ফাইল চিত্র।
“বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম রেল নেটওয়ার্ক এমন বেহাল কেন, যেখানে কোনও ব্যক্তিবিশেষের গাফিলতির পরিণতি এমন ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা?” (অন্তঃসারশূন্য, ৫-৬) সম্পাদকীয়তে উত্থিত এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে রেল মন্ত্রককে। দুর্ঘটনার কারণ যেটুকু জানা গিয়েছে তা হল, ইলেকট্রনিক ইন্টারলকিং এবং পয়েন্ট মেশিনে পরিবর্তন। ইচ্ছাকৃত না কি নাশকতামূলক কাজের অঙ্গ হিসাবে ‘সিগন্যালিং ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ’— কমিশনার অব রেলওয়ে সেফটি এর তদন্ত করবে। চুনোপুঁটিদের দোষী সাব্যস্ত করা সহজ, কিন্তু প্রকৃত দোষী কে? পরিকাঠামোর উন্নয়ন না করে দ্রুতগামী ট্রেন চালানোর ভিতর চমক আছে, তাতে যাত্রীদের কষ্ট লাঘব হয় না। করমণ্ডল এক্সপ্রেস বা যশবন্তপুর-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসের মতো ট্রেনের সংরক্ষিত কামরাগুলো পর্যন্ত রিজ়ার্ভেশন-হীন যাত্রীদের গাদাগাদি ভিড়, যা ব্যস্ত সময়ের লোকালকেও হার মানায়। রেলমন্ত্রী বা উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তিদের কাছে এই তথ্য কি অজানা?
পেটের টানে, রুজির জন্য সুন্দরবন, কাকদ্বীপের যে যুবকশ্রেণি দক্ষিণে রাজমিস্ত্রি বা জোগানদারের কাজের জন্য সদলবলে ছুটে যান, তাঁদের পরিযায়ী শ্রমিক তকমা দিয়ে অনেক গল্পকথা রচিত হয়েছে। হাজার হাজার কিউসেক চোখের জল ফেলা হয়েছে। কেন্দ্র একশো দিনের কাজের টাকা বাকি রাখছে বলে পরিযায়ী শ্রমিকের এই রাজ্যত্যাগের কাহিনি এখন রাজনীতির তরজায় পারস্পরিক দোষারোপে পর্যবসিত। কোন রেলমন্ত্রীর আমলে কত রেল-দুর্ঘটনা ঘটেছে, এই মর্মান্তিক সময়ে সেটাও কি বিবেচ্য? দ্রুতগামী ট্রেন চালানোর জন্য রেলের পরিকাঠামোর উন্নতিসাধন কি সর্বাগ্রে স্থান পাওয়ার যোগ্য নয়? চার মাস আগে সতর্কবার্তা প্রদান করেছিলেন দক্ষিণ-পশ্চিম রেলের প্রিন্সিপাল চিফ অপারেশন্স ম্যানেজার হরিশঙ্কর বর্মা (চার মাস আগে সতর্কবার্তা, ৫-৫)। ‘আপ মেন লাইনে যাওয়ার জন্য সিগন্যাল সবুজ হয়ে থাকলেও, পয়েন্টের অভিমুখ খোলা ছিল লুপ লাইনের দিকে’— করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার প্রাথমিক তদন্তে এই তত্ত্বই উঠে এসেছে।
“অনেক বিদ্যার দান উত্তরাধিকারে পেয়ে তবু/ আমাদের এই শতকের/ বিজ্ঞান তো সংকলিত জিনিসের ভিড় শুধু— বেড়ে যায় শুধু;/ তবুও কোথাও তার প্রাণ নেই ব’লে অর্থময়/ জ্ঞান নেই আজ এই পৃথিবীতে...” (১৯৪৬-৪৭)। কত দিন আগে লিখে গিয়েছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ!
ধ্রুবজ্যোতি বাগচি, কলকাতা-১২৫
উদাসীন
‘অন্তঃসারশূন্য’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে এই চিঠি। ভারতীয় রেলে যাত্রিসংখ্যা ক্রমবর্ধমান। কিন্তু যাত্রী-স্বাচ্ছন্দ্য ও সুরক্ষায় রেল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা দীর্ঘ দিনের। তারই পরিণতি সম্প্রতি করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনার পিছনে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের আমদানি করলেও বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার দায় অস্বীকার করতে পারে না। ২০২২ সাল থেকে দুর্ঘটনার আগাম সঙ্কেত জানানোর জন্য কবচব্যবস্থা মোট রেলপথের মাত্র দুই শতাংশে ও ৬৫টি ট্রেনে আছে। সম্পাদকীয়তে যথার্থ লেখা হয়েছে, বহু রেলসেতু ভগ্নস্বাস্থ্য, বহু জায়গায় লাইন পাল্টানো প্রয়োজন, এখনও বহু লেভেলক্রসিং স্বয়ংচালিত নয়। কর্মীর অভাবও বিপুল। বহিরঙ্গের চাকচিক্যের দিকে নজর দিতে গিয়ে অতি জরুরি নিরাপত্তাব্যবস্থাকে কতখানি অবহেলা করা হচ্ছে, তার হিসাব নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সেই প্রয়োজনীয় হিসাব দিতে সরকার রাজি নয়। তাদের পাখির চোখ আগামী বছরের সাধারণ নির্বাচন। সেই নির্বাচন তরণী পার হওয়ার জন্য জরুরি প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে তুলে ধরা। তাই ধসে যাওয়া পরিকাঠামোর দিকে নজর না দিয়ে প্রতি মাসে প্রধানমন্ত্রী ১১৫ কোটির ‘বন্দে ভারত’ ট্রেনের উদ্বোধন করে চলেছেন।
কৌশিক চিনা, মুন্সিরহাট, হাওড়া
কিছু প্রস্তাব
ভারতীয় রেলে এই শতাব্দীতে উন্নতি যথেষ্ট হয়েছে। কিন্তু বহু দিন পর এক বিধ্বংসী দুর্ঘটনায় হতাহত প্রায় দেড় হাজার। দুর্ঘটনা আর কখনও নয়, কায়মনোবাক্যে সবাই এটাই চায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে যদি হয়ে যায়, তখন ক্ষয়ক্ষতি যেন মাত্রাহীন ও লাগামছাড়া না হয় সেই জন্য কিছু প্রস্তাব রেল মন্ত্রক ভেবে দেখতে পারে।
প্রথমত, এসি এবং নন এসি সকল শ্রেণির কোচে সিট বেল্ট-এর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রত্যেক বসে থাকা যাত্রীকে দিনের বেলা দু’টি ও রাতে শোয়ার সময় তিনটি সিট বেল্ট-এর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। সিট বেল্ট ব্যবহারে অনিচ্ছুক যাত্রীদের ১০০০ টাকা জরিমানা এবং পরবর্তী স্টেশনে নামিয়ে দেওয়া হবে। দ্বিতীয়ত, নির্মাণকালে আপ ও ডাউন লাইনের মধ্যে যথেষ্ট ব্যবধান থাকবে। এতে ট্রেন বেলাইন হলে অন্য লাইনে ছিটকে পড়ার সম্ভাবনা থাকবে না।
তৃতীয়ত, লুপ লাইন এবং মেন লাইনের মাঝে যথেষ্ট ব্যবধান থাকবে। সম্পূর্ণ আলাদা লাইন থাকবে মালগাড়ির ক্ষেত্রেও। চতুর্থত, সরকার রেলকে গতিসম্পন্ন করার প্রয়াস চালাচ্ছে। ২৪০ কিমি গতিতে ট্রেন চলবে বলে রেলমন্ত্রী জানিয়েছেন। যত দিন না পরিকাঠামো নিখুঁত হচ্ছে, অন্তর্ঘাত বন্ধ না হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত ট্রেনের গতি ১৩০ কিমি-তেই সীমাবদ্ধ থাকুক।
সর্বোপরি, ভারতীয় রেলে জরুরি কাজে টিকিট চাইলে পাওয়া যায় না, কিন্তু দালাল অনায়াসে টিকিট দেন বিশাল কমিশনের বিনিময়ে। এই সব অনৈতিক কাজ বন্ধ করতে হবে।
কিশোর পালচৌধুরী, কল্যাণী, নদিয়া
প্রশ্ন থেকে গেল
করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ভয়াবহ দুর্ঘটনায় সারা দেশ শোকস্তব্ধ। এমন দুর্ঘটনার কারণ এখনও অস্পষ্ট। তবুও একটা দিকে তদন্তের অভিমুখ স্পষ্ট হচ্ছে— করমণ্ডল এক্সপ্রেসের সিগন্যাল মেন লাইন হলেও তার পথ ছিল নাকি লুপ লাইনের দিকে। আর সেই লুপ লাইনে মালগাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। এ ক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন উঠে আসছে যে, কোনও অন্তর্ঘাত হয়েছে কি না? এই প্রশ্ন নিয়ে দোষী খোঁজার প্রক্রিয়া চলছে ও চলবে। কিন্তু এমন ঘটনা সম্পর্কে কয়েকটি প্রশ্ন এসে যায়।
নিয়ম অনুযায়ী, লুপ লাইনে মালগাড়ি পুরোপুরি ঢুকে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্টেশন মাস্টারকে মেন লাইন সেট করতে হবে। রেলের ভাষায় যাকে ‘ক্লিয়ার লাইন সেট’ বলে। এ ক্ষেত্রে লুপ লাইনে গাড়ি ঢোকার পর মেন লাইনের সিগন্যাল পরবর্তী গাড়ি, অর্থাৎ করমণ্ডলের জন্য দেওয়া মানে সেই নিয়ম মেনেই হয়েছিল। তবু লুপ লাইন সেট কী ভাবে হল?
লুপ লাইনে মালগাড়ি ঢোকার পর পয়েন্ট নরমাল না হলে মেন লাইনের সিগন্যাল কোনও মতেই হওয়ার কথা নয়। তা হলে সেই পয়েন্ট নরমাল না-করে বা না-হলে মেন লাইনে সিগন্যাল দেওয়া কখনওই সম্ভব নয়। তা হলে লুপ লাইন সেট অবস্থায় মেন লাইনের সিগন্যাল হল কী করে?
লুপ লাইনে মালগাড়ি ঢোকার পর যদি পয়েন্টের গোলযোগ দেখা দিত, তা হলে নিয়ম অনুযায়ী সিগন্যাল স্টাফকে অ্যাটেন্ড করার জন্য ‘কল’ করে যথারীতি ‘ফেলিয়র মেমো’ দিতে হত। সিগন্যাল স্টাফ সেই মেমোর প্রাপ্তিস্বীকার করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করবে। প্রয়োজনে ওই পয়েন্ট ‘নন-ইন্টারলকড’ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে, যার সতর্কতা হিসাবে আগের স্টেশনকে আগত গাড়ির জন্য ওই পয়েন্টে গতি নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিতে হবে। কিন্তু লুপ ও মেন লাইনের সংযুক্ত ওই পয়েন্টের জন্য এমন কোনও সংবাদ নথিভুক্ত হয়নি। তা হলে ম্যানিপুলেশন-এর তত্ত্ব এল কী করে?
এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর কখনও প্রকাশ হবে না। গলা কাটা যাবে সাধারণ স্টাফের, যার উপর দিয়ে পারাপার হয়ে যাবে আর সব কিছু।
নরেন্দ্রনাথ কুলেস্টেশন সুপারিন্টেন্ডেন্ট, মাঝেরহাট, পূর্ব রেলওয়ে
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy