প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
‘নিজের জোরে চলার শিক্ষা’ (২৭-৯) প্রবন্ধে অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় এক দিকে স্কুলশিক্ষা ধ্বংসে রাজ্য সরকারের কালাপাহাড়ি ভূমিকা, অন্য দিকে সচেতন নাগরিকের দায়িত্বের কথা তুলে ধরেছেন। বাস্তবিক স্কুলশিক্ষায় রাজ্য সরকারের ভূমিকার কথা ভাবলে অবাক হতে হয়। অধিকাংশ স্কুলে হয় প্রয়োজনীয় সংখ্যায় শিক্ষক নেই, না হলে ছাত্র নেই। স্কুল-বিল্ডিং ভেঙে পড়ছে। কোথাও ছাত্র-শিক্ষকদের বসার জন্য চেয়ার-বেঞ্চের অভাব। কেন এমন হতশ্রী দশা? শুধু কি টাকার অভাবের জন্যই? আর বাকি সব ব্যাপারে তো টাকার অভাব এমন করে ওজর হিসাবে আসে না। অবশ্য সরকারি স্কুলগুলির অধঃপতনের সূচনা পূর্বতন সিপিএম সরকারের আমলেই। যে দিন তারা ক্ষমতায় বসেই প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজি এবং পাশ-ফেল তুলে দিয়েছিল, সে দিনই এই পতনের সূচনা হয়েছিল। সরকারি স্কুলে ইংরেজি এবং পাশ-ফেল না থাকাকে সুযোগ হিসাবে নিয়ে একের পর এক ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠতে থাকল বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। সরকারি স্কুল হয়ে উঠল শুধুমাত্র নিম্নবিত্ত এবং দরিদ্র পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের জায়গা।
সে দিনও সরকারের এমন একটি ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে এগিয়ে এসেছিলেন নাগরিক এবং বুদ্ধিজীবীরা। বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলির পাশে দাঁড়াতে বিজ্ঞানী সুশীল কুমার মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এক দল নাগরিক এগিয়ে এসে বেসরকারি ভাবে চতুর্থ শ্রেণির শেষে একটি পরীক্ষা নিতে শুরু করেন, যেখানে ইংরেজি এবং পাশ-ফেল দু’টিকেই বহাল রাখা হয়, এবং সুউত্তীর্ণদের জন্য বৃত্তির বন্দোবস্ত করা হয়। নাগরিক উদ্যোগকে ভরসা করেই সেই বৃত্তি পরীক্ষা এখনও চলছে, এবং প্রতি বছর কয়েক লক্ষ ছাত্রছাত্রী সেই পরীক্ষায় বসছে।
শিক্ষিত মধ্যবিত্ত অভিভাবকদের সন্তানরা ইংরেজি মাধ্যমে চলে যাওয়ায় সরকার আর আগের মতো স্কুলগুলিকে গুরুত্ব দিল না। শুরু হল অবহেলা। শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী পদগুলি খালি পড়ে থাকতে লাগল। সিলেবাস সংস্কারের কাজেও কারও দৃষ্টি থাকল না। ইতিমধ্যে এসে পড়ল বেসরকারিকরণের ঢেউ। আজ স্কুলশিক্ষাতেও বড় পুঁজি ঢুকে পড়ছে।
যে স্কুলগুলি থেকে পাশ করে ছাত্ররা এক দিন চিকিৎসক প্রযুক্তিবিদ আইনজীবী সাহিত্যিক-সহ সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিকে অলঙ্কৃত করেছেন, সেই স্কুলগুলির বর্তমান দশা দেখলে চোখে জল আসে। মনে হয় এত বড় ধ্বংসযজ্ঞ আমরা কি শুধু চুপচাপ দেখে যাব, কোনও ভূমিকা কেউ পালন করব না? প্রবন্ধকার সঠিক ভাবেই বলেছেন, এখনও ৮০ শতাংশের বেশি ছাত্রছাত্রী সরকারি স্কুলে পড়ে। এখনও সরকার চাইলে স্কুলগুলিকে বাঁচাতে পারে। এক দিন নাগরিক উদ্যোগেই বাংলার বেশির ভাগ স্কুল গড়ে উঠেছিল। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের নীতির ফলে আজ আবার আমরা যেন অতীতের দিকে এগিয়ে চলেছি। এই অবস্থায় উদ্বিগ্ন নাগরিকদের যে যার সাধ্যমতো এগিয়ে এসে স্কুলগুলিকে রক্ষার জন্য হাত লাগাতে হবে। লেখক বাগনানের যে নজিরটি তুলে ধরেছেন, তা এক উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। এমন উদ্যোগ আজ রাজ্যের সর্বত্র প্রয়োজন।
সমরেন্দ্র প্রতিহার, কলকাতা-৪
আলোর শিখা
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধটি পড়ার সময় মনের পর্দায় ভেসে আসে সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে ছবির উদয়ন পণ্ডিতের কথা। লেখক যথার্থই ইঙ্গিত করেছেন, এ রাজ্যের শাসকদের বিশ্বের সমস্ত দরকারি এবং অদরকারি ব্যাপারে উৎসাহের শেষ নেই— কিন্তু স্কুলশিক্ষা, বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা এক করুণ অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলেছে। দুর্নীতির জালে জড়িয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ প্রক্রিয়া বিগত কয়েক বছর ধরেই আটকে, পঞ্চায়েত স্কুলগুলিতে বই-ব্যাগ বিলি হচ্ছে, মিড-ডে মিল আছে, কিন্তু দশ-বারো বছরে এক জনও শিক্ষকের নিয়োগ হয়নি। কিছু না শিখেই পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল পদ্ধতির বিলোপ, নবম শ্রেণিতে সাইকেল প্রাপ্তি, তার পর পড়া থেকে অব্যাহতি। অনেকেই কন্যাশ্রী ইত্যাদি সুবিধার জন্য স্কুলে শুধু নামটুকু নথিভুক্ত করে রাখে। দরিদ্র শিশুর পঠনপাঠনের ক্ষেত্রে সম্ভবত নিয়োগ-দুর্নীতির চাইতেও ক্ষতি করেছে শিক্ষাব্যবস্থার দিশাহীনতা। ২০১৩ সালে বর্তমান রাজ্য সরকারের মন্ত্রিসভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অনেক গড়িমসি করে ২০২০ সালে শিক্ষা দফতর হাতে নিল পঞ্চায়েত স্কুলের ফাইল, কিন্তু ফিরিয়ে দিল ২০২২ সালের শেষ দিকে। অর্থাৎ, পঞ্চায়েত স্কুলগুলির হাল পূর্ববৎ। কিছু কিছু স্কুলে হয়তো এক জন শিক্ষক কিংবা কয়েক জন সহায়িকা। লেখকের উল্লিখিত বাগনান এলাকার এক দল যুবক যেমন একটি শিক্ষাকেন্দ্রের দায়িত্ব নিয়েছেন, ঠিক সে রকম ভাবেই দমদম প্ল্যাটফর্মে থাকা মেয়েগুলিকে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করালেন একক কৃতিত্বে কান্তা দিদিমণি। তাঁকে অবশ্য সাহায্য করেছেন হকার বন্ধু এবং রেলকর্তারা। দিদিমণি পার্শ্ববর্তী কয়েকটি সরকারি স্কুলে এই মেয়েগুলিকে ভর্তির ব্যবস্থা করলেন। এঁরাই এই দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজের আলোকবর্তিকা।
সুপ্রিয় দেবরায়, বরোদা, গুজরাত
ছুটির জোয়ার
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় এ রাজ্যের শিক্ষার বাস্তব দিকটা তুলে ধরেছেন। রাজ্যের শিক্ষার চিত্রটা ঠিক এতটা খারাপ ছিল না দশ-বারো বছর আগেও। যে রাজ্যে ৮০ ভাগ মানুষ চেয়ে থাকে সরকারি বা সরকার-পোষিত স্কুলের দিকে, সেখানে নাকি নতুন স্কুল স্থাপনার বদলে উঠে যাবে আট হাজার বিদ্যালয়। এ রকম সিদ্ধান্ত কী করে নেওয়া যায়? বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে প্রায় উঠে গিয়েছে পঠনপাঠন। স্কুলের খাতায় নাম আছে, কিন্তু অনেকেই আসে না, এলেও মিড-ডে মিলের জন্য আসে। লেখক সঙ্গত কারণেই বলেছেন যে, লেখাপড়ার পরিবেশ না থাকায় সপ্তম শ্রেণির ছাত্র হারিয়েছে ক্লাস ওয়ানের যোগ্যতা। এ বারের মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রায় চার লক্ষের বেশি পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত। সরকারের কোনও হেলদোল দেখা গেল কি এ ব্যাপারে? অতিমারিতে স্কুল বন্ধ ছিল প্রায় দু’বছর ধরে, ছেলেমেয়েদের যে বর্ণনাতীত ক্ষতি হয়ে গেল, অতিরিক্ত সময় স্কুল চালিয়ে তার কিছুটা তো পূর্ণ করা যেত। সে পথে না হেঁটে, সরকার গ্রীষ্মের ছুটি বাড়িয়ে দিল। পঞ্চায়েত নির্বাচন উপলক্ষে আবার বন্ধ হয়ে গেল বিদ্যালয়গুলি দীর্ঘ সময়ের জন্য। ছুটির জোয়ারে স্বাভাবিক পঠনপাঠনের নির্ঘণ্টটি ভেসে গেল কোথায়, কে তার হিসাব রাখবে?
দিলীপ কুমার সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
ব্যতিক্রমী
শিক্ষক দিবসে হাওড়া জেলার বাগনান এলাকার ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠানটির খবর চমক সৃষ্টি করে। জীবন-সংগ্রামের লড়াইকে সঙ্গী করে কয়েক জন কলেজ-পড়ুয়া তাঁদের নিঃসহায়, দীন-দরিদ্র ভাইবোনদের পড়ানোর কাজটা নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। ছোট ছেলেমেয়েগুলো নিঃসঙ্কোচে তাদের দুঃখের কথা ভাগ করে নেয় মাস্টারমশাইদের সঙ্গে, যাঁরা না থাকলে গৃহশিক্ষকহীন শিশুদের পড়াই হয়তো থেমে যেত। এই শিক্ষাকেন্দ্রটি ‘নিজের জোরেই চলবে’ শিক্ষাকেন্দ্রের প্রধান উদ্যোগীর কথায় আশা জাগে। বিশেষত, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান ক্ষয়াটে চাঁদের মতো নিষ্প্রভ শিক্ষাঙ্গনগুলোর বেহাল শিক্ষাব্যবস্থা, নিয়োগ দুর্নীতির আবহে এই শিক্ষাকেন্দ্রটি নিঃসন্দেহে আশা-জাগানিয়া। স্কুলের খাতায় নাম থাকা, অনিয়মিত স্কুলে যাতায়াত, এবং কিছুই না শিখে উপরের ক্লাসে উঠে যাওয়ার ব্যবস্থায় চমক আছে। সর্বশিক্ষা মিশন কতটা ফলপ্রসূ হল সে প্রশ্ন কিন্তু আড়ালেই থেকে যায়। সপ্তম-অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়াদের বানান-দুর্দশা স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। এই অশুভক্ষণে বাগনানের শিক্ষাকেন্দ্রটির দৃষ্টান্ত আশ্বস্ত করে।
ধ্রুবজ্যোতি বাগচী, কলকাতা-১২৫
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy