ঋতুস্রাব বা পিরিয়ড ঘেন্নার বিষয় নয়। প্রতীকী ছবি।
‘বাজেটে মেয়েদের সঞ্চয়ী হতে জোর, তবে অনুচ্চারিত সেই ঋতুকথা’ (৩-২) প্রতিবেদনে স্বাতী মল্লিক অনেক সমীক্ষার কথা তুলে ধরেছেন। কিন্তু ঋতুর মতো বিষয় নিয়ে মেয়েরা নিজেরা কবে কথা বলতে শিখবে? ‘পিরিয়ড’ শব্দটিই আজও শুধু ‘শরীর খারাপ’ শব্দবন্ধে আটকে থাকে। আমরা যারা কন্যাসন্তানের মা, তারা কি এখনও সঠিক শব্দগুলো পৌঁছে দিচ্ছি পরবর্তী প্রজন্মকে? পুরুষতন্ত্রের ছায়ায় বড় হয়ে ওঠা মেয়েসমাজের ক’জনই বা ভাবতে পারছেন যে, এই নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন? অনেক উচ্চশিক্ষিত নারী কুসংস্কারে আবদ্ধ। পিরিয়ড চলাকালীন কোনও শুভকাজে তাঁরা নিজেরাই অংশগ্রহণ করেন না, উল্টে যাঁরা ব্যতিক্রম সৃষ্টি করেন, তাঁদের কটূক্তির কবলে পড়তে হয়।
পরবর্তী প্রজন্মকে সবার আগে শেখাতে হবে হাইজিন। মুখে হাইজিনের কথা বলব, অথচ পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করার সময় নিজেরাই তা লঙ্ঘন করব, এমন মানসিকতা সমাজকে পিছিয়ে দেয়। পাবলিক টয়লেট ব্যবহারের সময় ব্যবহার করা যায় মেয়েদের জন্য পোর্টেবল ইউরিনাল ফানেল, কিংবা ব্যবহার করা যেতে পারে টয়লেট স্যানিটাইজ়ার। ‘মেনস্ট্রুয়াল কাপ’ ব্যবহার করলে অনেকটাই সুবিধা। উত্তরোত্তর মূল্যবৃদ্ধি পাওয়া স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারের ধাক্কা অনেকটাই কমবে। কাপ বার বার ব্যবহার করা যায়, হাইজিনও রক্ষা করে। প্রতি বার পাবলিক টয়লেট ব্যবহারের পর জলের ব্যবহার করতে হবে। ঘেন্নায় মগে বা কলে হাত দেওয়া এড়ালে চলবে না।
ঋতুস্রাব বা পিরিয়ড ঘেন্নার বিষয় নয়। ঘরের ভিতর ‘পিরিয়ড’ শব্দটি উচ্চারিত হোক। বাজেট অবধি পৌঁছনোর আগে পরিবারের প্রতিটা মানুষের কাছে, স্কুল-কলেজে, পাড়ায়, কথাগুলো উচ্চারিত হওয়া খুব প্রয়োজন। ক’টা স্কুলে আজ পর্যন্ত ভেন্ডিং মেশিনের ব্যবস্থা আছে? আছে কি অফিসে মহিলাকর্মীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা? ভাবতে হবে সে কথাও। এ দেশে কন্ডোম বিলি হয়, ন্যাপকিন নয়। এখানেও তো লুকিয়ে সেই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। স্কুলে পড়ার সময় জীবনবিজ্ঞানে প্রজননের বিষয়টি খুব সচেতন ভাবে এড়িয়ে যাওয়া হত। ‘ঋতু’ বিষয়টি থাকত সিলেবাস বর্হিভূত। সময় এসেছে বোঝানোর যে, এটিও কোনও কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। মুখ খুলতে হবে মেয়েদের নিজেদেরই।
সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা-১২৫
বিতর্কে ছুটি
‘কোচিন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’ কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ছাত্রীদের ‘ঋতুপর্বে ছুটি’ দেওয়ার। সম্প্রতি ঘোষিত হয়েছে, এই স্টেট ইউনিভার্সিটির ছাত্রীরা সিমেস্টার পিছু বাধ্যতামূলক উপস্থিতি থেকে (৭৫ শতাংশ) দু’শতাংশ ছাড় পাবে ঋতুপর্বে বাড়িতে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। এই ঘোষণার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কেরলের উচ্চশিক্ষা মন্ত্রক ঘোষণা করেছে, ছাত্রীদের সুবিধার্থে ঋতুপর্বের ছুটি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে রাজ্যের সব ক’টি স্টেট ইউনিভার্সিটি।
ভারতের পরিবার, সমাজ এবং দেবস্থল— এরা প্রায় কখনও ঋতুস্রাবকে ‘অসুখ’ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারেনি। সর্বত্রই আজও ঋতুমতী মেয়ে ‘অশুচি’। বিজ্ঞান যাকে স্বাভাবিক বলে স্বীকার করেছে, দেশ তাকেই ‘অশৌচ’ সাব্যস্ত করতে মরিয়া। তারই মাঝখানে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঋতুপর্বে ছুটি’র ঘোষণা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। ১৯১২ সালে কেরলের একটি বালিকা বিদ্যালয় ছাড়া এ দেশের অন্য কোথাও ছাত্রীদের জন্য ইতিপূর্বে এমন ছুটি ঘোষিত হয়েছে বলে জানা নেই। তবে নারীকর্মীদের জন্য এমন ছুটি রয়েছে। ২০১৭ সালে এখানকার এক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা মাসে একটি করে ‘পিরিয়ড লিভ’ দেওয়া শুরু করেছিল নারীকর্মীদের। ২০২০ সালে ‘জ়োম্যাটো’ তার ৩৫ শতাংশ মহিলা কর্মচারীর জন্য বছরে ১০ দিন পর্যন্ত এই ছুটি দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানায়। বিহার সরকার ১৯৯২ সাল থেকে ৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত নারীকর্মীদের ঋতুপর্বে ছুটি দিয়ে আসছে।
ঋতুস্রাব চলাকালীন মেয়েরা বাকি সময়ের মতো স্বতঃস্ফূর্ত থাকতে পারেন না, এ কথা সত্য। নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক অস্বস্তি তাঁদের হয়। কিন্তু এই অস্বস্তি সকলের ক্ষেত্রে ছুটিতে থাকার মতো অসহনীয় হয় না। সারা বিশ্বে এই পর্বের ছুটির অধিকার নিয়ে আন্দোলন চলেছে, আলোচনাও চলেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রাশিয়া বিশ্বে প্রথম এই ছুটি দেওয়া শুরু করেও ১৯২৭ সালে বন্ধ করে লিঙ্গবৈষম্যজনিত কারণে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পৃথিবীতে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান ইত্যাদি দেশে এই ছুটির প্রচলন হয়েছে। গত ডিসেম্বরে সম্ভবত ইউরোপের প্রথম দেশ হিসাবে স্পেনে এই ছুটির বিষয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে আলোচনা উঠতে দেখেছি আমরা। ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশে কিছু কোম্পানি ‘পিরিয়ড লিভ’ দিয়েছে। ‘ঋতুপর্বে ছুটি’ নিয়ে ভারতের দাবি, বিতর্ক এবং বাস্তবতা পরস্পরের সঙ্গে একেবারে সমানে সমানে টক্কর দেয়। কাউকেই হেলায় সরানো চলে না।
২০১৭ সালে অরুণাচল প্রদেশ থেকে আসা সাংসদ নিনং এরিং লোকসভায় একটি প্রাইভেট বিল আনেন। ‘দ্য মেনস্ট্রুয়াল বেনিফিট বিল’-এ প্রস্তাব রাখা হয়, মহিলা কর্মচারী এবং অষ্টম শ্রেণি ও তার ঊর্ধ্বে পাঠরত ছাত্রীদের ‘পিরিয়ড লিভ’ দিতে হবে। সে দিন এই বিল নিয়ে আমাদের লোকসভা কোনও আলোচনা করেনি। বিলটি পুনর্বার পেশ করা হয় অরুণাচল প্রদেশের বিধানসভায়, ২০২২ সালের বাজেট অধিবেশনের আগে। এ বারেও আমাদের পুরুষতান্ত্রিক খাপ-পঞ্চায়েতি খুল্লতাতরা বিলের বিষয়কে ‘আনক্লিন টপিক’ বলে দূরে ঠেলে দেন।
ঋতুপর্বে ছুটির অধিকারের বিরুদ্ধে যুক্তি যাঁরা দিয়েছেন, তাঁদের বক্তব্যও ভেবে দেখা চাই। সাংবাদিক বরখা দত্ত বলেছিলেন, পিরিয়ড লিভ আর যুদ্ধক্ষেত্রে মেয়েদের কাজ বা মহাকাশযাত্রা, দু’টি কিন্তু এক সঙ্গে যায় না। অনেকের ধারণা, এই ছুটি শুধু পুরুষ-নারীর সমানাধিকারের ধারণাকেই আঘাত করে না, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহিত করে বেশি সংখ্যায় পুরুষকে চাকরি দিতে। কারণ, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান, বিশেষত কর্পোরেট সংস্থা এক শ্রেণির কর্মীর জন্য বছরে ন্যূনতম বারোটি অতিরিক্ত ছুটি বরাদ্দ করতে চাইবে না। যে ভারত ঋতুস্রাবকে এমনিতেই ‘অসুস্থতা’ মনে করে, ছুটি নিলে তো তার এই নেতিবাচক ধারণা আরও উৎসাহ পাবে। বহু ভারতীয় মনে করেন, ছুটি না দিয়ে যদি কর্মস্থলে মেয়েদের কাজ করার পরিবেশকে উন্নততর করা যায়, তাঁদের টয়লেট, বিশ্রামাগার ইত্যাদি সঠিক মানের থাকে, স্যানিটারি প্যাড সহজলভ্য এবং সস্তা হয়, ‘পিরিয়ড লিভ’ সার্বিক ভাবে না দিলেও চলে।
এ বার রূঢ় বাস্তবের কথায় আসা যাক। ভারতে সরকারি ক্ষেত্রে কাজ করেন সমগ্র শ্রমবাজারের মাত্র দুই দশমিক দুই শতাংশ মানুষ। বাকিদের স্থান বেসরকারি ক্ষেত্রে। সমগ্র দেশ জুড়ে এখন বেকারত্বের হাওয়া। এই পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় শিকার মহিলাকর্মীরাই। এ দেশে যে ক’জন মেয়ে উৎপাদনমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের প্রায় ৯৪ শতাংশ আছেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে। অনেকেই প্রাত্যহিক মজুরির ভিত্তিতে। ঋতুপর্বে ছুটি হলে তাঁরা খাবেন কী? বাড়িতে থাকলেও এই সামন্ততান্ত্রিক দেশের ক’জন নারী বিশ্রাম পান? তা ছাড়া সেনাবাহিনীর মতো পুরুষতান্ত্রিকতা চালিত প্রতিষ্ঠানগুলি তো মেয়েদের আর আণুবীক্ষণিক ভাবেও নেবে না! সরকারি ক্ষেত্রেও নারী কর্মচারী যে অতিরিক্ত ছুটি পান তার ভার বইতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলি নাজেহাল। বিশেষত ‘চাইল্ড কেয়ার লিভ’-এর প্রাপ্য এবং প্রবল চাহিদায় মেয়েদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির প্রাণান্তকর অবস্থা। তার উপর মেডিক্যাল সার্টিফিকেট বিহীন পিরিয়ড লিভ-এর পরীক্ষায় তারা পাশ করবে তো?
তবে, ঋতুপর্বে ছুটির চাহিদার যথেষ্ট সারবত্তা রয়েছে। অনেকের ক্ষেত্রে এই সময়ে যন্ত্রণা অসহ্য হয়, অন্য অসুবিধা দেখা দেয়। তাঁদের অবশ্যই বিশ্রাম দরকার। কিন্তু এ দেশের অসুস্থ সমাজ এই ‘বিশ্রাম’কে অক্ষমতা প্রতিপন্ন করতে মরিয়া। সেই সমাজের বদল আগে দরকার।
সোনালী দত্ত, হাওড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy