অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের “‘না’ বলার স্বাধীনতা” (২৮-১২) প্রসঙ্গে এই চিঠি। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে গণতান্ত্রিক ভারতে প্রতিস্পর্ধী ‘না’ বলার অধিকারেই শুধু নয়, নাগরিক অধিকারের সমবেত ‘হ্যাঁ’-এর সাংবিধানিক স্বীকৃতিও ছিল স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ‘না’ বলার সঙ্গে ‘হ্যাঁ’-এর ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন গান্ধীজি, নেতাজি, রবীন্দ্রনাথ, জওহরলাল নেহরু প্রমুখ নেতা। ভারতে এখন ‘না’ বলার অধিকার এবং সেই ‘না’-কে যুক্তি, সমবেত এবং সংহত প্রত্যয়ের আধারে একটা বিকল্প অবস্থান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্যে যেন অনুনয়, ভিক্ষার সুর শোনা যাচ্ছে। এই দয়া, করুণা ভারতীয় গণতন্ত্রের মর্যাদা বাড়ায় না। যখন নির্বাচিত সরকার নির্বাচকমণ্ডলীর এক বিশাল অংশের গণতান্ত্রিক চাহিদাকে উপেক্ষা করে, তখন মনে হয় এই গণতন্ত্র অবাস্তব। এটা কেন্দ্র থেকে রাজ্য, উভয় জায়গাতেই সত্য। তার কারণ উভয় জায়গাতেই অর্থনীতি থেকে রাজনীতিতে কর্পোরেট শাসনের অধিকার নীরবে বেড়ে চলেছে।
হরিদ্বারের ‘ধর্ম সংসদ’ কোনও ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়’— লেখকের এই মত সমর্থন করে বলি, গণতান্ত্রিক আইনসভায় বিরোধীদের ‘না’ বলা শুনতে চায় না অধ্যাদেশ-নির্ভর শাসক। সংখ্যাগুরু দরিদ্র মানুষের ক্ষুধা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জীবিকা ও জীবনের ন্যূনতম দাবিতে ঐকমত্য, সংহতি দেখলেই যুদ্ধ, ধর্ম, মেলা, উৎসব, খেলা ইত্যাদির হুজুগ তোলা হচ্ছে। কখনও বিভাজনের মাধ্যমে, কখনও বা অন্তর্ঘাতের মাধ্যমে প্রতিস্পর্ধীর হ্যাঁ-কে খারিজ করে দেওয়া হচ্ছে। কৃষক আন্দোলন, নাগরিক পরিচিতি আন্দোলনের ক্ষেত্রে যা দেখা গিয়েছে। তা সত্ত্বেও ‘জনসমাজের পরিসর’ স্বীকৃতি দিয়ে গিয়েছে সাহস ও ধৈর্যের ইতিবাচক ‘না’-কে। যেমন, ১৯৯০ সাল থেকে আমরা, ভারতের ব্যাঙ্ককর্মীরা, ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঠেকিয়ে রেখেছি ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের বিল। ধর্মঘট হলে কিছু গ্রাহক অসন্তুষ্ট হন। তখন বুঝি, আমরা ‘জনসমাজের পরিসরে’ ঠিকমতো পৌঁছতে পারছি না। এর জন্য সময়, ধৈর্য দিতে হবে, সহনশীল হতে হবে, এবং ব্যাঙ্ককর্মীদের আন্দোলনের স্লোগানেও কৃষক বিধি, শ্রমিক কোড, নাগরিক পরিচিতি আন্দোলনের দাবি থাকতে হবে।
শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি
দুই বুর্জোয়া
“‘না’ বলার স্বাধীনতা” লেখাটি পড়ে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের কথা মনে পড়ল। কথাটা শুনেই কেউ কেউ হয়তো ভাববেন, কার সঙ্গে কী। বস্তুত এই ‘কার সঙ্গে কী’ যে মনে হচ্ছে, এটাই এই আন্দোলনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। কৃষক আন্দোলনের অটল প্রতিরোধের সামনে কেন্দ্রীয় সরকারের পশ্চাদপসরণের জয় ঘোষণার পরে অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, এই আন্দোলনের চালকদের শ্রেণি পরিচয় এবং সামাজিক অবস্থান, এ সব নিয়ে তর্ক চলছে, চলবে, ও চলা জরুরি। শুনেই একটা খটকা লাগে, কিন্তু তার অবকাশ না দিয়েই লেখক পৌঁছে গিয়েছেন তাঁর মূল কথাতে, যেটি সহজ ভাবে বললে কৃষকদের আন্দোলনের সামনে কর্পোরেট পুঁজির পরাজয়। অর্থাৎ, শ্রেণি পরিচয় নিয়ে তর্কটা শেষ হল না, তার আগেই তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলেন।
মজা হল, কৃষি বিল প্রত্যাহারের পরের দিনই লেখকের একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল এই পত্রিকারই উত্তর সম্পাদকীয় কলমে। সেটি উল্টেও দেখছি মোটের উপর সেই একই কথা, শ্রেণি-পরিচয় সংক্রান্ত বিতর্কটা চলুক, কিন্তু তার আগে আন্দোলনের জয়টা ঘোষিত হয়ে যাক। কেন এক মাস কেটে যাওয়ার পরেও শ্রেণি পরিচয় বিতর্কটা করে ওঠা গেল না, কেন এখনও ‘চলুক, চলুক’ বললেও আসলে বিতর্কটা শুরুই হচ্ছে না, তার কারণটা ভাবলে সেটা সম্ভবত কৃষক আন্দোলনের নৈতিক দিকটাকে ততটা সমর্থন করবে না। সেই জন্যই বোধ হয় ‘বিতর্ক চলুক’ বলে বিতর্কের সংস্কৃতির প্রতি মৌখিক উদারতা দেখিয়ে বিতর্কের আগেই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়ার এই প্রবণতা।
এখানেই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন। এই নির্বাচনের সময় কৃষক আন্দোলন মোটামুটি তুঙ্গ পর্যায়ে। কিছু দুষ্টু লোক বলেছে বটে যে, অত জন মানুষ এক সঙ্গে ওখানে বসে থাকাটা অতিমারির পক্ষে মস্ত সুবিধা করে দিতে পারে, কিন্তু তার তোয়াক্কা না করে কৃষকরা আন্দোলন চালিয়েই গিয়েছেন। অথচ, সেই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের মতো কৃষিপ্রধান রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হল, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এ রাজ্যকে প্রায় তাঁর ঘরবাড়ি করে তুললেন, কিন্তু সেই নির্বাচনে কেন্দ্রীয় সরকারের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কোনও প্রচার শোনা গেল না। বরং শুধুই শোনা গেল বাঙালি সংস্কৃতি রক্ষার ডাক। অবাক ঘটনা নয় কি? এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারে থাকা শাসক দল এখানে হেরে যাওয়ার পরেও কোনও বিরোধী নেতা-নেত্রী এক বারের জন্যও বললেন না যে, এটি কৃষক আন্দোলনেরও জয়, তাঁরাও এর শরিক। সদ্যসমাপ্ত উপনির্বাচনে তো দেখা গেল আরও অদ্ভুত ঘটনা, ভবানীপুরের প্রচারে কৃষক আন্দোলনের কথা উঠে আসছে, কিন্তু দিনহাটা বা গোসাবার প্রচারে তা আসছে না।
এর কারণ সহজ। বস্তুত লেখক নিজেই সেই কারণটা বলেছেন— ‘জোরদার স্বার্থ’ এবং ‘শক্তিশালী সংগঠন’। ‘স্ব-ক্ষমতা’র মতো স্বার্থও একটি অতি শক্তিশালী বিষয় এবং অনেক সময়ই এই বিষয় দুটো এক হয়ে যায়। এই স্বার্থচালিত হওয়ার জন্যই বহু চেষ্টা করেও কমবেশি আড়াইটি রাজ্য বাদে দেশের কোথাও এই আন্দোলনকে প্রসারিত করা যায়নি। পশ্চিমবঙ্গের ভোটেও কৃষক-নেতারা নমো-নমো করে এক দিন এসে প্রচার সেরে চলে গিয়েছেন। কারণ, তাঁরাও জানেন যে, পশ্চিমবঙ্গ থেকেই বহু মানুষ তাঁদের খেত-খামারে চাষ করতে যাবেন। ফলে তাঁদের শ্রেণিচেতনা বেশি জেগে উঠলে তাঁরা হয়তো ওই ‘কর্পোরেট’ (‘বুর্জোয়া’ কথাটা অতি ব্যবহারে জীর্ণ) সংস্থাদেরই সমস্তরীয় মনে করতে পারেন দিল্লি সীমান্তে আন্দোলনরত কৃষকদের। আর রাজ্যের শাসকরাও বেশি উচ্চবাচ্য করেননি কৃষক নেতাদের নিয়ে। তার কারণ এক বার যদি এ রাজ্যের কৃষকরা ওই আড়াইটি রাজ্যের হারে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দাবি করতে থাকেন, তা হলে তো তাঁদের ঘোর বিপদ।
লেখক ভিন্নমতের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ টেনেছেন। যিনি মত দিচ্ছেন না, বা মত জানানোর সুযোগ পাচ্ছেন না, তাঁর যে একটা ভিন্নমত থাকতে পারে, সেটা কি কৃষক আন্দোলনের হোতারা জানেন? না কি ধরে নেব, সেই আমাদের দেশের বামপন্থী ইতিহাসবিদদের পদ্ধতিরই রমরমা— যেখানে সাক্ষ্যের অভাব আর অভাবের সাক্ষ্যকে এক করে দেওয়া হয়?
সহজ কথা— এ হল দুই বুর্জোয়ার বিবাদ। কর্পোরেট এক বুর্জোয়া, ধনী কৃষক আর এক। এক জন নিজের একচেটিয়া অধিকার আর সরকারের থেকে পাওয়া সুযোগ-সুবিধা বজায় রাখতে অন্যকে ঢুকতে দিতে চায় না। কর্পোরেটের নাম আছে, ‘অম্বানী, আদানি’। তাই তাঁরা এ কাহিনির খলনায়ক। আর পঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের সম্পন্ন কৃষকের নাম নেই। সেই সুযোগে তাঁদের দেশের কৃষকদের পরিত্রাতা হিসাবে দেখানোর চেষ্টা চলছে। বিতর্কটা যত দিন না শেষ হয়, তত দিন নাহয় এই ভণ্ডামিটাই চলুক।
সৌম্য, কলকাতা-৩
ধার্মিক
আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু প্রকৃত অর্থেই ধার্মিক। কারণ, তিনি মনুষ্যত্বকেই ধর্ম বলে মেনেছেন (‘ভূতপূর্ব’, ১-১)। ঘৃণা, প্রতিহিংসা তাঁর অভিধানে নেই। আবার, তিনি প্রকৃত রাজনীতিবিদ। কারণ, তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যকে দূর করার জন্য রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামও করেছেন। কখনও অন্য ধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখাননি। সমাজকল্যাণই তাঁর লক্ষ্য ছিল। আজ দেশে তথা বিশ্বে তাঁর মতো মানবতাবাদীদের বড় প্রয়োজন।
সর্বানী গুপ্ত, বড়জোড়া, বাঁকুড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy