Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: নিয়মের লঙ্ঘন

আশুতোষ মুখোপাধ্যায় উপাচার্য হয়েছিলেন ইংরেজ শাসনকালে। তখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অস্তিত্ব ছিল না, তাই নিয়ম মানার বাধ্যবাধকতাও হয়তো ছিল না।

An image of Ashutosh Mukherjee

আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২৩ ০৬:০২
Share
Save

শক্তিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘শিক্ষাবিদই কেন’ (২৯-৮) শীর্ষক চিঠিতে বলেছেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় (ছবি) আইনজীবী ছিলেন। কথাটি সত্য। কিন্তু প্রথমে তিনি অসাধারণ গণিতজ্ঞ এবং পদার্থবিদ্যা অনুরাগী। গণিতশাস্ত্রের তিনটি মৌলিক গবেষণাপত্র প্রকাশের পর তাঁর খ্যাতি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও সমান সাড়া জাগিয়েছিল। তা ছাড়া, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় উপাচার্য হয়েছিলেন ইংরেজ শাসনকালে। তখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অস্তিত্ব ছিল না, তাই নিয়ম মানার বাধ্যবাধকতাও হয়তো ছিল না। ইউজিসি-র নিয়ম অনুযায়ী উপাচার্য নিয়োগের প্রথম শর্ত ন্যূনতম দশ বছরের পূর্ণ অধ্যাপক পদে কাজ করার অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা নবনিযুক্ত ন্যায়াধীশ উপাচার্য মহাশয়ের আছে কি? দ্বিতীয়ত, কোনও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অধ্যাপক যদি উচ্চন্যায়ালয়ের বিচারপতি (বা আইপিএস অফিসার) হতে চান, সেই সুযোগ তিনি পাবেন কি? উপাচার্য হওয়ার অন্য এক শর্ত, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে উচ্চমানের গবেষণাপত্র থাকা। না থাকলে এটিও নিয়ম লঙ্ঘনের উদাহরণ।

টেলিভিশনের একটি আলোচনা থেকে শুনলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন দক্ষ প্রশাসক প্রয়োজন কিছু উচ্ছৃঙ্খল ছাত্রকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য। আইপিএস অফিসার প্রশাসক হতে পারেন, কিন্তু বিচারপতি কী অর্থে প্রশাসক, তা বোধগম্য হচ্ছে না।

সাম্প্রতিক অতীতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আমন্ত্রিত হয়ে ছাত্রবিক্ষোভের মুখে পড়েন। মন্ত্রীর আগমনের খবর উপাচার্য মহাশয়ের কাছে ছিল না। তথাপি বিক্ষোভের দায় উপাচার্যের উপর চাপিয়ে সর্বসমক্ষে তাঁকে অপমান করতে দ্বিধাবোধ করেননি সেই মন্ত্রী। উপাচার্য সে দিন দেখিয়েছিলেন অসীম সহিষ্ণুতা ও সংযম। এটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্থক প্রশাসকের স্বরূপ। এই বিশ্ববিদ্যালয় মেধাতালিকাতে প্রথম, আবার ছাত্র রাজনীতিতে প্রখর। এখানে ছাত্রবিক্ষোভ হয়েছে। এ জন্য বিচারব্যবস্থার আঙিনা থেকে উপাচার্য নিয়োগের প্রয়োজন হয়নি। বিকাশ ভবন আর রাজভবনের দূরত্ব কিন্তু অসীম নয়। প্রয়োজন পারস্পরিক আস্থা ও নির্ভরতা। এটাই উপাচার্য নিয়োগের একমাত্র পথ।

নিখিল চক্রবর্তী, কলকাতা-৬৪

শিল্পই হাতিয়ার

কার্ল ইয়ুং-এর যৌথ অবচেতন তত্ত্বের তিনটে উদাহরণ পড়েছিলাম— নায়ক, মা এবং দানবের ভয়। যা এত দিন স্বপ্নের মধ্যে সুপ্ত ছিল, তা কি বলিউড সিনেমার মাধ্যমে ফিরে এল? শাহরুখ খান অভিনীত জওয়ান ছবিটি দেখতে দেখতে এই প্রশ্নই নিজেকে করেছিলাম। গত কয়েক বছর ধরেই রাষ্ট্রনেতাদের দাদাগিরি দেখে অভ্যস্ত ভারতের মানুষ। আজ তারা পর্দায় দেখল সাধারণ মানুষ অর্থাৎ ‘কমন ম্যান’-এর হিরোগিরি, নিপীড়িত মানুষের কল্যাণের উদ্দেশ্যে।

কৃষিপ্রধান দেশে কৃষকরা অত্যাচারিত, বঞ্চিত। ছবিটি এখানেই সাধারণের হৃদয়ানুভূতি বুঝতে ও বোঝাতে সফল। ছবিটির পরিবেশনা অবাস্তব হলেও, বিষয় নির্বাচন যথেষ্ট বাস্তব। ভারতে আত্মহত্যার পরিসংখ্যানে কত জন কৃষক রয়েছেন, সেই তথ্য সঠিক না জানলেও সংবাদপত্রে চাষি মৃত্যুর খবর চোখ এড়ায় না। ট্র্যাক্টর কেনার ঋণে সুদের হার (১৩%) যে মার্সিডিজ় গাড়ি কেনার ঋণের সুদের হারের (৮%) থেকে অনেকটাই বেশি, তা মশলাদার সিনেমার মধ্যে দিয়ে শাহরুখ বলে দিলেন।

ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা ঋণের বোঝা বইতে না পেরে আত্মহত্যা করছেন, এবং দেশের প্রাথমিক নাগরিক পরিষেবা যে বেহাল, তা ভোটের প্রাক্কালে নাগরিকদের স্মরণ করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব অবশ্যপালনীয়। ঠিক যে ভাবে জি২০ সম্মেলনের কারণে রাজধানীর দারিদ্র, ভেঙে পড়া কুদৃশ্য মেরামত না করে প্লাস্টিকে ঢেকে দেওয়ার খবর সমগ্র ভারতকে জানিয়েছে সংবাদপত্রগুলো। ‘বয়কট বলিউড’ স্লোগানকে ব্যর্থ করে ‘কিং খান’ অভিনীত ছবিটি প্রমাণ করল, শিল্পই আসল হাতিয়ার। মানুষের সঙ্গে কথা বলার জন্য সিনেমাই এখনও পর্যন্ত সেরা মাধ্যম।

রিমি মুৎসুদ্দি, কলকাতা-১৪৯

অ-মূল্য

সে সময় বাংলার ‘ডিরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন’ ছিলেন ওটেন সাহেব, ছাত্র সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে যাঁর বিবাদের কথা সকলের জানা। তিনিই এক তরুণীকে আহ্বান জানিয়েছিলেন বেথুন কলেজে অধ্যাপনা করতে। তরুণী দেখা করতে গেলেন অধ্যক্ষা মিস রাইটের সঙ্গে। ফিরে এসে দ্বিতীয় বার ওটেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ কালে তিনি তরুণীকে মিস রাইটের একটি চিঠি পড়ে শোনান। অধ্যক্ষা ওটেনকে সেই চিঠিতে জানিয়েছিলেন, তরুণীর ইংরেজি সাহিত্য সম্পর্কে সন্তোষজনক জ্ঞান আছে। তবু তাঁকে নেওয়া যাবে না। কারণ, তাঁর জাতীয়তাবাদী মনোভাব ছাত্রী এবং শিক্ষয়িত্রীদের উপর প্রভাব বিস্তার করে অশান্তি ডেকে আনতে পারে। অক্সফোর্ড থেকে বি লিট ডিগ্রি এবং ট্রেনিং ডিপ্লোমা নিয়ে আসা, কিন্তু অধ্যাপনার চাকরিটি না পাওয়া তরুণীর নাম লতিকা ঘোষ।

জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম দিকের সুপরিচিত পৃষ্ঠপোষক রাজনারায়ণ বসুর নাতি, কবি মনমোহন ঘোষ ও মালতী ঘোষের কন্যা তিনি। দিদি মৃণালিনী দত্ত। সম্পর্কে বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ এবং বারীন ঘোষ তাঁর কাকা। লতিকার শিক্ষালাভের পর্যায়ে বিলিতি ছাপ ছিল। তিনি লরেটো হাউস-এ পড়তেন। পরে অক্সফোর্ডে যান। ফিরে আসার পর বেথুনের চাকরি না হলেও ডক্টর বিধানচন্দ্র রায়ের চেষ্টায় চিত্তরঞ্জন সেবাসদনে নার্সিং-এর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেয়েদের রিপোর্ট লেখা ও অন্যান্য কিছু কাজ শেখানোর জন্য নিযুক্ত হন। কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় স্বাস্থ্য বিষয়ক বক্তৃতা, সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম ইত্যাদির আয়োজন করে বাংলার মেয়েদের হৃদয়ে দেশাত্মবোধ ও রাজনৈতিক চেতনা জাগানোই তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল।

পশ্চিমি আবহে বড় হয়েও যে দেশাত্মবোধের প্রদীপ মনের মধ্যে জ্বালিয়ে রাখা যায়, পরাধীন বাংলা তথা ভারত তা বারংবার দেখেছে। লতিকাও সেই উত্তরাধিকার বহন করতেন। ১৯২৮ সালে যখন সাইমন কমিশন বয়কট করার ডাক এল, লতিকা তাতে সাড়া দিলেন সদলবলে। ওয়েলিংটন স্কোয়্যারে কংগ্রেসের ডাকা সভায় তাঁর আদর্শে উদ্বুদ্ধ মেয়েরা প্রকাশ্যে যোগ দিলেন এবং শপথ গ্রহণ করলেন। স্বয়ং সুভাষচন্দ্র এই সভায় উপস্থিত ছিলেন। লতিকা ঘোষের সঙ্গে দেখা করে তিনি স্থির করেন মহিলা রাষ্ট্রীয় সঙ্ঘ গড়তে হবে। সম্পাদিকা লতিকা ঘোষ এবং সভানেত্রী সুভাষ-জননী প্রভাবতী বসু। কিছু দিনের মধ্যে এই সঙ্ঘ বাংলার শহরে, গ্রামে সক্রিয় হয়ে ওঠে। মেয়েদের লাঠি-ছোরা ইত্যাদি খেলা শিখিয়ে স্বাবলম্বী হতে উৎসাহিত করা, স্বদেশি গান শেখানো ইত্যাদি নানা কাজ করে সঙ্ঘ ভারত ললনাদের জাগিয়ে তুলতে থাকে। ১৯২৮ সালে কংগ্রেসের প্রকাশ্য অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানে৷ বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতি সুভাষ পেলেন ভলান্টিয়ার বাহিনীর দায়িত্ব। সামরিক কায়দা রপ্ত করেছিলেন স্বেচ্ছাসেবকরা। লতিকা ছিলেন মহিলা ভলান্টিয়ারদের ভারপ্রাপ্ত। কংগ্রেস সভাপতি মোতিলাল নেহরুকে নিয়ে বিরাট শোভাযাত্রায় পুরুষের সঙ্গে সমান তালে পা মেলান মেয়েরা। তাদের দুঃসাহসিক মার্চ দেখে কলকাতা হতভম্ব।

১৯২৮ সাল ঘেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত লতিকা বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সদস্যা ছিলেন। পরবর্তী জীবনে তাঁকে আর সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনে দেখা যায়নি। বিংশ শতকের প্রথম ভাগে অন্দরের নারীকে বাইরের আকাশ চেনানো, তাঁদের বুকে দেশের স্বাধীনতার সাধ জাগিয়ে দেওয়া কম কথা ছিল না। নারী মুক্তির গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসাবে এক-একটি সংগ্রাম এসেছে এবং মেয়েদের পূর্ণ মানুষ হিসাবে দেখতে শিখিয়েছে। এ শিক্ষার মূল্যায়ন আজও হয়নি।

সোনালী দত্ত, হাওড়া

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Ashutosh Mukherjee Calcutta University Judges

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}