পার্থ চট্টোপাধ্যায়।
পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা-দুর্নীতি আজ কতখানি বিস্তৃত, তা ভাবলে রাজ্যবাসী হিসেবে মাথা হেঁট হয়ে যায়। তবে দুর্নীতি তো কেবল শিক্ষার ক্ষেত্রে নয়, নির্মাণ সামগ্রীর সিন্ডিকেট, পাথর খাদান, কয়লা খাদান, ত্রাণ বণ্টন-সহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এই রাজ্যে দুর্নীতি যেন পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছে। অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার ১৩ লক্ষ ওএমআর শিট (উত্তরপত্র) নির্দিষ্ট সময়ের আগেই নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। সমষ্টির স্বার্থ ব্যক্তির স্বার্থের কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়ছে। শাসক দলের নেতারা এ নিয়ে কতখানি লজ্জিত বা উদ্বিগ্ন জানি না, তবে তাঁদের প্রশ্ন করলেই যে উত্তরগুলো ভেসে আসে তা হল— ১) আইন আইনের পথে চলবে, ২) এ সব ব্যাপার বিচারাধীন। অপরাধ করলে অবশ্যই তার শাস্তি হবে, কিংবা ৩) অন্যান্য রাজ্যেও দুর্নীতি হয়েছে, বা অন্য সরকারও তো অনেক দুর্নীতি করেছে, ইত্যাদি।
আইন অবশ্যই আইনের পথে চলবে, কিন্তু তাই বলে কি নিজেরা যেমন খুশি চলব? নিয়োগের প্রশ্ন এলে তার সব কৃতিত্বটুকু দলের পক্ষে, দলের কর্ণধারের পক্ষে নিয়ে যাওয়ার যাবতীয় প্রচেষ্টা, আর সেই নিয়োগে দুর্নীতি হলে দল দূরে সরে গিয়ে বলবে, আইন আইনের পথে চলবে— এ কেমন কথা? ‘হুইসলব্লোয়ার’রা ধরিয়ে দেওয়ার পরও দল ধরতে পারছে না অপরাধীদের। দলের চেতনার মান কি তলানিতে? অন্য রাজ্য বা সরকার দুর্নীতি করলে কি এ রাজ্যের শাসক দলের দুর্নীতিটা আর দুর্নীতি থাকে না?
শাস্তির ভয় দেখিয়ে দুর্নীতিকে কিছুটা দমন করা যায়— এ কথা ঠিক। তবে এটা কোনও স্থায়ী ব্যবস্থা হতে পারে না। দুর্নীতি দমনে স্থায়ী ভূমিকা গ্রহণ করে নীতিজ্ঞান। আর এই নীতিজ্ঞান গড়ে ওঠার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হল সমাজ। এ জ্ঞানের অধিকারী হবে ব্যক্তি, হবে দল। কিন্তু এ দেশে এই মুহূর্তে নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল রাজনৈতিক দলের হদিস পাওয়া এক রকম অসম্ভব। এখন রাজনীতি ও প্রশাসন ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে, পরতে পরতে দুর্নীতি। ‘খড়কুটো’ (২৬-৯) শীর্ষক সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, “এ দেশের জলহাওয়াতে এমন কিছু আছে যাতে তেমন (দুর্নীতিমুক্ত) সমাজের কথা আর কল্পনাও করা যায় না।” বস্তুত, এ দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং তার উপরি-কাঠামো হিসেবে যে রাজনৈতিক-সামাজিক অবস্থা গড়ে উঠেছে, তা নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয়কে দিনের পর দিন ত্বরান্বিত করছে। এই সঙ্কটঘন পরিস্থিতি থেকে নিজেদের মুক্ত করতে চাই সমাজের আমূল পরিবর্তন। এই পরিবর্তন ভোটের মধ্য দিয়ে সরকার পরিবর্তন নয়।
গৌরীশঙ্কর দাস, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
বকেয়া ঋণ
‘কাজের অভাবে বাড়ছে শিক্ষা ঋণের বকেয়া, উদ্বেগে ব্যাঙ্ক’ (২৭-৯) শীর্ষক সংবাদ দেখাচ্ছে, কার্যত এক দুষ্টচক্রে পড়ে গিয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতি ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষা ঋণনীতি। কারণ, শিক্ষা শেষে সফল প্রয়োগের ক্ষেত্রে বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে বেকারত্বের চরিত্রেও আমূল পরিবর্তন হয়েছে। শিক্ষাঋণ পরিশোধের ক্ষমতা অর্জন করার উপযুক্ত উপায় সরকারি, আধা-সরকারি, বা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার পাকা চাকরি পেলে। যদিও শিক্ষাঋণ নেওয়ার সময় চাকরির বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না, কিন্তু দু’দশক আগেও আমরা দেখেছি, মন দিয়ে পড়াশোনা করে ভাল ভাবে উতরে গেলে যেমন হোক একটা চাকরি পাওয়া যেত। শিক্ষাঋণ দেওয়ার সময় ঋণপ্রার্থীর পরীক্ষার ফল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান এবং চাকরির বাজার বুঝে ব্যাঙ্কগুলি ঋণ দিত। আবার সরকারি চাপে তাদেরও টার্গেট পূরণ করতে হত। অন্য দিকে দেখা যায়, শিক্ষাঋণে অভিভাবক আয়কর ছাড়ের মতো সুবিধা পান বলে অনেক তুলনায় সচ্ছল পরিবারও ঋণ নিয়ে থাকে। এবং ঋণ পরিশোধ নিশ্চিত বুঝে ব্যাঙ্কগুলিও এই সব ক্ষেত্রে একটু উদার হয়। সব মিলিয়ে ঋণদাতা ব্যাঙ্ক ও তার কর্মীদের ভরসার একটা জায়গা ছিল।
এখন ঋণপ্রার্থীর যোগ্যতার পরিমাপ করা কঠিন। পরীক্ষার ফল, যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করেছে ও যে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা নিতে যাচ্ছে— উভয়ের মান, সার্বিক ভাবে ফল প্রকাশের শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, কোনওটাই আর এখন ছাত্রছাত্রীর যোগ্যতা বিষয়ে স্পষ্ট ও স্বচ্ছ ধারণা দিতে পারছে না। উচ্চশিক্ষা সম্পূর্ণ হওয়ার পরে বিশেষ প্রশিক্ষণ ও কাজের অভিজ্ঞতার দরকার হয়। চাকরির জায়গায় অসরকারি ক্ষেত্রে বেতন বা শর্ত, কোনওটাই নির্দিষ্ট নয়। কাজ এ বেলা আছে, ও বেলায় নেই। চাকরির সংস্থান প্রচুর, কিন্তু যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ নেই। কাজ পেলেও পিএফ, গ্র্যাচুইটি, অবসরের পর পেনশন প্রাপ্তি যেন রূপকথামাত্র। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে কাজ করার সুবাদে দেখেছি, ব্যাঙ্ক ঋণ দেওয়ার সময় কাজের শর্তে এই অনিশ্চয়তা মোটেই পছন্দ করে না।
এমন অনিশ্চয়তাকে অগ্রাহ্য করা ব্যাঙ্কের জন্য উচিতও নয়, কারণ সাধারণ মানুষের জমারাশি থেকেই ব্যাঙ্ক ঋণ দেয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের লক্ষ্য, মেধাবী ও দুঃস্থ উচ্চশিক্ষার্থীকে সাহায্য করা। এই লক্ষ্য সামনে রেখে ভারত সরকার ডিপার্টমেন্ট অব ইকনমিক অ্যাফেয়ার্স (ব্যাঙ্কিং ডিভিশন), রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক, ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্কস অ্যাসোসিয়েশন-এর স্টাডি গ্রুপ ইত্যাদি সবাই মিলে আদর্শ শিক্ষাঋণ নীতি মেনে আসছে সেই ২০০০ সাল থেকে। এই নীতির চূড়ান্ত লক্ষ্য হল, দেশের জন্য মানবসম্পদ গড়ে তোলা। বেসরকারি ব্যাঙ্কের এই দায় নেই। কিন্তু যাদের দায়িত্ব আছে, তাদের তো মানতে হয়। রূঢ় বাস্তব হল, অনাদায়ি শিক্ষাঋণের পিছনে ব্যাঙ্ককে ছুটতে হয়। হয়তো চাকরি পেয়ে শিক্ষার্থী বা অভিভাবক জানানোর দরকার বোধ করেননি, বা চাকরি পেয়ে শিক্ষার্থী রাজ্যের বাইরে, এমনকি বিদেশেও চলে গিয়েছে। সেই বকেয়া ঋণ উদ্ধার করতে গিয়ে ব্যাঙ্কের বিস্তর হ্যাপা, শ্রমের অপচয় ঘটে। সাধারণ আমানতকারীর জমারাশির বিনিময়ে গড়ে ওঠা এই উচ্চশিক্ষার্থীরা দেশের মানবসম্পদ কি না, সেই সন্দেহ থেকেই যায়। এ ক্ষেত্রে কাজের অভাবের থেকেও বড় বিপদ হয়ে ওঠে রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছার প্রতি সেই শিক্ষার্থীর আনুগত্য এবং অভিভাবকদের দেশপ্রেমের অভাব। এ সবের মোট ফল, দুঃস্থ ছাত্রদের শিক্ষাঋণ দানের রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা থেকে ব্যাঙ্ক সরে যায়। আবার কখনও পরিশোধ করার ক্ষমতার উপরজোর দেওয়ার কর্তব্য থেকেও সে বিচ্যুত হয়।
এক দিকে কাজের অভাব, অন্য দিকে দেশের প্রতি ভালবাসার অভাব ও অনাদায়ি ঋণের দুষ্টচক্র— এই দুইয়ে মিলিয়ে পরিস্থিতি অসহনীয় করে তুলছে। এ রাজ্যের অবস্থা একেবারে তলানিতে। শিক্ষা ও শিক্ষান্তে সরকারি চাকরি একে দুর্লভ হয়ে উঠেছে, তার উপর আবার তা দুর্নীতির পাঁকে ভরা। মধ্যপ্রদেশে ব্যপম কেলেঙ্কারি পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষায় দুর্নীতি-সাগরের তুলনায় শিশির বিন্দু। সম্প্রতি নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম থেকে আইটিআই পড়ুয়াদের চাকরি দেওয়ার নাম করে যে বিতর্ক হল, যে ভাবে রাজ্য সরকার পক্ষ থেকে ভুল স্বীকার হল, তা এক কথায় নজিরবিহীন (‘নিয়োগপত্র-বিতর্কে এফআইআর দায়ের’, ২৭-৯)। লক্ষণীয় এই ভুলে জড়িয়ে গেল সরকারি ও বেসরকারি, উভয় সংস্থাই।
অথচ, সরকারি ক্ষেত্রে অজস্র শূন্যপদ পড়ে আছে। যে ক’জন মাত্র পাকা চাকরি পান, অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, তাঁদের অধিকাংশই কোনও ক্ষমতাসীনের প্রভাবধন্য। খুঁজলে আরও দেখা যাবে, তাঁদের সন্তানরাই শিক্ষাঋণ পেয়েছে। স্বভাবতই শিক্ষার্থী বা অভিভাবক, সমর্থ হলেও কারও সময়মতো শোধ দেওয়ার সদিচ্ছা জন্মায় না। বাকিদের এক অংশ চার লক্ষ ঋণ মাপকাঠির মধ্যে। তাঁদের অনেকে আগেই ধরে নিয়েছেন, ঋণ পরিশোধ না করতে পারলে কেন্দ্রীয় সরকার তা ‘রাইট অফ’ করে দেবে, যেমন বড় উদ্যোগপতিদের খেলাপি ঋণ। সকলেই ভুলে যান, ব্যালান্স শিটে লাভের অঙ্ক থেকে বকেয়া ঋণের অঙ্ক মুছে দিয়ে কার্যত আরও দুর্বল করে দেওয়া হল যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোকে, তারা ভবিষ্যতে শিক্ষাঋণ দেবে কোন ভরসায়?
শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy