ব্রায়ান হ্যাচারের ‘সমাজবিজ্ঞানী বিদ্যাসাগর’ (৪-৬)শীর্ষক প্রবন্ধ সূত্রে কিছু কথা। বহুবিবাহ প্রথার উচ্ছেদকল্পে বিদ্যাসাগর দু’খানি বই লিখেছিলেন। চেয়েছিলেন বহুবিবাহের উচ্ছেদ। বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন, “আমরা অত্যন্ত কাপুরুষ, অত্যন্ত অপদার্থ; আমাদের হতভাগ্য সমাজ অতিকুৎসিত দোষপরম্পরায় অত্যন্ত পরিপূর্ণ।” তাই তিনি অনন্যোপায় হয়ে এ-প্রথা রদ করার জন্য রাজবিধানের সাহায্য নিতে চেয়েছিলেন, এবং আইন প্রণয়নের জন্য ভারত সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন ২৭ ডিসেম্বর, ১৮৫৫।
পরিতাপের বিষয়, কৌলীন্যপ্রথা ও বহুবিবাহকে সমাজ হানিকর কুসংস্কার জেনেও রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে সনাতনপন্থীদের আন্দোলনের জেরে রাজদ্বারে সে দিন বহুবিবাহ নিরোধক আইন উপেক্ষিত হয়েছিল। বিদ্যাসাগর অভীষ্ট লাভে ব্যর্থ হলেও যুক্তিবাদী, প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা নিয়ে বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৭১) নামে পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন। বইখানিতে তিনি প্রমাণ করেন, বহুবিবাহ অশাস্ত্রীয় ও অমানবিক। কুলীনদের রুচিবিকার অত্যাচারের পরিচয় প্রদান প্রসঙ্গে তিনি হুগলি-সহ বর্ধমান, নবদ্বীপ, যশোর, বরিশাল, ঢাকারও বহুবিবাহকারী কুলীনের সংখ্যা বিস্তারিত ও বিশ্বাসযোগ্য ভাবে উপস্থাপিত করেছিলেন। চিত্রশালি গ্রামের বিশ বছরের যুবক দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ষোলোটি বিয়ে করে বীরত্বের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন। নানা ব্যস্ততার মধ্যেও বহুবিবাহ বন্ধের জন্য বিদ্যাসাগর জনমত গঠন ও গণস্বাক্ষর সংগ্রহের উদ্দেশ্যে নানা অঞ্চলে গিয়েছিলেন। সংস্কারমূলক আন্দোলনে এক জন সংগঠকের মতো তাঁর এই প্রত্যক্ষ গণসংযোগের ভূমিকা ছিল সে যুগে অপরিসীম। শোনা যায়, তিনি নিজেই তাঁর এই পুস্তিকাটির ইংরেজি অনুবাদ করে বিলাতে গিয়ে মহারানি ভিক্টোরিয়ার হাতে পৌঁছেও দিতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু পুস্তিকাটি প্রকাশের পর অত্যন্ত তীব্র ভাষায় বিদ্যাসাগরকে আক্রমণ করে প্রকাশিত হয়েছিল নানা প্রতিবাদ পত্র। সংস্কৃত কলেজের ব্যাকরণের অধ্যাপক তারানাথ তর্কবাচস্পতি বহুবিবাহ নিষেধের বিরুদ্ধে লিখেছিলেন বহুবিবাহবাদ নামক সংস্কৃত পুস্তিকা। আবার বরিশাল নিবাসী রাজকুমার ন্যায়রত্ন লিখেছিলেন প্রেরিত তেঁতুল নামে পুস্তিকা। সত্যব্রত সামশ্রমী লিখেছিলেন বহুবিবাহবিচার সমালোচনা নামক পুস্তিকা। বিদ্যাসাগরও এ সব অন্যায় আক্রমণের জবাব দিয়ে লিখেছিলেন বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক বিচার (দ্বিতীয় পুস্তক, ১৮৭৩)। এমনকি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও সে দিন বিদ্যাসাগরের দ্বিতীয় গ্রন্থের বিরুদ্ধে কলম শাণিয়ে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় (১২৮০, ৩য় সংখ্যা) প্রকাশ করেন ‘বহুবিবাহ’ নামে প্রবন্ধ। কিন্তু আনুষ্ঠানিকতার বন্ধন-বিমুক্ত মন ও মননের অধিকারী বিদ্যাসাগর অজেয় পৌরুষের সঙ্গে সমাজের বিরুদ্ধতাকে উপেক্ষা করেছিলেন, জয়ী করেছিলেন আপন শুভ সঙ্কল্পকে। পালন করেছিলেন সমাজবিপ্লবীর ভূমিকা।
সুদেব মাল, খরসরাই, হুগলি
সেই বিতর্ক
ব্রায়ান হ্যাচারের লেখা ‘সমাজবিজ্ঞানী বিদ্যাসাগর’ প্রবন্ধটির পরিপ্রেক্ষিতে বলি, আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে হ্যাচার ঈশ্বরচন্দ্রকে নিয়ে একটি তথ্যসমৃদ্ধ বিশ্লেষণমূলক বই লিখেছিলেন, ইডিয়মস অব ইমপ্রুভমেন্ট: বিদ্যাসাগর অ্যান্ড কালচারাল এনকাউন্টার ইন বেঙ্গল নামে। বইটিতে তিনি ঈশ্বরচন্দ্রের সমাজতাত্ত্বিক চিন্তাভাবনার নানা দিক, বিশেষত বহুবিবাহ বিষয়ক রচনাটির গভীর তাৎপর্যপূর্ণ বিশ্লেষণ করেছিলেন। তখন এই বইটির বিষয়ে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন ইতিহাসবিদ অমলেশ ত্রিপাঠী। তিনি নিজেও একটি পূর্ণাঙ্গ বই লিখেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্রকে নিয়ে (বিদ্যাসাগর: আ ট্র্যাডিশনাল মডার্নাইজ়ার, ১৯৭৪)। সেই বইয়ের একটি অধ্যায়ে তিনি দেখিয়েছিলেন, বহুবিবাহ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে পণ্ডিত ব্যক্তিদের বিস্তর তর্ক হয়েছে, যার প্রমাণ পাওয়া যায় বহুবিবাহ-দ্বিতীয় পুস্তক-এর উপসংহার অংশে। বহুবিবাহ-প্রথম পুস্তক গ্রন্থের সূচনায় তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন, কে কত বার বিবাহ করেছিলেন এবং তাঁদের কার কত বয়স। তাই বহুবিবাহ বইটি নিয়ে আলোচনা কমই শুনতে পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে, ঈশ্বরচন্দ্রের স্মরণ সভায় শিবনাথ শাস্ত্রী যে রচনাটি পাঠ করেছিলেন, তাতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ঈশ্বরচন্দ্র এই প্রথা বন্ধ করার জন্য নানা ভাবে চেষ্টা করে গিয়েছেন। দুর্ভাগ্য, আমাদের সমাজ জীবনে আজও বহুবিবাহ বিষয়টি অনালোচিত রয়ে গিয়েছে।
শৈবাল মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-২৬
সীতা, শকুন্তলা
সমাজবিজ্ঞানীর মতো তথ্য সংগ্রহ ছাড়াও বিদ্যাসাগর পুরাকাহিনি এবং প্রবন্ধের মাধ্যমেও সমাজচিত্র বর্ণনার বিষয়ে যত্নশীল হয়েছিলেন। যেমন— কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলম-এর অনুবাদ শকুন্তলা, সীতার বনবাস এবং প্রভাবতী সম্ভাষণ। রবীন্দ্রনাথ শকুন্তলা প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগরকে বাংলা ভাষার প্রথম প্রকৃত শিল্পী আখ্যা দেন। এই অনুবাদ গ্রন্থের নির্বাচন এবং সীতার বনবাস রচনা প্রমাণ করে যে, বিদ্যাসাগর সেই সময় অসংখ্য হিন্দু বিধবাদের দুর্ভাগ্যময় জীবন বিষয়ে চিন্তিত ছিলেন। শকুন্তলা প্রকাশের পরের মাসেই প্রকাশিত হয় তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ বিধবা বিবাহ। ব্রায়ান হ্যাচারের মতে, একই সঙ্গে দুই গ্রন্থের প্রকাশ বিদ্যাসাগরের নারীকল্যাণের বিষয় উত্থাপনের এক মিলিত কৌশল (বিদ্যাসাগর: দ্য লাইফ অ্যান্ড আফটার লাইফ অব অ্যান এমিনেন্ট ইন্ডিয়ান)।
বিদ্যাসাগরের প্রাক্তন ছাত্র এবং বন্ধু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা প্রভাবতী মাত্র তিন বছর বয়সে মারা যায়। ব্যথিত বিদ্যাসাগর প্রভাবতী সম্ভাষণ গ্রন্থে প্রভাবতীর প্রতি তাঁর ভালবাসাকে সুচারু ভাবে ক্ষমতাহীন নারীদের প্রতি সহানুভূতির সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন। সমাজবিজ্ঞানীরা এই ভাবে পুরাকাহিনি, কিংবদন্তিকে সংশ্লিষ্ট সমাজজীবনের দর্পণ হিসেবে ব্যবহার করেন। যেমন করেছিলেন ব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদ এবং পরবর্তী কালে সমাজবিজ্ঞানী ভেরিয়ার এলউইন। প্রকৃত সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে গবেষণা করতে গেলে সমাজের প্রতি কোনায় পৌঁছনো দরকার। এই দিক দিয়েও ভেরিয়ার এবং বিদ্যাসাগরের মধ্যে মিল পাওয়া যায়।
পঙ্কজ কুমার চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা-১১৬
কুলীনের তালিকা
ব্রায়ান হ্যাচার বিদ্যাসাগরের সমাজ-গবেষণার কম আলোচিত দিকটি তুলে ধরেছেন। বহুবিবাহ প্রথা রদের আন্দোলন সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে তিনি লোকমুখে শোনা বহু কাহিনি লিখেছিলেন। তার সঙ্গে চলছিল গ্রামবাংলা ঘুরে তথ্য সংগ্রহের কাজ। এ রকম এক কাহিনিতে এক ভঙ্গ কুলীন ব্রাহ্মণকে কেউ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তিনি যে এতগুলো বিয়ে করেছেন, সব বাড়িতে গিয়ে উঠতে পারেন কি? নির্লজ্জ সেই ব্রাহ্মণ অম্লান বদনে বলেছিলেন, যেখানে ভিজ়িট পান, সেখানেই যান তিনি।
বহুবিবাহ রদ করতে বিদ্যাসাগর তখন উঠে পড়ে লেগেছেন। ক্ষেত্র সমীক্ষা থেকে সংগৃহীত তথ্য নিয়ে তাঁর রচিত কুলীনদের একটি আংশিক তালিকায় দেখা যায়, হুগলি জেলার জনৈক ভোলানাথ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ৫৫ বছরের মধ্যে ৮০টি কন্যার পাণিগ্রহণের মতো ‘মহৎ’ কাজ সেরে রেখেছিলেন। ওই একই জেলার ৬৪ বছর বয়সি জনৈক ভগবান চট্টোপাধ্যায়ের বিয়ের সংখ্যা ৭২। এঁদের কথা লিখতে গিয়ে রাগে অস্থির বিদ্যাসাগর অভিশাপ দিয়ে বলেছেন, “যদি ধর্ম থাকেন রাজা বল্লাল সেন ও দেবিবর ঘটক বিশারদ নিঃসন্দেহে নরকগামী হইয়াছেন”।(তথ্যসূত্র: ‘প্রেম, প্রীতি, বিনয়, বিদ্রুপ— বাঙ্গালীর সেই চিরন্তন মহাভারত’, অভিজিৎ দাশগুপ্ত, শারদীয়া মাসিক কৃত্তিবাস-২৪২৮, সেপ্টেম্বর ২০২১)
বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায়, কুলটি, পশ্চিম বর্ধমান
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy