—প্রতীকী ছবি।
‘পলাতক’ (১৫-৫) সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে এই চিঠি। রাজস্থানের কোটার কোচিং সেন্টার থেকে এক পড়ুয়া পড়াশোনার চাপ সহ্য করতে না পেরে ‘নিট’ পরীক্ষার পরের দিন পলাতক হয়ে বাড়ি ফিরবে না বলেছে। বাড়ির লোককে আশ্বস্ত করে বলেছে, সে পড়াশোনা ছেড়ে দিলেও আত্মহননের পথ বেছে নেবে না। তার এই পলায়ন আমাদের এক গভীর বার্তা দিয়ে গেল। বহু কাল ধরে আমরা দেখে আসছি, আমাদের দেশে আর্থিক বৈষম্য থাকা সত্ত্বেও, বাবা-মায়ের গভীর প্রত্যাশা থাকে সন্তানকে কেন্দ্র করে। ছোটবেলা থেকেই এক জন সন্তানের চার পাশে একটু একটু করে প্রত্যাশার পাহাড় তৈরি হতে থাকে। নতুন কিছু শেখা, জানার যে আনন্দ ছোটবেলায় সে পেত, বড় হওয়ার সঙ্গে তা উধাও হয় পারিবারিক এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশের চাপে। সে ক্রমশ বুঝতে পারে একটি প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের মধ্যে পড়াশোনা করেই তাকে নিজের পায়ের উপর দাঁড়াতে হবে। বাস্তব জীবনে তাকে প্রতিটি পদক্ষেপে সম্মুখীন হতে হয় যোগ্যতম হওয়ার কঠিন লড়াইয়ে। বেশ কয়েক দশক ধরে দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশে কর্মসংস্থানের হার যত কমছে, ততই সর্বভারতীয় বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা এবং বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা এক জন পড়ুয়ার জীবনে জীবন-মরণ লড়াইয়ের সমান হয়ে উঠছে। শুধু রাজস্থানের কোটা-ই নয়, এই কলকাতা শহরের বহু কোচিং সেন্টারের গায়ে কান পাতলেই শোনা যায় পড়ুয়াদের উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করে অভিভাবকদের নানা মন্তব্য— ‘তুই এটা ঠিক করতে পারলি না’, ‘এই জানা প্রশ্নটা ভুল করে এলি?’ সবশেষে বলেন, ‘তোর দ্বারা কিছু হবে না’। বাবা-মায়ের প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারলে চরম হতাশা তাদের গ্ৰাস করে। পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে প্রতি ঘণ্টায় এক জন করে পড়ুয়া আত্মহত্যা করে। বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত পরিবারের অভিভাবকরা মনে করেন শুধুমাত্র অর্থের জোগান, প্রাইভেট টিউটর কিংবা কোচিং সেন্টারে সন্তানকে ভর্তি করে দিলেই তাঁদের কর্তব্য শেষ। কিন্তু, সন্তানের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, মনের কথা বোঝা বা শোনার জন্য কতটুকু সময় দেন তাঁরা?
কবি জয় গোস্বামীর ‘টিউটোরিয়াল’ কবিতার শেষ কয়েকটি লাইনে মর্মান্তিক বাস্তবের ছবি ধরা আছে— “না বাপি না, একজন আছে, অপু, একক্লাসে পড়ে/ ও বলে যে ওর বাবাও বলেছে প্রথম হতে/ বলেছে, কাগজে ছবি, ওর বাবা, ওকে.../... বলেছে ও ব্যাক পাবে, ব্যাক পেলে ও বলেছে, বাড়িতে কোথায়/ বাথরুম সাফ করার অ্যাসিড আছে ও জানে,/ হ্যাঁ বাপি হ্যাঁ, ও বলেছে,/ উঠে যাবে কাগজের প্রথম পাতায়...।”
বাবা-মাকে ভাবতে হবে, সন্তান তাঁদের স্বপ্ন পূরণের হাতিয়ার নয়। তার নিজস্ব প্রতিভা এবং অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাকে ফুটিয়ে তুলতে কঠিন, নিরস প্রতিযোগিতার মঞ্চে না ঠেলে দিয়ে, তার প্রতি সহমর্মী, সহানুভূতিশীল হতে হবে, যাতে তার পড়াশোনা একঘেয়েমি না হয়ে, আনন্দপূর্ণ হয়।
অরুণ মালাকার, কলকাতা-১০৩
সীমাহীন চাহিদা
‘পলাতক’ সম্পাদকীয়টি বাস্তবতার নিরিখে অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ও সময়োপযোগী। রাজস্থানের এই কোটা শহরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পড়তে আসা একের পর এক ছাত্রছাত্রীর মর্মান্তিক আত্মহননের ঘটনার কথা বহু বার সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছে। এ বার উঠে এল, সেখানে পড়তে যাওয়া ১৯ বছরের রাজেন্দ্র মীনার নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনা। মা’কে পাঠানো তার বার্তাটি সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে এক অপ্রিয় প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিল। এই অভূতপূর্ব সমস্যার সমাধানে অভিভাবক তো বটেই, রাষ্ট্র ও সমাজ কোনও ভাবেই দায় এড়াতে পারে না। সম্পাদকীয়তে সঠিক ভাবেই বলা হয়েছে যে, ক্রমবর্ধমান এই সব ঘটনার আকস্মিকতায় কোচিং সেন্টারগুলির উপর নজরদারি-সহ সরকারকে সেখানে ঘটে চলা ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কঠোর পদক্ষেপ করতেই হবে। এক দিকে, কোটায় পড়তে পাঠানো ছাত্রছাত্রীদের থেকে অভিভাবকদের গগনচুম্বী আশা-আকাঙ্ক্ষা-প্রত্যাশা, অন্য দিকে কোটায় গজিয়ে ওঠা অসংখ্য কোচিং সেন্টারের এই লাভজনক ব্যবসায়িক রমরমা ও নিজ ‘সুনাম’ বজায় রাখার স্বার্থে আবাসিক ছাত্র-ছাত্রীদের উপর অমানুষিক চাপ সৃষ্টি, এই জাঁতাকলে পড়ে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।
এত সব অসহনীয় চাপের কাছে নতিস্বীকার করে ছাত্রছাত্রীদের কেউ কেউ অনন্যোপায় হয়ে আত্মহননের পথটাই বেছে নিচ্ছে। কোটা তাই আজ ‘আত্মহননের শহর’ হিসেবে সংবাদ শিরোনামে উঠে আসছে। প্রসঙ্গত, আজকের এই কর্পোরেট দুনিয়ার সৌজন্যে শিক্ষা-পাঠ নিতে যাওয়া ও সেই সঙ্গে মোটা বেতনের চাকরির হাতছানিতে পড়ে প্রত্যেক বছর কত পড়ুয়া-প্রতিভাকে অঙ্কুর অবস্থায় এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে, তার খবর অভিভাবকদের কি আদৌ বোধগম্য হয়? সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা আরও যে কত নির্মম কোটা আছে, তার খবর আমরা কতটুকুই বা রাখি?
পরিশেষে, মহামান্য ভারতীয় শীর্ষ আদালতের পর্যবেক্ষণকে শ্রদ্ধা জানিয়েই বলা যায়, অভিভাবকদের সীমাহীন চাহিদার জন্য আজ অসহায় সন্তানদের অকাল মৃত্যুমিছিল প্রতি বছর চোখের সামনে ভেসে উঠছে। অন্য দিকে, রাজেন্দ্রর মতো সন্তানদের অজানা ঠিকানায় নিরুদ্দেশ হতে হচ্ছে। অভিভাবকদের তাই গভীর ভাবে ভাবার সময় এসেছে। বর্তমানে ঘটে চলা এই অশনি সঙ্কেতের প্রেক্ষাপটে এই প্রশ্ন মনের গভীরে তোলপাড় করে চলেছে, এই ধারাবাহিক ‘নির্মম এপিসোড’-এর শেষ কোথায়?
শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, নবদ্বীপ, নদিয়া
সম্ভাবনার মৃত্যু
ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিযোগী রাজেন্দ্র মীনার কোটা শহর ছেড়ে দুঃখজনক নিরুদ্দেশ প্রসঙ্গে সম্পাদকীয় অভিমতের সঙ্গে খানিকটা দ্বিমত পোষণ করি। রাষ্ট্রের দায় তো আছেই, সেটা যথেষ্ট কর্মসংস্থান সৃষ্টির ব্যর্থতা। জীবিকার অনিশ্চয়তার জন্যই অভিভাবকরা প্রাথমিক ভাবে সন্তানের অন্তরে ডাক্তারি-এঞ্জিনিয়ারিং পেতেই হবে— এই মন্ত্রের বীজ বপন করে দেন। কিন্তু তার পর সামলাতে পারেন না, সীমারেখা বুঝতে পারেন না। সন্তানের সীমাবদ্ধতাও মানতে চান না। তাদের মনের সংবাদ রাখতে ভুলে যান। সরকারি নিয়ম করে এই দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে না। নিয়ম যদি করা যায়, তা হলেও এ দেশে তার সঠিক নজরদারি সম্ভব নয়। কোচিং সেন্টারের এই নিয়ে ভাবার দায় আছে কি? এই রকম করেই তো তারা রেজ়াল্ট করছে। পড়ুয়া পাচ্ছে। ২৯টি কাঁচা প্রাণ ঝরে যাওয়ার পরেও তাই সেখানে পড়ুয়ার ঢল কমেনি। তারা অন্য ভাবনা ভাববে কেন?
তবে শুধুই কর্মসংস্থানের অভাব, না বিলাসবহুল জীবন যাপন করা যাবে— এমন জীবিকার অভাব, সেটাও ভাবার বিষয়। এখনকার অভিজ্ঞান তো আর ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’ নয়, বরং ‘আমার সন্তান যেন থাকে রসেবশে’। কিছু শিশুও যেন ‘প্রোগ্রামড’ হয়ে আসে। ছোট থেকেই তারা প্রথম হতে চায়, সেরা হতে চায়। এমন অনেক পড়ুয়া আছে, যারা মেডিক্যাল ছাড়া কিছু পড়বে না, অভিভাবক চাইলেও না। এদের কেউ সফল হয়, আবার কেউ তিন-চার বার প্রচেষ্টার পর হতাশ, ব্যর্থ জীবন যাপন করে। জীবনের অনন্ত সম্ভাবনাময় বিরাট ক্যানভাস ছোট করে দিচ্ছে পরিস্থিতি, অভিভাবক, ছাত্র, সমাজ, রাষ্ট্র সবাই মিলে। একযোগে না এগোলে সমাধান সুদূরপরাহত থেকে যাবে।
সৌমেন রায়, কুলিয়াড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy