— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
আজ বিদ্যার দেবীকে আরাধনার দিন। গত কয়েক দিন ধরেই পাড়ায় পাড়ায় কচিকাঁচা থেকে শুরু করে বড়দেরও চাঁদার উপদ্রব সইতে হয়েছে মানুষকে। এই পুজো নিয়ে স্কুলপড়ুয়াদের উৎসাহের অন্ত নেই। যদিও আজ কাল বাদে পরশু থেকে শুরু হচ্ছে এ বারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। স্বাভাবিক ভাবেই সেই পরীক্ষার্থীদের কাছে এই বছরটি সরস্বতী পুজোর আনন্দে ভেসে যাওয়ার সময় নয়। যা-ই হোক, বিদ্যার দেবী সরস্বতীর আগমনে প্রতি বছরের মতো এ বছরও ছাত্রছাত্রীদের তুমুল তৎপরতা দেখে কৈশোর বয়সের পুজোর দিনের কথা মনে পড়ে গেল।
পুজোর এক মাস আগে থাকতে বন্ধুদের নিয়ে বৈঠক হত। ঠিক হত পাড়ার কার থেকে কী রকম চাঁদা তোলা হবে। সেইমতো ধার্য হত পুজোর বাজেট। পুজোর সপ্তাহখানেক আগে বাঁশবাগান থেকে বাঁশ কেটে এনে তৈরি করা হত কাঠামো। অসময়ে বৃষ্টি এলেও পুজোমণ্ডপ যাতে ভিজে না যায়, তার জন্য গ্রামের ডেকরেটরদের কাছ থেকে ত্রিপল এনে চাপানো হত। তখন এত থিমের পুজোর চল ছিল না। মা, কাকিমা, পিসিমাদের শাড়ি আলমারি থেকে বার করে চলত মণ্ডপসজ্জার কাজ। তবে মণ্ডপের পাশে অবশ্যই থাকত একটি গ্রিন রুম, যেখান থেকে পুজোর কার্য পরিচালনা করা হত এবং বাজত সাউন্ড বক্স। পুজোর এক সপ্তাহ আগে থেকেই পাশের গ্রাম দেউলপুর অথবা গোন্দলপাড়া গ্রামে প্রতিমা শিল্পীদের কাছে সরস্বতী ঠাকুরের বায়না দিয়ে আসা হত। পুজোর এক দিন আগে ঠাকুর আসত মাথায় চেপে অথবা সাইকেলে চেপে। তবে কোনও বছর ঠাকুর আকারে বড় হলে ভ্যানের ব্যবস্থাও থাকত।
পুজোর আগের দিন পুজোর নানা জিনিস, যেমন— ফুল, মালা এবং মাঠ থেকে কলাগাছ, বেলপাতা, বেলগাছের ডাল, আম্রপল্লব প্রভৃতি সংগ্রহ করে রাখা হত। পুরোহিতকে অনেক দিন আগে থেকেই পুজোর জন্য বলে রাখতে হত, না হলে শেষ মুহূর্তে পুরোহিত পাওয়া যেত না। পুজোর দিন বাড়ি থেকে বৈদ্যুতিক তারের সাহায্যে আলোর ব্যবস্থা করা হত। ওই দিন সকালে কাঁচা হলুদ গায়ে মেখে স্নান করা আমাদের একটা রেওয়াজ ছিল। সকালে বাড়ির মা, বোন, দিদি, কাকিমা, পিসিমারা স্নান সেরে ফল কাটতে ও পুজোর জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী এক-এক করে ছোট-বড় থালায় সাজিয়ে রাখতেন। বাড়ির ও পাড়ার কচিকাঁচারা মা সরস্বতীর কাছে স্লেট-পেনসিল দিয়ে অ-আ-ক-খ লিখে পুরোহিতের কাছে দিত। পুজোর কয়েকটা দিন আমাদের পড়াশোনার বালাই থাকত না, কারণ প্রতিমার কাছে সমস্ত পাঠ্যপুস্তক জমা রাখা হত।
সরস্বতী পুজোর আগে কুল খাওয়া ছিল নিষেধ। পুজোর দিনে সেই নিয়ম ভঙ্গ হত। এ দিন আবার বহু পরিবারে গোটা রান্না তথা গোটা সিদ্ধর রেওয়াজ আছে। সন্ধ্যাকালীন পুজোর সময় মা সরস্বতীর কাছে তা প্রসাদের উপর নিবেদন করা হয়। এ ছাড়াও কোথাও কোথাও পায়েস এবং কুলের চাটনিও প্রসাদ রূপে দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের সময় গ্রামাঞ্চলে পুজো উপলক্ষে মেলারও আয়োজন করা হত, যা ছাত্রছাত্রীদের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয় ছিল।
বহু যুগ ধরেই পছন্দের মানুষকে প্রেম নিবেদনের জন্য এই সরস্বতী পুজোর দিনকে বেছে নেয় স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। এ বছর ভ্যালেন্টাইন’স ডে ও সরস্বতী পুজো একই দিনে পড়ায় তারা বাঁধনছাড়া আনন্দে মেতে উঠবে। কিন্তু তাতে যেন পরীক্ষার্থীদের কোনও অসুবিধায় পড়তে না হয়, সেটা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
শ্রীমন্ত পাঁজা, গঙ্গাধরপুর, হাওড়া
পুজো ও প্রেম
তখনও আকাশ-বাতাস মুখরিত করে “বাতাসে বহিছে প্রেম/ নয়নে লাগিল নেশা/ কারা যে ডাকিল পিছে/ বসন্ত এসে গেছে...” গানে দোদুল্যমান হয়নি আঠারো-পঁচিশের দামাল বাহিনী। কিন্তু হৃদয়কমলমাঝে ‘মধুর মধুর ধ্বনি’ কবেই বা অশ্রুত থেকেছে মাঘ-ফাল্গুনের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে? বীণাপাণির একখানা মূর্তি ক্রয় করতে বাবা-মায়ের হাত ধরে খুদেদের সরস্বতী পুজোর আগের দিন ভিড়ে থিকথিক বাজারে মনপসন্দ মৃন্ময়ীকে পছন্দ করে, পুজোর হরেক উপচার সামগ্রী-সহ ফল মিষ্টি চাঁদমালা কিনে যখন রিকশা-বাহনে সকলে বাড়িমুখো, তখন বিশ্বজয়ের আনন্দ থেকে কবেই বা বঞ্চিত হয়েছে সেই কিশোর-কিশোরীর দল?
বাড়ির প্রধান ফটকে দাঁড়িয়ে মা। তাঁর শঙ্খধ্বনিতে মঙ্গলবার্তা শেষ শীতের হিমেল বাতাসে জানান দিত। নিজেদের মতো করে মা-দিদিদের শাড়ি দিয়ে বাড়ির বারান্দায় ছোট্ট একটা ম্যারাপ, তাতে জলচৌকিতে হাসি-হাসি মুখে বসতেন তিনি পর দিন কাক-ডাকা ভোরে। গাঁদা ফুলের মালা, হাতের চাঁদমালার শোভায়, ফল-মিষ্টি সহযোগে সাজানো প্রসাদী থালায়, চন্দন-ধূপের সৌরভে কেমন একটা পুজো-পুজো গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত সর্বত্র। সবচেয়ে কাঁপুনি ধরত ওই হিমেল ভোরে সর্ষের তেলের সঙ্গে কাঁচা হলুদ বাটা মাখার পর্বটি। কী যে কারণ, থোড়াই জানত তখন শিশু-কিশোর মন! অনেক পরে জ্ঞানগম্যি হয়েছে, ত্বকের জন্য নাকি জরুরি এটি।
জীবনের প্রথম শাড়ি পরিহিতা খুদে বোনটা সে দিনই কেমন পাকা গিন্নি হয়ে যেত, বিশেষত হলুদ শাড়িতে। ও দিকে পাজামা-পাঞ্জাবিতে সাজুগুজু করে বাড়ির পুজো-পর্ব মিটতেই দল বেঁধে স্কুলপানে দৌড়। সমবয়সি মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বুকে দোলা লাগত অবধারিত ভাবেই। বয়স দশ-বারো থেকে পনেরো— সে যে এক ভয়ানক পর্ব। স্কুলের সাজানো-গোছানো প্যান্ডেলে তাকে দেখে আকুল হত মন অজানতেই। মা সরস্বতী নিশ্চয়ই সব জানেন। তাই আশি-নব্বইয়ের দশকে অনুদ্ভাসিত বা ততটা নয় উচ্চকিত প্রেমদিবস পালিত হত ভিন্ন প্রকারে। ভ্যালেন্টাইন’স ডে-র উৎস না জেনেও তো এখন ১৪ ফেব্রুয়ারিতে প্রেমদিবসের মাতামাতি!
এ বার ষোলো কলায় পরিপূর্ণ সারস্বত দিবস। ১৪ ফেব্রুয়ারির সরস্বতী পুজো মিশে যাবে প্রেমদিবসে। ‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে’ সে দিন ভরপুর হোক ‘ধরা দিয়েছি গো আমি আকাশের পাখি’দের গানে। স্রেফ একটি দিনের জন্য নাহয় যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা নিপাত যাক।
ধ্রুবজ্যোতি বাগচী, কলকাতা-১২৫
ঋতুরাজ
শীত তার কাঁথা কম্বল গোছাতে শুরু করে দিয়েছে। কয়েকটা দিন বেশ কাঁপিয়ে তুলেছিল। একেবারে ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’ অবস্থায় ছিলেন বঙ্গবাসী। দীর্ঘ দিন পর এ রকম হাড়কাঁপানো ঠান্ডা। এমনও শোনা গেছে, এ বার শীতটা গেলে বাঁচি। হঠাৎ শীত-বুড়ি যে এ ভাবে সেই প্রার্থনা মঞ্জুর করবে, কে জানত! ইতিমধ্যেই তার ফেরার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। গরম পোশাক থেকে কম্বল গোছানো শুরু হয়েছে, ধুয়ে কেচে স্বস্থানে ফেরত যাওয়ার জন্য। আবার পরের বছরের অপেক্ষা।
মাঘ শেষ। সাধারণত মাঘ মাসের মাঝামাঝি থেকেই শীতের যাই যাই রব শুরু হয়। কমতে থাকে শীত। সেই নিরিখে এ বছর তার দীর্ঘ উপস্থিতি জানান দিয়ে গিয়েছে। খনার বচন, ধন্য রাজা পুণ্য দেশ, যদি বর্ষে মাঘের শেষ। সেই অকাল বর্ষাও সঙ্গী হয়েছিল শীতের।
কবির কথায়— ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত। সেই বসন্ত অবশেষে জানান দিচ্ছে— আমি আসছি। বেড়েছে বেলা, বাড়ছে রোদের তাপ, বইতে শুরু করেছে দখিনা বাতাস। ঋতুরাজ আসছে, কিন্তু সে তো একপ্রকার গরমই। বসন্তের অনুভূতি মানেই রাত ও ভোরের দিকে হালকা ঠান্ডা। তার পর সূর্য উঠলেই রোদের তাপে অতিষ্ঠ হওয়া। আর বসন্তের আগমনের সঙ্গেই শুরু হয় আমাদের চার পাশের গাছগুলির নতুন কচি পাতায় সেজে ওঠার পালা। অর্থাৎ পুরনো যা কিছু, তাকে ঝেড়ে ফেলে নতুনকে আহ্বান জানানো। সেজে ওঠে প্রকৃতি, আর সেই বসন্তই মনে বয়ে আনে আনন্দের বার্তা। পলাশ, কৃষ্ণচূড়া ছড়িয়ে দেয় রঙের বাহার। বসন্ত তাই প্রেমের ঋতু।
সনৎ ঘোষ, খালোড়, হাওড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy