—ফাইল চিত্র।
জনপ্রিয় গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়কে তাঁর জন্ম সার্ধশতবর্ষে (জন্ম ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৮৭৩) হয়তো সে ভাবে মনে রাখতে পারিনি আমরা। রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক ছোট গল্পকারদের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী লেখক ছিলেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। দ্যুতিময়, সরস নানা গল্প লিখেছিলেন তিনি। লঘু হাস্যরস বা কৌতুকবোধই সেখানে আসল কথা। তবে তা নিছক আমোদের হাসি না হয়ে দরদ ও সহানুভূতি নিয়ে পাঠক মন জয় করেছিল। সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাষায়, “প্রভাতকুমারের কৌতুক সামাজিক স্বীকৃতির অক্ষয়বটের প্রাচীন ছায়ায় সহজ সরল প্রমোদ রসে উচ্ছলিত হয়েছে” (বাংলা গল্প বিচিত্রা)।
রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত প্রভাতকুমার শুরুতে কবিতা লিখলেও এক সময় ভারতী, দাসী, প্রদীপ, প্রবাসী, সাহিত্য, মানসী প্রভৃতি পত্রিকায় প্রবন্ধ ও গল্প লিখতে থাকেন। ১৩০৪ বঙ্গাব্দের কুন্তলীন ‘পূজার চিঠি’ গল্প প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পান। ধীরে ধীরে তিনি ভারতী পত্রিকার বিশিষ্টলেখক হয়ে ওঠেন ও এক সময়ে পত্রিকা সম্পাদনার কাজে সরলা দেবী চৌধুরাণীর পাশেও থাকেন।একে একে বই আকারে বার হয় ষোড়শী, দেশী ও বিলাতী, গল্পাঞ্জলি, নবীন সন্ন্যাসী। বর্ণনাভঙ্গি ও বিষয়বস্তুতে নিজস্বতা এনেদেশী ও বিলাতী বইয়ের গল্পগুলি লিখে তিনি পাঠককুলকে চমকে দেন। স্নিগ্ধতা, সরলতা ও সজীব প্রকাশভঙ্গিতে মন-কাড়ে তাঁর ছোট গল্পগুলি।
বিচিত্র অভিজ্ঞতার অধিকারী প্রভাতকুমারের গল্পের একটা বড় অংশ প্রেম ও দাম্পত্য জীবনকে নিয়ে। নারীর সনাতন পাতিব্রত্য ও একনিষ্ঠতার জয়গান সূচিত হয়েছে তাঁর ‘শ্রীবিলাসের দুর্বুদ্ধি’, ‘নিষিদ্ধ ফল’, ‘রসময়ীর রসিকতা’, ‘লেডী ডাক্তার’ প্রভৃতি গল্পে। বাৎসল্যের স্নিগ্ধ মাধুর্যে অদ্ভুত হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠেছে তাঁর ‘কাশীবাসিনী’, ‘ফুলের মূল্য’ গল্প। আবার রবীন্দ্রনাথের দেওয়া প্লট অবলম্বনে লেখা ‘দেবী’ গল্প ধর্মীয় গোঁড়ামিকে তীব্র ভাবে আঘাত করেছে। অলৌকিক বিশ্বাসে আরোপিত দেবীত্বে বিপন্ন দয়াময়ীর আত্মহত্যায় গল্পের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। এই গল্প সম্পর্কে জগদীশ ভট্টাচার্য বলেছিলেন, “‘দেবী’ গল্প রচনার পঞ্চাশ বৎসর অধিক কাল ধরে বাংলা ছোটগল্প অনেক পথ অতিক্রম করেছে। কিন্তু ছোটগল্পের সর্বাঙ্গীন বিচারে এর সাফল্য ও উৎকর্ষ এখনো অনতিক্রম্য বলে মনে হয়।” আবার কঠিন সমস্যাকে অদ্ভুত সহজ করে বর্ণনা করার ক্ষমতায় প্রভাতকুমার ছিলেন অসাধারণ। ‘বি.এ.পাস কয়েদী’, ‘জামাতা বাবাজী’ গল্প এ বিষয়ে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য। সেই সঙ্গে ‘বিবাহের বিজ্ঞাপন’, ‘বলবান জামাতা’ গল্পে তাঁর রসিকতাবোধ এক বিশেষ শিল্পসুষমায় উত্তীর্ণ হয়েছে। সুখপাঠ্য কথারসে ভরপুর, চমৎকার এই গল্পগুলির স্রষ্টাকে যথোচিত মর্যাদায় স্মরণ করা দরকার।
সুদেব মাল, খরসরাই, হুগলি
শ্রমের মর্যাদা
বছর ছয়েকের এক শিশুকে তার বাবা-মা এক ঝাড়ুদারকে দেখিয়ে বলছেন, “যদি ভাল করে পড়াশোনা না করো, তা হলে তোমার জন্যও ওই জীবন অপেক্ষা করছে।” আর একটি শিশুর বাবা-মা এক ঝাড়ুদারকে দেখিয়ে বলছেন, “যদি ভাল করে পড়াশোনা করো, তা হলে ওই মানুষটির জন্য তুমি কিছু করতে পারবে।”
অভিভাবকত্বের এই দুই মডেলের মধ্যে কোনটি আমাদের চার পাশে বেশি দেখা যায়, বলে দেওয়ার দরকার নেই। জেনে বা না-জেনে আমরাই শিশুদের অবচেতনে বৈষম্যের, ভ্রান্ত বিশ্বাসের বীজ পুঁতে দিই। মনের পরতে পরতে এমন সব ধারণা লালিত হতে থাকে, যা ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি নিরূপণ করে, অবশেষে ব্যক্তিত্বের মাত্রায় পরিণত হয়। যা থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। শ্রমজীবী মানুষ, দরিদ্র মানুষ যে সম্মানের যোগ্য নয়, সেই ধারণা অতি শৈশবেই তৈরি হয়ে যায়। তা থেকে কায়িক শ্রমকেও নিচু নজরে দেখতে শেখে শিশুরা।
আর একটা ছবি তো ঘরে ঘরে। গ্রামাঞ্চলে তো বটেই, এমনকি শহরেও অভিভাবকেরা প্রতিবেশীদের কাছে নিজের মেয়ের সামনেই আলোচনা করেন, মেয়েকে বেশি পড়িয়েই বা কী হবে? সেই তো অন্যের হেঁশেল ঠেলতে হবে। অথবা বিকেলের আড্ডায় তাচ্ছিল্য-ভরা আলোচনা, “মেয়েমানুষের বুদ্ধি তো! তাই এই অবস্থা!” এঁদের অনেকেই হয়তো নারী দিবসের দিন মঞ্চ-কাঁপানো বক্তৃতা করে থাকেন। মেয়েরা রাষ্ট্রচালনা থেকে মহাকাশ যাত্রা, সবেতেই নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন, তার সাক্ষ্য মিলছে চার দিকে। কিন্তু আড্ডার তরুণতম সদস্যটি বুঝে যান, মেয়েরা ‘আসলে’ অযোগ্য।
টমাস আলভা এডিসন, যাঁর নামের পাশে ১০৯৩টি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কৃতিত্ব, সেই বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী শৈশবে তাঁর স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হন এই যুক্তিতে যে, তিনি খুবই ‘মাথামোটা’। ওই স্কুলের ‘স্ট্যান্ডার্ড’-এর সঙ্গে বেমানান। স্কুলের চিঠিতে কী বলেছে, সন্তান জানতে চাইলে এডিসনের মা বলেছিলেন, “তোমার বুদ্ধিমত্তার বিকাশের উপযুক্ত পরিকাঠামো ওই স্কুলে নেই। তাই তোমাকে একটি অন্য স্কুলে ভর্তি হতে হবে।” মায়ের ওই আশ্বাসবাণীর ফল কী হয়েছিল, তা আজ সকলের কমবেশি জানা। অথচ, বহু অভিভাবক এখনও সন্তানের সামনেই আলোচনা করেন, “অমুকের বুদ্ধি মোটা, সায়েন্স গ্রুপে নম্বর পায় না।”
শিশুর মন হল অনন্ত সম্ভাবনার আধার। তার যত্ন প্রয়োজন, উপযুক্ত ব্যবহার প্রয়োজন। নেতিবাচক কোনও কথা বা ধারণা তার মধ্যে ততটাই প্রভাব বিস্তার করে, যতটা করে ইতিবাচক ভাবনা। আমার তো মনে হয়, সন্তান জন্মানোর আগে বাবা-মায়ের পেশাদার মনোবিদের কাছে ‘পেরেন্টিং’-এর উপযুক্ত পাঠ নেওয়া অপরিহার্য।
বস্তুত, যারা চটজলদি অঙ্কের জটিল ধাঁধার সমাধান করতে পারে, শুধুমাত্র তাদেরই ‘বুদ্ধিমান’ বলে ভাবার মধ্যযুগীয় ধারণা বদলের সময় এসেছে। এখন ‘মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি’ শিক্ষার যুগ। বুদ্ধিমত্তা, বা আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে সৃজনশীল বুদ্ধিমত্তা, কখনওই কোনও একটি পাঠ্য বিষয়ের ঘেরাটোপে আবদ্ধ নয়। চটজলদি অঙ্ক বা ঝরঝরে ইংরেজি বলতে পারাকে বুদ্ধির, শিক্ষার প্রধান শর্ত বলে বিশ্বাস করা, এবং শিশুর মধ্যে সে বিশ্বাস ঢোকানো, কেবল ভ্রান্ত নয়, ক্ষতিকর। নিত্যনতুন ভাবনাসমৃদ্ধ এক অপূর্ব সৃষ্টিশীল জগতের চাবিকাঠি শিশুর হাতে তুলে দেওয়াই শিক্ষক এবং অভিভাবকের কাজ। কে বুদ্ধিমান, কে নয়, সেই বিভাজন করতে করতে আমরা শিশুদের চিন্তাকেও সঙ্কুচিত করে তুলছি। আরও দেখা যায়, কিছু নির্দিষ্ট পেশার প্রতি মানুষের আগ্রহ অসীম, আর বাকিগুলোর প্রতি কেবলই তাচ্ছিল্য। সরকারি অফিসার বললে মানুষের সম্ভ্রম জাগে, কিন্তু স্ব-উদ্যোগে একটি সফল প্রতিষ্ঠান চালালেও সেই সম্মান জাগে না।
দুঃখের কথাটা হল, আমাদের দেশে ‘শ্রমের মর্যাদা’ দেওয়ার সংস্কৃতি এখনও গড়ে ওঠেনি। সমাজ বা রাষ্ট্রের তরফে উপযুক্ত ব্যবস্থা করা হয়নি। তাই, মুটে, মজুর বা হকারকে আমরা সম্মানের চোখে দেখি না। যত্র তত্র ‘তুমি’ সম্বোধন করে ফেলি। উন্নত দেশগুলোতে এক জন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিও ট্যাক্সিচালক বা ঝাড়ুদার হতে পারেন নির্দ্বিধায়। কারণ, সেখানে শ্রমের মর্যাদা আছে। তা হলে ভারতে এত বৈষম্য কেন? গোড়ায় গলদ। শৈশব থেকে আমরা শ্রমের মর্যাদা দিতে শিখিনি।
অনেকে বলতে পারেন যে, এখানে শ্রমের মর্যাদার বুলি কপচিয়ে লাভ নেই। কারণ, শ্রমজীবী মানুষদের পরিচিতি কেবল তাঁদের কাজ দিয়ে নয়, তাঁদের বর্ণ, সম্প্রদায়, শ্রেণি দিয়েও নির্ধারিত হয়। সবিনয়ে বলি, সামগ্রিক পরিকাঠামো হয়তো এক দিনে বদলানো যাবে না। কিন্তু, দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর প্রয়াস তো শুরু করা যেতেই পারে। আসুন না, শৈশবে বাড়ির চৌহদ্দি থেকেই আমরা চেষ্টা করি, শিশুদের পক্ষপাতহীন ও যুক্তিনিষ্ঠ করে গড়ে তুলতে। চাই যুক্তি ও বুদ্ধির বাস্তব প্রয়োগ। সে ক্ষেত্রে অভিভাবকদেরই অগ্রণী হতে হবে। নিজেদের ভিতরেও যুক্তি ও বুদ্ধির উন্মেষ ঘটাতে হবে। ভাবের ঘরে চুরি না-ই বা করলাম।
অনিমেষ পাল, গোয়ালতোড়, পশ্চিম মেদিনীপুর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy