শ্রীঅরবিন্দ।
সায়ম বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আশ্চর্য আধুনিক ছিলেন’ (১৩-৮) শীর্ষক প্রবন্ধটিই অত্যন্ত আধুনিক, এবং মৌলিকও। যে মৌলিকতা জন্ম নেয় স্বচ্ছ দৃষ্টি, অপক্ষপাত অনুধ্যান ও সাহস থেকে। এমন নয় যে, এই যোগ-বিপ্লবীকে নিয়ে ইতিপূর্বে ভাল লেখা হয়নি। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেখানে হয় অরবিন্দ ভাববিহ্বলতায় পূজিত হয়েছেন, নয়তো নিন্দিত হয়েছেন মূঢ় মূল্যায়নে। এই প্রথম একটা লেখা পড়লাম, যেখানে শ্রীঅরবিন্দের জীবন-ইতিহাস বা যোগের কূট ব্যাখ্যায় না গিয়ে লেখক তাঁকে নিয়ে সাধারণ মানুষের ভ্রান্তি অপনোদন করতে পেরেছেন। তার জন্য জীবন ও যোগের প্রসঙ্গ স্বাভাবিক ভাবেই এসেছে, কিন্তু তা কখনওই পরিচয়ের ছবিকে আড়াল করেনি। শ্রীঅরবিন্দের চোখে ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার, তা সত্ত্বেও তাঁর হাতে এখন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে হিন্দুত্বের পতাকা! লেখক এই কথাটি তুলে ধরেছেন নম্র সাহসিকতায়।
বস্তুত শ্রীঅরবিন্দের গোটা জীবনই হল এক অনাগত আধুনিকতার অভিজ্ঞান। তাঁর দৈনিক জীবন, তাঁর রসবোধ এই কথাই বলে। পুদুচেরিতে একটা সময় অবধি যিনি বিদ্যুতের মিটার রিডিং নিজে নোট করতেন, বা ঘুমন্ত চড়াই পাখির যাতে ঘুমে ব্যাঘাত না হয় সে জন্য সতর্ক করে দিতেন, তিনি আধুনিক ছাড়া আর কী?
যখন অরবিন্দ কারও মুখে শুনলেন গান্ধী বলেছেন তিনি জন্মনিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে কেননা তা কৃত্রিম, তখন এই প্রগাঢ় রসিক বলে ওঠেন, তাতে কী? “সিভিলাইজ়েশন ইজ় আর্টিফিশিয়াল, সো ইজ় গান্ধীজ় লয়েন-ক্লথ!” (সভ্যতা কৃত্রিম, গান্ধীর বসনও তা-ই)। ইনি আধুনিক ছাড়া আর কী?
সুরঞ্জন চৌধুরী, কলকাতা-৯৭
‘লহ নমস্কার’
‘আশ্চর্য আধুনিক ছিলেন’ প্রবন্ধসূত্রে কিছু কথা। শ্রীঅরবিন্দ ছিলেন বিপ্লবের অগ্নিগোলক, আবার যোগদীপ্তিতে উজ্জ্বল জ্যোতির্ময় পুরুষ। বিলেতে থাকাকালীন তিনি সঙ্কল্প করেছিলেন, ভারতের স্বাধীনতা অর্জনই হবে তাঁর জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য; দেশের মুক্তির জন্য তিনি জীবন উৎসর্গ করবেন। তাই লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেও ঘোড়ায় চড়ার পরীক্ষার দিন অনুপস্থিত থেকে স্বেচ্ছায় তিনি আইসিএস হওয়ার প্রলোভন ত্যাগ করতে পেরেছিলেন। পিতার ইচ্ছানুসারে তাঁর আর পুরোদস্তুর ‘ইংলিশম্যান’ হয়ে ওঠা হয়নি।
কেমব্রিজে পড়ার সময়েই অরবিন্দ ভারতীয় ছাত্রদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে ভাষণ দিতেন ‘ভারতীয় মজলিশ’-এ। দেশে ফিরে বরোদা কলেজে অধ্যাপনার সঙ্গে বিপ্লবমন্ত্রেও দীক্ষিত হয়েছিলেন। অরবিন্দ তাঁর বিরাট রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ঘটিয়েছিলেন আধ্যাত্মিকতার সংমিশ্রণ। আলিপুর জেলে কারাবাস অধ্যায়ের শুরুতেই স্বতোৎসারিত উচ্ছ্বাসে শ্রদ্ধা জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লহ নমস্কার।/ হে বন্ধু, হে দেশবন্ধু, স্বদেশ-আত্মার/ বাণী-মূর্ত্তি তুমি। তোমা লাগি নহে মান,/ নহে ধন, নহে সুখ...” যৌবনকালে আন্দোলনের মধ্যেও রবীন্দ্রনাথ তাঁকে তপস্যার আসনে দেখেছিলেন।
ত্যাগী, নির্ভীক, স্বদেশপ্রেমী শ্রীঅরবিন্দ তাঁর অসাধারণ লেখনী শক্তি দিয়েও মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। আবার যোগসাধনায় অর্জিত শক্তিকে প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন দেশের স্বাধীনতার জন্য, যা তাঁর অন্তর জীবনকে উদ্ভাসিত করেছিল। সেই সঙ্গে তিনি চেয়েছিলেন মানুষের পূর্ণতা লাভ, আর চেতনার রূপান্তর ঘটাতে। প্রসঙ্গত, শ্রীঅরবিন্দের ভক্ত-শিষ্য দিলীপ কুমার রায় তাঁর যুগর্ষি শ্রীঅরবিন্দ গ্রন্থে লিখেছেন, “শ্রীঅরবিন্দের কথা যখন ভাবি তখন সব আগে মনে হয় আমার, তাঁর অপার স্নেহ কোমলতার কথা, তারপরে তাঁর তুঙ্গ প্রজ্ঞার, যার জ্যোতি তাঁর অজস্র নিবন্ধে কাব্যে ও পত্রাবলিতে যেন বান ডাকিয়ে চলেছে পদে পদে চমকে দিয়ে। এছাড়া ভাবতেও অবাক লাগে তাঁর অটল ইচ্ছাশক্তি ও আশ্চর্য ব্যক্তিরূপের কথা...।” তাঁর মধ্যে সর্বদুঃখজয়ী মানবাত্মার প্রকাশ ঘটেছিল।
সুদেব মাল, হুগলি
আগামীর নায়ক?
শ্রীঅরবিন্দের রহস্যময় রূপান্তর অগ্রাহ্য ও অস্বীকার করে সায়ম বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন, “অরবিন্দ ঘোষ আর শ্রীঅরবিন্দ কোনও খণ্ডিত, বিভাজিত ব্যক্তি নন।” তাঁকে মূল ধারার রাজনীতিতেও এক অকৃত্রিম আদিপুরুষ বলে চিহ্নিত করেছেন, গান্ধীজির অহিংসার সঙ্গে অরবিন্দের ‘সহিংস প্রতিবাদ’-এর সূক্ষ্ম পার্থক্য দেখিয়েছেন, আমাদের অচলায়তন সভ্যতা, ধর্মের বাহ্যিক গোঁড়ামি ইত্যাদি ‘ক্ষণিক উন্মাদনার তরঙ্গ’ ইত্যাদির কথাও উল্লেখ করেছেন। লেখক প্রবন্ধে আরও উল্লেখ করেছেন, “তিনিই হয়ে উঠবেন আগামীর চালক, ‘দ্য মাস্টার অব দ্য ফিউচার’।” কিন্তু দেখা যাচ্ছে, অরবিন্দের রাজনীতি ত্যাগ ও সমগ্র জীবনের (১৮৭২-১৯৫০, ৭৮ বছর) বাকি অর্ধেক (১৯১০-১৯৫০, ৪০ বছর) ‘দ্য মিস্ট্রি অব দ্য ফিউচার’হয়ে গেল।
আর ঋষি শ্রীঅরবিন্দ ‘আগামীর চালক’ হয়ে উঠলেন কী করে? কারণ তা হলে পাঁচ বছর বাদে গোপালকৃষ্ণ গোখলের অনুরোধে দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ়ের মাধ্যমে ‘জাতির জনক’ মহাত্মা গান্ধীর ভারতে আসা ও স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া অস্বীকার করা হয়। অস্বীকার করা হয় বিপ্লবী রাসবিহারী বসুকে, যিনি ১৯১৫ সালে জাপানে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করবেন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (১৯৪২), যা তুলে দেবেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে।
অস্বীকার করা হয় সুভাষচন্দ্র বসুর অবদানের কথা, যিনি ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও জাতীয় কংগ্রেসে যুক্ত হয়ে গিয়েছেন। পাশাপাশি অস্বীকার করতে হয় জওহরলাল নেহরু-সহ অসংখ্য কংগ্রেসি নেতৃত্বের কথাও, যাঁদের সমাজতন্ত্র, বামপন্থার দিকে ঝোঁক ছিল। ১৯১০-পরবর্তী বাংলা, মহারাষ্ট্র, পঞ্জাবের বিপ্লবীদের সশস্ত্র সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ, আদিবাসী বিদ্রোহ, সিপাহি বিদ্রোহ, নৌ বিদ্রোহ, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ, এ সবই তা হলে খারিজ করতে হয়। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম এই সব ধারার মিলিত ফল, যেখানে কোনও এক জন অরবিন্দ ঘোষ ‘আগামীর নায়ক’ হতে পারেন না।
শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি
কে বলেছিলেন?
সায়ম বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রীঅরবিন্দকে শ্রদ্ধার সঙ্গে বোঝার চেষ্টা করেছেন। এ জন্য তাঁর সাধুবাদ প্রাপ্য। তবে তাঁর লেখায় গোপালকৃষ্ণ গোখলে-কথিত যে উক্তিটি— ‘হোয়ার বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে, ইন্ডিয়া থিঙ্কস টুমরো’— তিনি উদ্ধৃত করেছেন, তার সূত্র কী, তিনি জানাননি। আমি ভারতীয় মহাফেজখানা-সহ নানা গ্রন্থাগারে খোঁজ করেছি, কিন্তু মহামতি গোখলে এমন কিছু কখনও বলেছেন বলে খুঁজে পাইনি। ‘গোখলে পেপার্স’-এও এমন কোনও তথ্য পাইনি। ফলে, গোখলে-র মুখে এই বহুল প্রচারিত বাক্যটি কী ভাবে এল, তা রহস্য থেকে গিয়েছে।
তবে খুঁজতে গিয়ে দেখছি, ২৩ জুন, ১৯০৯ অবিভক্ত বাংলার বাকরগঞ্জে অরবিন্দ একটি বক্তৃতা দেন। সেখানে তিনি বলেন, “বিকজ় বেঙ্গল লিডস, অ্যান্ড হোয়াট বেঙ্গল ডাজ় টুডে দ্য রেস্ট অব ইন্ডিয়া উইল ডু টুমরো (কারণ, বাংলা নেতৃত্ব দিচ্ছে, আর বাংলা আজ যা করে, বাকি ভারত কাল তা করবে)। এ থেকে ধারণা হয়, হয়তো অরবিন্দর কথাটিই কোনও ভাবে বদলে গিয়ে গোখলের মুখে বসে গিয়েছিল। কারণ, তার আগে বা পরে, কখনওই কোনও কংগ্রেস অধিবেশনে এ রকম কিছু আলোচিত বা বলা হয়নি। তবে ১৮৯৪ সালে বঙ্কিমচন্দ্র বিষয়ে ‘আওয়ার হোপ ইন দ্য ফিউচার’ নামে একটি প্রবন্ধে একই ধরনের কথা লিখেছিলেন অরবিন্দ, তা প্রবন্ধকার সঠিক ভাবেই জানিয়েছেন।
নির্মাল্য মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-২৬
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy