দিদিমণি ক্লাসরুম থেকে বেরোতেই ডেস্কে খবরের কাগজ পেতে মাখা হত ঝালমুড়ি। ফাইল চিত্র।
ঈশা দাশগুপ্তের ‘দিন বদলের ছবি পিকনিকে’-র (৪-৩) রেশ ধরে কিছু কথা মনে পড়ে গেল। গার্লস স্কুলের কঠোর অনুশাসনে বড় হওয়া আমি আর আমার বন্ধুদের টিফিন ভাগ করে খাওয়ার দিনগুলোতে কখনও কখনও ঝালমুড়ি ফিস্ট করতাম। শশা-গাজর কুচি, পেঁয়াজকুচি, আমতেল, আচার, আলুসেদ্ধ, ঝাল চানাচুর, লঙ্কা, ঝালমুড়ি মশলা এক-এক জনের টিফিনবক্সে সওয়ার হয়ে বাড়ি থেকে স্কুলে এসে পৌঁছত। উচাটন মন সকাল থেকে অপেক্ষা করত ওই মিনিট কুড়ির টিফিন টাইমের জন্য।
দিদিমণি ক্লাসরুম থেকে বেরোতেই ডেস্কে খবরের কাগজ পেতে মাখা হত ঝালমুড়ি। আমতেল আর পেঁয়াজ-লঙ্কার ঝাঁঝে ক্লাসরুম ম-ম করত। কুড়ি মিনিট যে বড্ড কম, তা মালুম হত তখনই, যখন মুড়ির পাহাড় ডিঙোতে গিয়ে জিভে লঙ্কা লেগে সকলের চোখের জলে-নাকের জলে হতে হত। ঘণ্টা পড়ার আগেই ডেস্ক পরিষ্কার করতে হবে। তাই উদ্ধারকারীর ভূমিকায় আরও কিছু বন্ধুকে নামতে হত। ধোয়ার পরেও মুখে-হাতে-মনে লেগে থাকত সব বন্ধু মিলে এক সঙ্গে এক জায়গায় খাবার মেখে খাওয়ার, আসলে নিখাদ বন্ধুত্বেরই স্বাদ।
শীতের রোদে পিঠ দিয়ে ডিমের ঝোল, চাটনি সহকারে মা-কাকিমাদের গল্পের মধুর স্মৃতি এখনও ভুলিনি। আর খুব মনে পড়ে পাড়ার দাদাদের সঙ্গে একটা নির্মীয়মাণ বাড়িতে সময়ের আগেই গৃহপ্রবেশ থুড়ি মাংস-ভাত ফিস্টের কথা। অর্ধসমাপ্ত বাড়ির ইটের মেঝেতে ত্রিপল পেতে, বাল্ব ঝুলিয়ে, শালপাতার থালায় হাপুস-হুপুস আওয়াজ করে মাংস-ভাত খাওয়ার আনন্দটাও ওই দাদাদের সঙ্গেই হারিয়ে গেছে।
মফসস্লে এখনও শীত আসে, পিকনিক স্পটে রঙিন ছাতার নীচে চিকেন পকোড়া-কফি, আরও নানাবিধ আয়োজনে ভোজন হয়। কিন্তু এখনকার পিকনিকের বিলাসিতা কোনও ভাবেই আমার সেই ছোটবেলার ফিস্টের মজাটাকে কিছুতেই ফিরিয়ে দিতে পারে না, কেন কে জানে!
অনিশা ঘোষ, পাণ্ডুয়া, হুগলি
যুগের অবলুপ্তি
‘দিন বদলের পিকনিক’ শীর্ষক প্রবন্ধটিতে লেখক ঈশা দাশগুপ্তের ইউরোপের ইতিহাসের উল্লেখ তথ্যসমৃদ্ধ। তবে সাধারণ পাঠককুলের কাছে এই বিবরণের তেমন গ্রহণযোগ্যতা আছে বলে মনে হয় না। অনেক কিছুর মতো পিকনিকের আঙ্গিকও পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন, ট্রামের ঘণ্টিতে কলকাতার ঘুম ভাঙবে না, অপু-দুর্গার চোখ কু ঝিক ঝিক রেলগাড়ি আর দেখবে না, পুরনো কলকাতার রক উধাও, কচিকাঁচারা ঠাকুমার কাছে ঠাকুরমার ঝুলি শোনে না। এখন আর বিয়েবাড়িতে ভিয়েন বসে না। বাড়ির কর্তাদের তদারক করার প্রশ্নই ওঠে না। উৎসব, অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই এখন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট নামে এক নতুন গোষ্ঠীর তত্ত্বাবধানে হয়। যাঁদের অনুষ্ঠান তাঁদের কোনও হেলদোল থাকে না, পয়সা দিয়েই দায়িত্ব শেষ। কোমরে গামছা বেঁধে পরিবেশন দূর অস্ত্!
আর পিকনিক যা ছিল একেবারে রান্না থেকে খাওয়া অবধি সকলের যৌথ যোগদানে, কত মন দেওয়া-নেওয়ার সাক্ষী থাকত এই পিকনিক (রমাপদ চৌধুরীর উপন্যাস পিকনিক), সে যুগের অবলুপ্তি বহু দিন। প্রবন্ধকার যথার্থই বলেছেন— বনভোজন বিষয়টি এখন কর্পোরেটের খপ্পরে। আমার মতে, জন্ম থেকে মৃত্যুর পরিসরে সমস্ত ধরনের আচার-অনুষ্ঠান এখন ‘আউটসোর্স’ হয়ে গেছে। এক বরেণ্য লেখকের একটি গল্প থেকেই বলি— অফিসের অতি ব্যস্ততার জন্য এক ব্যক্তি মায়ের দাহকার্যের দায়িত্ব তার বান্ধবীকে দিয়েছিল। আনাড়ি বান্ধবী দাহের পর অস্থি একটি মালসাতে নিয়ে দাহকার্যের তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষটিকে জিজ্ঞেস করেছিল, দাদা এ বার? দাদার উত্তর, এ বার মাকে জলে ভাসিয়ে দাও। বড় পিপাসা পায় এ সময়ে!
সুবীর ভদ্র, ডানকুনি, হুগলি
কবির প্রতিভা
বিশ্বজিৎ রায়ের লেখা ‘আমাদের রামকথা’ (২৬-২) শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে দু’-চার কথা। প্রবন্ধকারের বক্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে— তরুণ রবীন্দ্রনাথ মেঘনাদবধ কাব্য-র তীব্র সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, “আজকাল যাঁহারা মহাকবি হইতে প্রতিজ্ঞা করিয়া মহাকাব্য লেখেন তাঁহারা... রাশি রাশি খটমট শব্দ সংগ্রহ করিয়া একটা যুদ্ধের আয়োজন করিতে পারিলেই মহাকাব্য লিখিতে প্রবৃত্ত হন।...” অল্পবয়সি রবীন্দ্রনাথের এই ভুল ভেঙেছিল তাঁর পরিণত বয়সে, যে-কথা প্রবন্ধে উল্লিখিত হয়নি। রবীন্দ্রনাথ সলজ্জ সংশোধন-সহ তাঁর কথাগুলো প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। ভারতী পত্রিকার ভাদ্র ১২৮৯ সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন, “...I despise Ram and his rabble, সেটা বড় যশের কথা নহে— তাহা হইতে প্রমাণ হয় যে, তিনি মহাকাব্য রচনার যোগ্য কবি নহেন।” মেঘনাদবধ কাব্য পড়ে তরুণ রবীন্দ্রনাথ বিভ্রান্ত হলেও বিবেকানন্দের সমর্থন ছিল মধুসূদনের এই মহাকাব্যের প্রতি। এই কাব্যের ওজস্বী ভাষা, ইন্দ্রজিৎ-রাবণের রাজসিকতা স্বামীজির প্রশংসার কারণ। এ কালের হিন্দুত্ববাদীরা স্বামীজির নানা ভাবনা ও কথার মধ্য থেকে কয়েকটি কথা বেছে নিয়ে, বাকিগুলো আড়ালে রেখে নিজেদের পালে হাওয়া টানতেই সচেষ্ট। তাঁরা মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য যথার্থ অর্থে অনুধাবন করেছেন কি না, সন্দেহ আছে।
মধুসূদনের ক্যাপটিভ লেডি মাদ্রাজে প্রশংসিত হলেও কলকাতায় তেমন সমাদর পায়নি। এই কাব্যগ্রন্থ পড়ে গৌরদাসকে লেখা বেথুন সাহেবের চিঠি মধুসূদনের মনের মধ্যে গভীর প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। ফলস্বরূপ তার পর মাদ্রাজেই শুরু হয় মধুসূদনের সাহিত্যিক অজ্ঞাতবাসের অন্য পর্ব। তিনি ঠিক করেন বাংলা পড়বেন।— কারণ হল, “আই অ্যাম লুজ়িং মাই বেঙ্গলি ফাস্টার দ্যান আই ক্যান মেনশন।” বলা বাহুল্য, মধুসূদনের কবিপ্রতিভার আসল বিস্ফোরণ দেখা গেল মেঘনাদবধ কাব্য-তে (১৮৬১)। রামায়ণের ঘটনা ও ফলাফলকে অপরিবর্তিত রেখে মধুসূদন তাঁর মহাকাব্যে সম্পূর্ণ অচেনা, আধুনিক এক নিরীক্ষণ বিন্দু নির্মাণ করলেন। অযোধ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, নির্মাণ করলেন লঙ্কার দৃষ্টিকোণ থেকে। মেঘনাদবধ কাব্য ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিকতা ও সাহিত্যিক সাহসের একটি উজ্জ্বল বাতিস্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আর ঠিক সেই কারণেই তার রচয়িতা সগর্বে বলতে পারলেন— ‘আই ডেসপাইজ় রাম।’
মধুসূদন মেঘনাদবধ কাব্য-এর মধ্যে রাবণের পরাজয়কে ‘ট্র্যাজিক মাহাত্ম্য’ হিসাবে চিহ্নিত করলেন। ইন্দ্রজিতের মৃত্যু তাঁর চোখে ‘বধ’— অন্যায় ভাবে। শিকারির ফাঁদে পড়া বাঘের মতোই। মধুসূদনের প্রতিভা শেষ বার জ্বলে উঠল বীরাঙ্গনা কাব্য-এ (১৮৬২)। প্রবন্ধকার এ ক্ষেত্রে যথার্থই বলেছেন— ইন্দ্রজিতের মতো বীরস্বামীর গর্বে বলীয়ান প্রমীলাও মধুসূদনের কাব্যে নিজ ভুজবলের প্রতি আস্থাশীল। প্রমীলার স্বাধিকারবোধ পাঠকের চোখ টানে। এই কাব্যেও কবি বেছে নিয়েছেন ১১ জন পুরাণ-প্রসিদ্ধাকে, তাঁদের স্বাতন্ত্র্য এবং সংবেদনা, তাঁদের দীপ্তি ও দাহকে। বীরাঙ্গনা-র উৎসর্গপত্রটি বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে উৎসর্গ করেছিলেন মধুসূদন দত্ত। আনন্দের কথা, নারী-মুক্তি সংগ্রামের দুই ভগীরথ ‘বীরাঙ্গনা’ নারীদের সম্মান জানালেন এ ভাবেই। আজকের হিন্দুত্ববাদীদের এ সবের মর্মার্থ অনুধাবন করার শক্তি আছে বলে মনে হয় না। তাঁরা দলের স্বার্থে রামকেন্দ্রিক ঔপনিবেশিকতা স্থাপনেই ব্যস্ত।
শক্তিশঙ্কর সামন্ত, ধাড়সা, হাওড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy