Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Tarja

সম্পাদক সমীপেষু: তরজার ঐতিহ্য

বেতারে তরজা গানের আসর এখনও প্রচারিত হয়। পৌরাণিক বিষয়ে বিশেষ ব্যুৎপত্তি ও কবিত্বশক্তি থাকলে তবেই তরজা গানে অংশগ্রহণ করা যায়।

A Photograph of a rally

সরকারি কর্মচারী ও শিক্ষকদের ডিএ বিষয়ে যদি শালীনতা বজায় রেখে পক্ষে ও বিপক্ষে প্রশ্ন ওঠে, তা কেন কুতর্ক হবে? ফাইল ছবি।

শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০২৩ ০৪:১৩
Share: Save:

‘হাতে রইল তরজা’ (১০-৩) সম্পাদকীয়তে ‘তরজা’-কে কুতর্কের সমার্থক হিসেবে লেখা হয়েছে। কিন্তু তরজা বাংলার প্রাচীন লোকসঙ্গীত বিশেষ। আজ আর তরজা গানের আসর বিশেষ দেখা যায় না। কিন্তু একদা গ্রামাঞ্চলে দুই কবি দলের মধ্যে তৎক্ষণাৎ গান রচনা করে উত্তর-প্রত্যুত্তরের লড়াই হত, যা তরজা গান নামে পরিচিত। এন্টনী ফিরিঙ্গী চলচ্চিত্রে তরজা গানের আসরের নিদর্শন আছে। বেতারে তরজা গানের আসর এখনও প্রচারিত হয়। পৌরাণিক বিষয়ে বিশেষ ব্যুৎপত্তি ও কবিত্বশক্তি থাকলে তবেই তরজা গানে অংশগ্রহণ করা যায়। বর্তমানে টিভি চ্যানেলে ও সভা মঞ্চে যে ‘কুতর্ক’ চলে, তার সঙ্গে তরজার কোনও তুলনাই হয় না। প্রসঙ্গত, অমর্ত্য সেন তাঁর তর্কপ্রিয় ভারতীয় বইতে লিখেছেন, কী ভাবে সেই প্রাচীনকাল থেকে মূলধারাকে প্রশ্ন করতে করতে এ দেশের সমাজ এগিয়েছে। সুতরাং, সরকারি কর্মচারী ও শিক্ষকদের ডিএ বিষয়ে যদি শালীনতা বজায় রেখে পক্ষে ও বিপক্ষে প্রশ্ন ওঠে, তা কেন কুতর্ক হবে? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তথ্য ও তত্ত্ব সহযোগে বিতর্ক থেকেই সমস্যার সমাধান তৈরি হতে পারে। আলোচ্য সম্পাদকীয়তে যথার্থই প্রশ্ন করা হয়েছে, কোন যুক্তিতে সরকারি কর্মীরা দেশের আটানব্বই ভাগ কর্মীর চেয়ে আলাদা হবেন, কেন তাঁদের কাজের পরিমাণ ও গুণগত মানের সঙ্গে বেতনের ন্যূনতম সম্পর্কটুকুও থাকবে না? এ দেশে কর্মদক্ষতার সঙ্গে সরকারি কর্মচারীদের বেতনবৃদ্ধির যেমন কোনও সাযুজ্য নেই, অনুরূপ ভাবেই ছাত্রদের কৃতকার্যতা বা অকৃতকার্যতার সঙ্গে সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনেরও পরিমাপ হয় না। এক বার সরকারি কোনও পেশায় প্রবেশ করতে পারলেই কেল্লা ফতে। তখন কাজের প্রতি দায়বদ্ধতার সঙ্গে কর্মীর সংযোগও থাকে না। দীর্ঘ দিন বাম শাসন কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন শেখালেও কর্তব্যের পাঠ শেখাতে পারেনি। দুর্ভাগ্যবশত বাম সংস্কৃতির সেই ধারা এখনও বহমান।

কৌশিক চিনা, মুন্সিরহাট, হাওড়া

মূল গভীরে

মহার্ঘ ভাতা প্রসঙ্গে সম্পাদকীয়টি (হাতে রইল তরজা) শুরুতে সাড়া জাগিয়েও কেমন খাপছাড়া লাগল। শুরুটা চমৎকার, “রাজনীতির এক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে— অহেতুক তরজায় জড়িয়ে তা মূল প্রশ্নটিকে বেমালুম ভুলিয়ে দিতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের কার্যত প্রতিটি মুহূর্তই সেই অনন্ত তরজার সাক্ষী।” কিন্তু তার পরেই অবান্তর ভাবে আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে ওঠে ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ সেই সরকারি কর্মচারী। যেমন এক জায়গায় বলা হয়েছে, “সরকারি কর্মীরা সমাজের নিরাপদতম শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। তাঁদের স্বার্থ রক্ষার চেয়ে প্রান্তিক, বিপন্ন মানুষের স্বার্থরক্ষা রাষ্ট্রের অধিকতর কর্তব্য কি না, সেই আলোচনাও জরুরি।” এ-ও তো তরজার নামান্তর। আটানব্বই শতাংশের মহার্ঘ ভাতা নেই বলে কি ডিএ আটকে যাবে? সুদীর্ঘ কাল ধরে আইনি আন্দোলনের মাধ্যমে যে অধিকারগুলি সরকারি কর্মীরা অর্জন করেছেন, সেগুলি তুলে দিলেই বুঝি সব ল্যাঠা চুকে যাবে? যদিও বলা হয়েছে যে, সরকারি কর্মীদের বেতন বৃদ্ধি প্রয়োজন। কিন্তু শর্তসাপেক্ষে আচরণবিধি মেনে।

বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে কর্মক্ষেত্রে চালচিত্রটা হতাশাব্যঞ্জক। এখানে শিক্ষিত বেকারের গড়াগড়ি। শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি। সরকারি অফিসগুলোতে শূন্য পদের ছড়াছড়ি। অনেক শিক্ষিত বেকার আছেন, যাঁরা অবসরপ্রাপ্ত বাবা-মার উপার্জিত সামান্য আয়ের উপর নির্ভরশীল। তাই বকেয়া ডিএ-র দাবি ন্যায্য, অযৌক্তিক নয়। আর এটা নিছক রাজনৈতিক তরজারও বিষয় নয়, এই সঙ্কটের গভীরে রয়েছে এ রাজ্যের বিপর্যস্ত আর্থ-সামাজিক নানা সমস্যা। এ বিষয়টা নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় আসতে চলেছে। সরকার কী ভাবে সামলায়, সেটাই দেখার।

দীপককুমার দাস, কৃষ্ণনগর, নদিয়া

দাম বাড়ছে

‘হাতে রইল তরজা’ সম্পাদকীয়তে সরকারি কর্মীদের বেতন বৃদ্ধির বিরোধিতা করা হয়েছে। প্রশ্ন হল, বেসরকারি বা অসংগঠিত ক্ষেত্রে কি সময়ের সঙ্গে পারিশ্রমিক বাড়েনি? লেবার-মিস্ত্রি সবারই মজুরি সময়ের সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সঙ্গে নির্মাণসামগ্রী, জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, গাড়ির দাম বাড়ছে। লেখাপড়ার খরচ বাড়ছে। বেড়াতে যাওয়ার খরচ বাড়ছে। সে ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির দাবি কি অযৌক্তিক? অন্যান্য রাজ্য সরকার ডিএ দিতে পারলে এ রাজ্য সরকার কেন পারবে না? মানছি সব সরকারি কর্মী সমান দক্ষ নন, কিন্তু সরকারি প্রকল্পগুলির বাস্তব রূপায়ণ তাঁরাই করেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বুথে বুথে ভোট গ্রহণ তাঁদেরই করতে হয়।

সুজয় চন্দ, রায়গঞ্জ, উত্তর দিনাজপুর

দ্বিচারিতা

‘ডিএ-র দাবি কেন?’ (সম্পাদক সমীপেষু, ৯-৩) শীর্ষক বরুণ মণ্ডলের চিঠি প্রসঙ্গে দু’টি বিষয় নিয়ে কিছু না বললেই নয়। প্রথমত, ডিএ বা অর্থের আধিক্য/ অভাবের সঙ্গে সততা-দুর্নীতির সম্পর্ক নেই। যে কর্মী সৎ ও নিষ্ঠাবান, তিনি শূন্য শতাংশ ডিএ পেলেও ১০০ শতাংশ সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে যাবতীয় কর্তব্য নিখুঁত ভাবে সম্পন্ন করে যাবেন। অপর দিকে, যিনি স্বভাবে অসৎ ও বিবেকবোধহীন, তিনি কেন্দ্রীয় হারে ডিএ পেলেও উৎকোচ দাবি করবেন, এবং অফিসের কর্তব্যে অবহেলা করবেন। এই বিষয়ে শেষ কথা হল ব্যক্তিগত চরিত্র, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আর্থিক প্রতিপত্তি বা দারিদ্র নয়। বহু অর্থবান আমলা বা ধনকুবের ব্যবসায়ী/ শিল্পপতি চূড়ান্ত দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। আবার সংবাদে প্রকাশ, রিকশাচালক বা বাস কন্ডাকটর কুড়িয়ে-পাওয়া টাকার ব্যাগ বা গয়নাভরা ব্যাগ পুলিশ স্টেশনে গিয়ে জমা দিচ্ছেন। সুতরাং, সরকার ভাতা প্রদান করছে না বলে জনগণের থেকে অবৈধ অর্থ সংগ্রহে বাধ্য হব, এটা যদি কোনও কর্মীর ‘জীবন আদর্শ’ হয়; তার জন্য দায়ী শুধুমাত্র তাঁর ঘৃণ্য মানসিকতা, সরকারের ডিএ নীতি নয়। ডিএ সংক্রান্ত ক্ষোভের উদ্গিরণ যেন জনগণ বা নাগরিকের উপর না হয়, সে সম্বন্ধে সর্বদা সতর্ক থাকা উচিত।

দ্বিতীয়ত, যে কোনও কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত— সমস্ত জনগণকে বিনামূল্যে বা যৎসামান্য অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য ইত্যাদির সুরক্ষা প্রদান করা। পশ্চিমের বা প্রথম বিশ্বের তথাকথিত ধনতান্ত্রিক, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি নাগরিকদের জন্য যে কী পরিমাণ ভর্তুকি/ অনুদান প্রদান করে, তা ভারতীয়রা কল্পনাই করতে পারবে না! সুতরাং, ভারতের মতো দেশে কেন্দ্রীয় সরকার তথা প্রতিটি রাজ্য সরকারের প্রধান কর্তব্য হল, যত বেশি সম্ভব উন্নয়নমূলক প্রকল্পের সাহায্যে নিম্নবিত্ত মানুষদের সহায়তা করা। আর এই ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সত্যিই অসাধ্য সাধন করে চলেছে, বিভিন্ন মানবিক প্রকল্প অবলম্বনের মাধ্যমে। কেন্দ্র তথা দেশের প্রতিটি রাজ্য সরকারের উচিত, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে মানবিকতার পাঠ গ্রহণ করা।

আমরা পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যে বাস করি, কিন্তু ভারতের নাগরিক, পশ্চিমবঙ্গ যার নিছক এক অঙ্গরাজ্য মাত্র। তাই আমাদের স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারকেও যেমন নিজের প্রাপ্য অর্থ পাওয়ার জন্য কেন্দ্রের দয়া-দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভর করে থাকতে হয়, তেমনই দিল্লিতে ‘সরকারি টাকার মোচ্ছব’ হলে ভারতীয় হিসেবে বাংলার জনগণও আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন বইকি! কিন্তু এই সম্বন্ধে আমরা অন্ধ ও মৌন, বোধ হয় ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে অভিযুক্ত হওয়ার আশঙ্কায়। আর বাংলার দরিদ্র মানুষের জন্য নেওয়া কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলিকে দু’হাত তুলে সমর্থন না করে ‘দান খয়রাত’ আখ্যায় ভূষিত করে প্রতিনিয়ত আমরা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে চলেছি! দ্বিচারিতারও একটা সীমা থাকা উচিত।

কাজল চট্টোপাধ্যায়, সোদপুর, উত্তর ২৪ পরগনা

অন্য বিষয়গুলি:

Folk Songs Argument
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy