মনোরঞ্জন ব্যাপারী।
দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমি গঠিত হওয়ার পর থেকে সমাজমাধ্যমে একটি প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে, সাহিত্যের আবার দলিত-অদলিত হয় নাকি? তাঁদের দোষ দেওয়া যায় না। সাহিত্যের এই ধারাটি সম্পর্কে আলোচনা হয় না বলেই অনেকের কাছে বিষয়টা রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা বলে মনে হয়েছে। দলিত সাহিত্য বিষয়টা ইসলামি সাহিত্য, বৈষ্ণব সাহিত্য, মার্ক্সীয় সাহিত্যের মতো সাহিত্যেরই একটি ধারা। হিন্দি, কন্নড়, পঞ্জাবি, তেলুগু, তামিল ও মরাঠি ভাষায় কয়েক দশক আগে থেকেই এই সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা চলছে।
এই সাহিত্যের লেখক বা কবি শুধু জন্মসূত্রে দলিত হলেই হবে না। তাঁর সাহিত্যে উঠে আসবে দলিত জীবন ও সমাজের কথা। মনোরঞ্জন ব্যাপারীর (ছবিতে) অক্ষরজ্ঞান হয়েছিল জেলখানায়। অন্যের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে নিজের জীবন নিজের মতো করে লিখেছিলেন বলেই তিনি বাংলার দলিত সাহিত্যের সম্রাট। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২১। বাতাসে বারুদের গন্ধ ও ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন বই দু’টি ইংরেজি ছাড়াও অনেকগুলি আঞ্চলিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর কমপারেটিভ লিটরেচার-এর অধ্যাপক টুটুন মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘দলিত সাহিত্য বিষয়ক সচেতনতা বাংলায় ছিল না সে অর্থে, যে অর্থে রয়েছে মরাঠি, তেলুগু, তামিল বা হিন্দি সাহিত্যে। দেবেশ রায়ের সম্পাদনায় ভারতীয় দলিত সাহিত্যের অনুবাদ ছাড়া আর চোখে পড়েনি দলিত সাহিত্যের কথা। মনোরঞ্জন ব্যাপারী সাহিত্য ও ইতিহাসের সেই দাবি পূরণ করে চলেছেন।’’ দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমি তৈরি করে, ও সেই অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যান পদে মনোরঞ্জন ব্যাপারীর মতো ব্যক্তিকে বসিয়ে এই সাহিত্যের উপকার করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর যা-ই হোক, পরবর্তী প্রজন্মকে ‘দলিত সাহিত্য ও দলিত সাহিত্যিক’ কথাটা শুনে আকাশ থেকে পড়তে হবে না।
পিন্টু পোহান
কলকাতা-৮
পরিচয়ের বহুত্ব
অনেকের মনে থাকবে, জাতভিত্তিক সংরক্ষণের বিরোধিতায় কলকাতার ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় জুতো পালিশ করতে বসে পড়েছিল। খবর হল, কিন্তু প্রতিবাদের ধরনে এমন একটা অশ্লীলতা নিয়ে কেউ কিছু বললেন না। প্রতীকটা ছিল স্পষ্ট— সংরক্ষণের কারণে আমাদের চাকরিবাকরি জুটবে না। আমাদের জুতো পালিশের মতো ‘নিচু’ পেশায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে!
তিন দশক পর যখন কলকাতার শিক্ষকরা আদিবাসী সহ-শিক্ষিকাকে জাত তুলে গালাগাল দেওয়ার বিরুদ্ধে জড়ো হন, তখন মনে হতেই পারে, সমাজ এগিয়েছে। শিক্ষিত মানুষেরা জাতভিত্তিক শোষণ-উৎপীড়নের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন, এবং হয়তো সংরক্ষণের বিরোধিতার মাত্রা কমেছে। কিন্তু, সত্যিই হচ্ছে? মনে হয় না। শিক্ষিকার সমর্থনে যেমন অনেকে জুটলেন, তেমনই আবার ছাত্রীটির সমর্থনেও অনেকে দাঁড়িয়ে গেলেন, ছাত্রীটির মন্তব্য অ-সামাজিক হওয়া সত্ত্বেও। সুচন্দ্রা ঘটক ঠিকই লিখেছেন (সম্পাদক সমীপেষু, ১৬-৯): ‘জাত’ এবং ‘কোটা’-র সুবিধে নিয়ে বিদ্বেষ ওই ছাত্রীটির একার নয়। সংরক্ষণের আওতায় না-থাকা বহু ছাত্রছাত্রী এবং তাদের মা-বাবা মনে করেন, সংরক্ষণ যত নষ্টের গোড়া। চাষি ভাবেন, মজুরই তাঁর চাষে লোকসানের কারণ, মজুর ভাবেন, চাষি তাঁকে শোষণ করে চলেছেন। অথচ, সার-ওষুধ-বীজ কোম্পানি, সরকারি নীতি, ব্যাঙ্ক— এই সব মহাশত্রু আড়ালেই থেকে যায়। তেমনই সরকারি নীতির কারণেই যে চাকরির বাজার ভয়ানক সঙ্কুচিত হয়ে যায়, সে দিকে দৃষ্টি পড়ে না। এমন অবস্থায় শিক্ষকদের কাজ, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বিশদে আলোচনা করা, তাদের চোখের সামনে বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরা। এ কাজটা শুরু করতে পারতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শিক্ষিকা। তিনি উচ্চশিক্ষার জগতে লব্ধপ্রতিষ্ঠ, আর ছাত্রীটি এখনও ছাত্রী, যে জাতেরই হোক। শিক্ষিকা নিজে নিপীড়নের শিকার ঠিকই, কিন্তু তা বলে তিনি তাঁর শিক্ষিকাসত্তাটা ভুলে যাবেন কেন? তা হলে আর পরিচিতির বহুত্ব নিয়ে সেমিনার করে কী লাভ?
শাশ্বতী নস্কর
পাথরপ্রতিমা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
জীবনই পাঠ্য
‘ওদের রক্তে জোয়ার-ভাটা খেলে’ (১২-৯) খুব গুরুত্বপূর্ণ লেখা। সুন্দরবন অঞ্চলে সায়েন্স ক্যাম্প করার সুবাদে কিছু অভিজ্ঞতা সূত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ দুটো বিষয় লেখকরা তুলে ধরেছেন। ‘হাতেকলমে পরীক্ষা’ দেখার সময় ম্যাজিক দেখার উৎসাহ, কিন্তু কেন এমন হচ্ছে, তার ব্যাখ্যা ছাত্ররা শুনতে চায় না। কেন? খুব সম্ভব, ‘ব্যাখ্যা’ তারা বুঝতে পারে না, তাই ভাল লাগে না শুনতে। লেখকরা যদি প্রথম দিকে শিশুদের দিয়েই খুব সাধারণ পরীক্ষা করাতে পারতেন, তা হলে ওরা পর্যবেক্ষণগুলো মনে মনে সূত্রায়িত করতে পারত। হয়তো, পূর্বের ধারণা দিয়ে পরের পরীক্ষার ব্যাখ্যাও করতে পারত।
ওখানকার এক বিজ্ঞানের মাস্টারমশাই বলেছিলেন, “ওরা বইয়ে যা পড়ে, তার সঙ্গে ওদের জীবনের বা বাস্তবের কোনও সম্পর্ক নেই। আবার জীবন থেকে বা বাস্তব থেকে যা শেখে, তার সঙ্গে বইয়ের তেমন সম্পর্ক নেই।” ১৮৯২ সালে রবীন্দ্রনাথ ‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধে এমন কথাই লিখেছিলেন, “আমাদের এই শিক্ষার সহিত জীবনের সামঞ্জস্যবিধানই এখনকার দিনের সর্বপ্রধান মনোযোগের বিষয় হইয়া দাঁড়াইয়াছে।” মানে, ১২৮ বছরেও প্রয়োজনীয় পরিবর্তন হয়নি।
ধরা যাক, সুন্দরবনের শিশুর জীবনের কথা তাদেরই কথ্য ভাষায় লিখে বই ভরা থাকল। তা হলে সে বই তো পাথর খাদানের শিশুর জীবনের কথা বলবে না। তাই আমরা বর্তমানে চালু বইগুলো লিখি অনেকের কথা একটুআধটু করে নিয়ে। ভাষা নিয়েও সমস্যা! কার ভাষায় লেখা হবে বই? শেষ পর্যন্ত মান্যচলিত ভাষাতেই লেখা হয়। তবে যাঁরা লেখেন বইগুলো, তাঁরা অধিকাংশই সমভূমি অঞ্চলের শিক্ষিত, ভদ্রজন। তাই তাঁদের জীবনের কাছাকাছি হয়ে যায় বইগুলো। ভাষাটাও তাঁদেরই মতো। এ ভাবে পাঠ্যবই ও পাঠ্যসূচি মোটামুটি ভাবে সংরক্ষিত থাকে শিক্ষিত ভদ্রসমাজের সন্তানদের জন্য।
এই অবস্থা কি আমরা সত্যিই বদলাতে চাই? সবাই যাতে তার নিজের কাছের ঘটমান বর্তমানকে হাতেকলমে পরীক্ষার বিষয় করতে পারে, তেমন ব্যবস্থা চাই? ব্যাপারটা অসম্ভব নয়। মূল পাঠ্যক্রম একই রেখে প্রথম দিকের কয়েকটা ক্লাস পর্যন্ত কিছুটা আলাদা হবে পাঠ্যসূচি, পাঠ্যবই। নিজের চেনা পরিবেশের সাহায্য নিয়ে শুরু হবে বর্ণপরিচয়। ভাল করে পড়তে লিখতে শেখার পর অন্যের পরিবেশের কথা পড়বে। তার পর একই পাঠ্যে সবার শিক্ষা চলবে।
সুন্দরবনের শিশুর পাঠ্যে তার জীবনই থাকবে। তবেই সে পড়তে আনন্দ পাবে। আবার কয়লাখনির পাড়ে বাস করা শিশুর সমস্যা কবে, কোথায় খনির পাড় ধসে যায়! তার সাহিত্য, বিজ্ঞান, গণিত সবই চেনা জীবনকে যাতে নতুন করে চিনতে সাহায্য করে, তা দেখতে হবে।
হয়তো প্রথম দিকে বই লেখার লোক পাওয়া কঠিন হবে। শিক্ষকদেরও অনেকে সহজে মানিয়ে নিতে পারবেন না। তবু এক বার বুঝতে পারলে তাঁরা দেখবেন, ব্যাপারটা সহজই। আসল সমস্যা অন্যত্র। সাম্য সম্পর্কে আমাদের স্থূল, যান্ত্রিক ধারণা বদলাতে হবে। শিয়াল এবং সারসকে একই পাত্রে খেতে দিলে তাদের সমস্যা হয়, ছোটবেলায় পড়া এই গল্পের শিক্ষাটার সৃজনশীল প্রয়োগ করতে হবে।
দেবব্রত মজুমদার
কলকাতা-৮১
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy