২০২১ সালের সাহিত্যে নোবেজয়ী আব্দুরাজ়াক গুরনা সম্পর্কে লেখাটিতে (‘নামভূমিকায়’, ৩১-১০) শিশির রায় শেষে লিখেছেন, “ইদানীং বড্ড ডান দিকে ঝুঁকে থাকা এই পৃথিবীর জন্য তা বড়ই সুখবর।” এই বক্তব্যকে একশো শতাংশ সমর্থন করছি। ১৯৮৬ সালে এক আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ সাহিত্যিক নাইজ়িরিয়ার ওলে সোয়িঙ্কা সাহিত্যে নোবে পেয়েছিলেন। পঁয়ত্রিশ বছর পর ফের এক আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি সাহিত্যের নোবে জিতে নিলেন। এ কথা উঠছে, তার কারণ সাহিত্যের নোবে পুরস্কারের পিছনে তথাকথিত প্রথম বিশ্বের অভিজাত শ্রেণির মাথা কাজ করে। সে সব বাধা টপকে এ রকম এক জন কথাকারের নোবে পাওয়াটা আমাদের একটু অবাক করে বইকি। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে। গত ছ’বছরে সাহিত্যে যাঁরা নোবে পেয়েছেন, তাঁদের চার জনই ইংরেজি ভাষায় লেখেন। আগের বছরেও (২০২০) এই পুরস্কার পেয়েছিলেন আমেরিকান কবি লুইস গ্লাক। তাই অনেকে বছেন, সেই ‘এলিট’ ইংরেজি ভাষাই তো রয়ে গে। তবে গুরনার লেখা কতটা মর্মস্পর্শী ও গভীর, তা অন্বেষণ করলে বোঝা যায় যে যোগ্য ব্যক্তিকেই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। তাঁর উপন্যাস (প্যারাডাইস এবং বাই দ্য সি) বুকার প্রাইজ়ের মনোনয়ন তালিকায় থাকলেও, শেষে পুরস্কারটা আর ভাগ্যে জোটেনি।
লেখকের জন্ম পূর্ব আফ্রিকার জাঞ্জিবারে, ১৯৪৮ সালের ২০ ডিসেম্বর। আরবিতে ‘জাঞ্জিবার’ শব্দের অর্থ ‘কালো মানুষের ভূমি’। ব্রিটিশরা ১৯৬০ সালে পাশের ভূখণ্ড টাঙ্গানিকা ছেড়ে যখন চলে যায়, তখন জাঞ্জিবার ও টাঙ্গানিকাকে একটা রাষ্ট্র হিসাবে যুক্ত করে। দুই ভূখণ্ড মিলে নাম হয় ‘তানজানিয়া’। মাত্র ১৮ বছর বয়েসে লেখক স্বভূমি ছেড়ে ব্রিটেনে পালিয়ে এসেছিলেন উদ্বাস্তু হিসাবে, কারণ সেই সময় আরব-বংশোদ্ভূতদের উপর অত্যাচার শুরু হয়। আর গুরনাও ছিলেন তাঁদের এক জন। এর পর তিনি ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করে সেখানেই স্থিত হন।
তাঁর দশটি উপন্যাসের বিষয়বস্তুর প্রধান বৈশিষ্ট্য হ তাঁর নিজের জীবন বর্ণনা, যার মধ্য দিয়ে তিনি পৃথিবীর সমস্ত ছিন্নমূ মানুষের কথা বলেছেন। প্রতি কাহিনিতে সংযোজিত হয়েছে নতুন ধরনের বেদনা, আশা ও হতাশা। আর এ সব লিখেছেন উনি ইংরেজি ভাষায়! গুরনার মাতৃভাষা সোয়াহিলি, যদিও তাঁর বংশধারা আরবের। তবে গুরনার সাহিত্যরচনার ভাষা ইংরেজি হলেও, জীবনের বৃহত্তম সময় তিনি ব্রিটেনের কেন্ট বিশ্ববিদ্যায়ে অধ্যাপনা করলেও, এবং তিনি বুকার প্রাইজ়ের বিচারক হলেও, তাঁকে আমরা পুরোপুরি আফ্রিকার লেখক হিসাবেই ভাবব, বাদামি সাহেব নয়। তাই তাঁর লেখায় অন্যান্য ভাষার সঙ্গে অনায়াসে ঢুকে পড়েছে সোয়াহিলি ও আরবি শব্দ, বাক্যবন্ধ, বাগধারা ইত্যাদির বিচিত্র বিন্যাস।
ছিন্নমূ জীবনযাত্রার কথাকার আব্দুরাজ়াক গুরনার নোবেপ্রাপ্তিতে তৃতীয় বিশ্বের মানুষ হিসাবে আমরা উল্লসিত।
অশোক বসু
বারুইপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
প্রান্তিক
কাহিনির অভ্যন্তরের ঘটনাগুলির ওঠা-পড়া কি এক জন লেখকের জীবনসত্য ধরতে পারে? হয়তো তা নয়। শিশির রায়ের প্রবন্ধে উঠে আসে আরও ব্যঞ্জনাময় তথ্য। তাঁর বইতে ইংরেজি-কেন্দ্রিকতা প্রবর্তিত গ্লসারি বা ‘আইটা’-এর অপরাত্মক কব থেকে সোয়াহিলি বা জার্মান শব্দকে ইংরেজি শব্দের পাশে স্বাধীন সহাবস্থান দিতে প্রকাশকের সঙ্গে ড়েছিলেন গুরনা। যে ছিন্নমূ, শরণার্থীদের কথা বার বার গুরনা তুলে এনেছেন তাঁর সাহিত্যে, পুঁজিবাদ ও দক্ষিণপন্থায় ভেসে-যাওয়া আস্ফানের পৃথিবীতে সর্বহারাদের জন্য নিরস ভাবে যে একটি বিশ্বস্ত ঠাঁই তিনি গড়েছেন, তা বস্তুত প্রান্তিকতাকে মান্যতা দেওয়ার একটি প্রকল্প। নিজের রচনায় তিনি ভাষাগত ক্ষমতায়নের জমিতে ইংরেজি, সোয়াহিলি ও জার্মানকে এক মঞ্চে, সমানাধিকার দিতে চেয়েছেন।
বিশ্বজোড়া ‘জনপ্রিয়’ সব নামের মাঝে নোবেপ্রাপ্তির ‘ক্বচিৎ কিরণে দীপ্ত’ গুরনা পাঠকমহলে অনেকের কাছেই নতুন। কিন্তু ভুলে চবে না, গুরনা আসলে এক সুদীর্ঘ পরম্পরার বাহক। জে এম কোয়েটজ়ি, ডরিস লেসিং, বা সমন রুশদিদের লেখায়, বা পূর্বতন আরও অসংখ্য সাহিত্যিকের বয়ানে শিকড়হারাদের আখ্যান উঠে এসেছে। উত্তর-ঔপনিবেশিক কালে সাংস্কৃতিক সীমানা দ্রুত সরে যাচ্ছে, ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক ভাগাভাগির যুগে ‘ডায়স্পোরা সাহিত্য’ হয়ে উঠেছে মানবতার বিশ্বজোড়া সঙ্কটের আয়না। যত গেড়ে বসছে ধনতন্ত্রের শিকড়, ততই পায়ের তলা থেকে মাটি সরছে ক্ষমতাহীন প্রান্তিকের। রাজনীতির বাতাসে যখন তোপাড় হয় দেশ-কা, গড়ে ওঠে সরকার, ভাঙে সংবিধান, রক্তচক্ষু দেখায় শহর, পিছোতে পিছোতে সাগরে মিশে যায় গ্রামের পর গ্রাম, বোড়ে বানিয়ে রাখা এই মানুষদের ডিঙি নৌকো কেবই এ পারে-ও পারে ধাক্কা মারে গিয়ে, কিন্তু ঠাঁই হয় না কোথাও।
নির্বাসনে থেকে যাঁরা ঘরের কথা বলেন, ঘরের খোঁজ করেন, আব্দুরাজ়াক গুরনা তাঁদেরই এক জন। ঘর শেষ অবধি পাওয়া যাচ্ছে কি না, সে প্রশ্ন এখানে মূ হয়ে ওঠে না। সন্ধান, প্রয়াস ও অসম্ভব এক নিবদ্ধতা এই চনকে সুরে বাঁধে।
শুভঙ্কর ঘোষ রায় চৌধুরী
ককাতা-৩১
চাই অনুবাদ
নীরবে কাজ করে-যাওয়া সাহিত্যিকরা সারা বিশ্বে খুবই জনপ্রিয় হবেন, আশা করা চলে না। নিয়মিত পাঠকদের মধ্যে মাত্র পাঁচ শতাংশ আব্দুরাজ়াক গুরনার লেখার সঙ্গে পরিচিত। নোবে পাওয়ার পর তাঁর বই হয়তো বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত এবং প্রকাশিত হবে। কিন্তু বাঙালি পাঠকদের নোবেপ্রাপকদের বিষয়ে খুব সিরিয়াস হতে দেখা যায় না। ছাত্রপাঠ্য বইগুলোতে এ ধরনের অনুবাদও খুব কম। কত জন বাঙালি পাঠক ওলে সোয়িঙ্কা, জোসেফ ব্রডস্কি, অক্তাভিয়ো পাস-এর নাম শুনেছেন? আব্দুরাজ়াক গুরনা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, এখানকার উদ্বাস্তু সমস্যা তার সমান্তরা হতে পারে। এ বিষয়ে দুই বাংলাতেই প্রচুর সাহিত্য রচিত হয়েছে। কিন্তু কতগুলো বই অন্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে? আমরা বোধ হয় বাংলা ছাড়া অন্য ভাষার সাহিত্য পড়ছি না, বাংলা সাহিত্যকে অনুবাদ করার ব্যাপক উদ্যোগ করছি না। অথচ, নোবেপ্রাপকদের নাম অপরিচিত বলে মৃদু গঞ্জনার সুরে কথা বলি।
শঙ্খ অধিকারী
সাবড়াকোন, বাঁকুড়া
হেমেন্দ্র-সাহিত্য
প্রমিতি চট্টোপাধ্যায়ের ‘মৃত্যুর শহরে এক লেখক’ (রবিবাসরীয়, ৩১-১০) প্রবন্ধ সূত্রে কিছু কথা। হেমেন্দ্রকুমার রায় ছিলেন বাস্তবনিষ্ঠ সামাজিক কথাকাহিনিরও অন্যতম এক রূপকার। তাঁর ‘নিয়তি’ বা ‘চোর’ পুরোপুরি সংসার জীবনের গল্প। ‘পোড়ারমুখী’ গল্পটি হিন্দু নারীর সতীত্বের প্রতি অপমানের অভিযোগে এক সময়ে জনমানসে বিরাট আলোড়ন তুলেছি। তিনি লিখেছিলেন ‘কুসুম’ ও ‘শিউলি’-র মতো পতিতার প্রণয় কাহিনিও। তাঁর রচনায় এই মেয়েরা সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে উত্তরণ পিয়াসি।
হেমেন্দ্রকুমার ছিলেন ভারতী গোষ্ঠীর অন্যতম লেখক। তিনি বাংলা সাহিত্যের ধারাকে আধুনিক যুগের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সচেষ্ট ছিলেন। ছি নতুনকে বরণ করে নেওয়ার আগ্রহ। রোম্যান্টিক গল্পের পাশাপাশি লিখেছেন অসংখ্য আধুনিক বাংলা গান। রহস্য কাহিনির লেখক হিসাবে অত্যন্ত জনপ্রিয় হেমেন্দ্রকুমার এক সময় কিশোরদের উপযোগী কল্পবিজ্ঞান লিখেও সাড়া জাগিয়েছিলেন। তিনি চাইতেন ছেলের দ ডানপিটে হোক, আপদ-বিপদের কোলে মানুষ হোক। তিনি মনে করতেন, “স্কুলের মরা পুঁথির কালির আঁচড়ে ছেলেরা মানুষ হয় না, তারা মানুষ হয় পাঠশালার বাইরে, বিপু বিশ্বের ভিতর ছুটে বেরিয়ে গিয়ে বিচিত্র লিভিং বুক পাঠ করে” (আবার যখের ধন ভূমিকা)।
সুদেব মা
খরসরাই, হুগলি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy