জিডিপি বৃদ্ধির হার নিয়ে অমিতাভ গুপ্তের সন্দেহ অমূলক নয় (‘ক’জন ঘুরে দাঁড়ালেন?’, ১১-১)। তবে কোভিড-পূর্ববর্তী দশার মতো না হলেও, অর্থনীতির চাকা যে কিছুটা হলেও সচল হয়েছে, এ কথা অনস্বীকার্য। আসলে আমাদের গতানুগতিক ব্যবস্থায় জিডিপিকেই আমরা অর্থনৈতিক অগ্রগতির মানদণ্ড ধরে নিই। সরকারি পরিষেবা, ব্যক্তিগত ব্যয় ও মূলধন নির্মাণ— এই তিনটি উপাদান এ ক্ষেত্রে ধর্তব্যে আনা হয়; বাস্তুতন্ত্রকে কখনওই ধর্তব্যে আনা হয় না। যদিও বাস্তুতান্ত্রিক পরিষেবার অর্থনৈতিক পরিসর কোনও অংশে কম নয়। অত্যধিক স্থায়ী মূলধন নির্মাণে জিডিপি হয়তো বাড়ে, কিন্তু সেই সঙ্গে পরিবেশের উপর পড়ে খারাপ প্রভাব। কেননা, এই মূলধন খরচ হয় পরিকাঠামো নির্মাণে, আর কে না জানে পরিকাঠামো নির্মিত হয় পরিবেশের বুক চিরে! যে পরিমাণ পরিবেশ এ ক্ষেত্রে ধ্বংস হল, অর্থনীতিক মাপকাঠিতে তার পরিমাণ হয়তো ছিল আরও অনেক বেশি— কিন্তু কে তার হিসাব রাখে! তাই জিডিপির পাশাপাশি যদি জিইপি-কে (গ্রস এনভায়রনমেন্টাল প্রোডাক্ট) অর্থনৈতিক অগ্রগতির মানদণ্ড হিসাবে ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয়, একমাত্র তা হলেই সত্যিকারের অগ্রগতি চোখে পড়বে বলে মনে হয়। জিইপি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে জিডিপি বাড়ানোর জন্য কী পরিমাণ বাস্তুতান্ত্রিক পরিষেবা আমরা হারিয়েছি, তার অর্থনৈতিক পরিমাণটাই বা কত। দুঃখের বিষয়, সেই ১৯৯৭ সালে বিশিষ্ট বাস্তুতান্ত্রিক অর্থনীতিবিদ রবার্ট কস্তঞ্জা জিইপি নিয়ে আলোকপাত করলেও ভারতে এই বিষয়ে বিশেষ চর্চা হয়নি। যদিও সম্প্রতি উত্তরাখণ্ড সরকার জিডিপির পাশাপাশি জিইপি-ও প্রকাশ করবে বলে জানিয়েছে, যা একমাত্র আশার আলো।
মানসী দেবনাথ
পূর্ব মেদিনীপুর
ক্ষতির মাপ
‘ক’জন ঘুরে দাঁড়ালেন’ লেখাটির জন্য লেখককে ধন্যবাদ। এই অর্থবর্ষে জিডিপি বৃদ্ধির হার ৯.২ শতাংশই দাঁড়াবে, এটা যদি ধরেও নেওয়া যায়, তবু কি সরকারি কর্তাদের দাবি মতো ‘কোভিডের ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করে ফেলল ভারত,’ এমন কথা বলা যায়? কোভিডের ক্ষয়ক্ষতি কি শুধু উৎপাদনের পরিমাণে? কোভিডকে কেন্দ্র করে লাগাতার লকডাউনের ফলে অজস্র মানুষ কাজ হারালেন, তাঁদের পরিবারগুলি ভেসে গেল, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ হল, পরিবারের চিকিৎসা বন্ধ হল, স্কুল-কলেজ বন্ধ হওয়ার কারণে কোটি কোটি ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষার বিপুল ক্ষতি হল, তাদের ছাত্রজীবন থেকে কয়েকটি বছর মুছে গেল, লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক বাড়ি ফিরতে গিয়ে অমানুষিক অভিজ্ঞতার শিকার হলেন, পথেই অনেকের মৃত্যু হল। স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পূর্ণ বয়সে পৌঁছনোর আগেই কত কিশোরীর বিয়ে হয়ে গেল, হারিয়ে গেল মানুষ হওয়ার স্বপ্নগুলি। কত বেকারের কাজ পাওয়ার সুযোগ হারিয়ে গেল, হারিয়ে গেল সম্মানের সঙ্গে বাঁচার স্বপ্ন। এগুলি কি বিরাট ক্ষতি নয়? এই ক্ষতি সরকারি কর্তারা কী দিয়ে পূরণ করবেন? যে হাজার হাজার ছোট-মাঝারি শিল্প, সংস্থা, কারবার বন্ধ হয়ে গেল, পারবেন তাঁরা সেগুলি খোলার ব্যবস্থা করতে? পারবেন সেখানে নিযুক্ত লক্ষ-কোটি শ্রমিক-কর্মচারীর কাজ ফিরিয়ে দিতে?
আসলে তাঁদের বিচারটা শুধুমাত্র উৎপাদনের কমা-বাড়ার মাপকাঠিতে। উৎপাদনের কমা-বাড়া দেশের মানুষের জীবনে যে প্রভাব ফেলে গেল, তার হিসাব তাঁরা নিতে রাজি নন। যদি নিতেন তা হলে শুধু জিডিপির হার বৃদ্ধিতেই সব ক্ষয়ক্ষতি পূরণ হয়ে গেল বলতেন না। লেখাটিতে স্পষ্ট, এই হার বৃদ্ধির সঙ্গে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক যদি কিছু থেকে থাকে তা হল এই যে, তাঁদের শোষণ করেই, লুণ্ঠন করেই এই মুষ্টিমেয়ের সম্পদ বৃদ্ধি। লকডাউনের মধ্যে যখন দেশের সাধারণ মানুষ করোনার আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য প্রাণপণ লড়াই করছেন তখনই দেখা গেল মাস্ক, স্যানিটাইজ়ার, ওষুধ, ভ্যাকসিন, চিকিৎসা-যন্ত্রপাতির ব্যবসা করে এক দল পুঁজিপতি শত-কোটিপতি বনে গেলেন।
অন্য দিকে, যখন পরিবারের মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দেবেন কী করে সেই চিন্তায় অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়া মানুষের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ছে, ঠিক তখনই সরকার একের পর এক আইন এনে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প-সংস্থা-সম্পদ সব কিছু পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিচ্ছে। উল্টো দিকে, শ্রম আইন বদলে শ্রমিক-কর্মচারীদের অধিকারগুলি কেড়ে নিচ্ছে। এর ফলে তাঁদের আট ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হবে, মালিকরা যখন খুশি ছাঁটাই করতে পারবেন, কাজের জায়গায় স্বাস্থ্য ও অন্যান্য নিরাপত্তা মিলবে না, সমান কাজে সমান বেতন পাওয়ার অধিকার থাকবে না। অথচ দেশের উৎপাদন যদি বেড়ে থাকে, তা তো এঁদেরই অবদানে। সমাজের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি যাঁদের কঠোর পরিশ্রমে তাঁদের রইল না শুধু তাতে কোনও অধিকার। তাঁরাই আজ রইলেন সব অধিকার থেকে বঞ্চিত, এমনকি বাঁচার অধিকার থেকেও। আর তাঁদের পরিশ্রমের ফলেই ফুলে উঠছে মুষ্টিমেয় শিল্পপতি-পুঁজিপতির মুনাফার পাহাড়।
সরকারি কর্তারা, নেতা-মন্ত্রীরা একেই অর্থব্যবস্থার ‘ঘুরে দাঁড়ানো’ বলে তুলে ধরছেন।
সমরেন্দ্র প্রতিহার
কলকাতা-৪
চূড়ান্ত বৈষম্য
অমিতাভ গুপ্ত যথার্থই বলেছেন যে, অর্থব্যবস্থা যদি বা ঘুরে দাঁড়ায়, তার সুফল দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে না, যাচ্ছে মুষ্টিমেয় ধনীর হাতে। গত দু’-বছরের বেশি সময় অতিমারির কোপে বিপর্যস্ত অর্থনীতি। সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্র মিলিয়ে কয়েক কোটি মানুষ কর্মচ্যুত। অথচ, ধনী-অতিধনীদের জীবনে তা এনে দিয়েছে বিরাট সৌভাগ্য। ‘আইআইএফএল ওয়েলথ হুরুন ইন্ডিয়া’-র প্রকাশিত ২০২১-এর রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, করোনার আবহেই গত এক বছরে শিল্পপতি গৌতম আদানি এবং তাঁর পরিবার দৈনিক আয় করেছেন ১০০২ টাকা। সম্পত্তি ১,৪০,২০০ কোটি টাকা থেকে ২৬১ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৫,০৫,৯০০ কোটি। বিত্তবানদের তালিকায় আদানিরা এখন ভারতের তথা এশিয়ার দ্বিতীয় ধনী পরিবার। প্রথম স্থানে রয়েছেন রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রির কর্ণধার মুকেশ অম্বানী। তাঁর দৈনিক রোজগার ১৬৩ কোটি টাকা। এক বছরে সম্পত্তি ৯ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭,১৮,০০০ কোটি। শুধু তো আদানি-অম্বানীরা নন, গত বছরের একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ভারতের বিলিয়নেয়ারদের সম্পত্তি বেড়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। এ তো সীমাহীন বৈষম্য! এমন অতিমারির সময়ে সাধারণ মানুষ যখন সর্বস্ব হারাচ্ছেন তখন এমন মুনাফা এই পুঁজিপতিরা করতে পারছেন কী করে!
আর্থিক বৃদ্ধিতে দেশ এগিয়ে চলেছে, এ যদি সত্য হয়, তবে একের বঞ্চনাতেই যে অপরের সমৃদ্ধি, এ কথা অস্বীকার করা যায় না। অন্তত অর্থনীতি তো তা-ই বলে। এবং এই বঞ্চনার সুযোগ, এই অতি মুনাফার সুযোগ দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে বলেই তো তা সম্ভব হচ্ছে! যিনি সবার সঙ্গে থেকে সবার বিকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশের বেশির ভাগ মানুষের ভয়াবহ দুর্গতি এবং মুষ্টিমেয় মানুষের এমন বীভৎস ‘বিকাশ’ দেখেও নীরব কেন?
অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিমারির ফলে বৃদ্ধি পাওয়া অর্থনৈতিক বৈষম্য ভারতে দীর্ঘস্থায়ী হতে চলেছে। এই অবস্থায় দারিদ্র মোকাবিলায় সরকারের উচিত অবিলম্বে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প নেওয়া, মূল্যবৃদ্ধি রোধ করা, কর কমানো এবং ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, সর্বোপরি ধনীদের উপর চড়া কর বসানা। দেখা যাচ্ছে, রেশনে কেন্দ্রীয় চাল-গম বরাদ্দ বন্ধ করা হচ্ছে, অথচ, সরকার পুঁজিপতিদের জন্য হরেক রকমের প্যাকেজ, ছাড় প্রভৃতি ঘোষণা করে চলেছে। একই দেশের নাগরিক দরিদ্রদের জন্য কেন একই রকম বরাদ্দ করা হবে না? সরকারটা তো তাঁদেরও!
শিলাই মণ্ডল
গড়বেতা, পশ্চিম মেদিনীপুর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy