও ভারতবর্ষে একটা সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ বজায় রাখতে সচেষ্ট হন। এটুকু পরিমিতি বোধের পরিচয় যদি দিতেই না পারলেন, তা হলে অসামাজিক দুষ্কৃতীদের থেকে আপনাদের পার্থক্য থাকল কোথায়?
শান্তনু ঘোষ, শিবপুর, হাওড়া
অপভাষা
এ রাজ্যের সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, বিবেকবান মানুষের মনের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে ‘জিঘাংসার ভাষা’ শীর্ষক সম্পাদকীয়ের মধ্যে। নির্বাচন এলেই রাজনীতিবিদরা অকথা, কুকথার বন্যা বইয়ে দেন। নির্বাচন এলেই তাঁরা ধর্মকে টেনে নিয়ে আসেন। তথাকথিত বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলির নির্বাচনী বক্তব্যে বিপক্ষের প্রতি শালীনতা, ভদ্রতা, সৌজন্যের লেশমাত্র থাকে না। সংখ্যালঘু, দলিত সম্প্রদায়ের মানুষজনকে তাঁরা আতঙ্কিত করে তোলেন। আসলে ভোট বড় বালাই। যেন তেন প্রকারেণ ক্ষমতা দখল করতে হবে, মসনদ চাই। ফলে অর্থের জোরে, পেশিশক্তির জোরে, মিডিয়ার দৌলতে প্রচারসর্বস্ব রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ, যা রাজনীতির আঙিনাকে ক্রমশ কলুষিত করছে আর সাধারণ মানুষকেও রাজনীতি সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ করে তুলছে।
অতীতে এ রাজ্যে ও ক্ষমতার দম্ভে আমরা শুনেছি, ‘আমরা দু’শো পঁয়ত্রিশ, ওরা পঁয়ত্রিশ’। বর্তমানে রাজ্যের শাসক দল ‘বদলা নয় বদল চাই’ স্লোগান দিয়ে শুরু করে আজ সর্বক্ষেত্রে পূর্বতন সরকারের পদাঙ্ক অনুসরণ করছে। কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি তো গণতান্ত্রিক সমস্ত রীতিনীতিকে পদদলিত করছে, একই সঙ্গে ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামি, কুসংস্কারের প্রসার ঘটাচ্ছে। মানুষের ধর্মীয় আবেগকে উস্কে দিয়ে ধর্মীয় উন্মাদনার সৃষ্টি করে মানুষজনকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলছে। ঘৃণা ভাষণে আকাশ-বাতাস ভরিয়ে তুলছে।
রাজনৈতিক নেতারা একদা সমাজের অভিভাবক হিসেবে গণ্য হতেন। তাঁদের সাধারণ মানুষ অনুসরণ করত। গান্ধীজি, নেতাজি, দেশবন্ধুর মতো নেতা বরেণ্য। কিন্তু বর্তমানে বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলিতে নীতি, নৈতিকতা, আদর্শ, মূল্যবোধের বড়ই অভাব।
এ যুগের এক মহান দার্শনিকের কথায়, ‘রাজনীতি হৃদয়বৃত্তির কারবার’। কোথায় হৃদয়বৃত্তি? কোথায় দরদ বোধ, সহানুভূতি অগণিত সাধারণ মানুষের প্রতি? আছে নাকি!
স্বপন মুনশি, দুর্গাপুর, পশ্চিম বর্ধমান
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy