—ফাইল চিত্র।
তূর্য বাইনের ‘ক্ষুধা অতশত বোঝে না, তাই’ (১৬-১১) প্রবন্ধটি পড়ে বেদনার্ত, মর্মাহত হলাম। আমরা ক্ষুধার যন্ত্রণা দেখেছি, শৈশবে সেই যন্ত্রণার শরিকও। আজ চার পাশের পরিবেশ পরিস্থিতি সর্বদা সবটা দেখা ও জানা সত্ত্বেও প্রবন্ধটি যেন নতুন করে মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা শাসকদের মুখকে চিনিয়ে দিল। এই সূত্রে মনে পড়ছে কবি বিমলচন্দ্র ঘোষের ‘ক্ষুধা’ কবিতাটি। “ক্ষুধাকে তোমরা বেআইনি করেছ/ ক্ষুধিতদের আখ্যা দিয়েছ বিপজ্জনক/... হে পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত মহানায়কেরা/ আহা তোমাদের কী জ্বালা।/ আহা তোমাদের কী কষ্ট।” আজ পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত মহানায়কেরা একে একে দুর্নীতির পাঁকে পড়ে শ্রীঘরে বন্দি। প্রবন্ধকার প্রাইমারি স্কুলে মিড-ডে মিলের প্রসঙ্গে বিষয়টির অবতারণা করেছেন। স্মরণীয়, ১৯৯৫ সালে ভারতে মিড-ডে মিলের প্রচলন করার উদ্দেশ্য ছিল, দুপুরে শিশুদের খাবারের ব্যবস্থা ও সর্বাধিক সংখ্যক শিশুকে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আনা। ২০০৩ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গে সমস্ত প্রাথমিক সরকারি বিদ্যালয়ে এই ব্যবস্থা চালু হয়। পরবর্তী সময়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা করা হয়। তবে সরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক ভাল স্কুলগুলো এই সরকারি বিধি প্রথম দিকে মানতে চায়নি। পরবর্তী কালে এর গুরুত্ব সকলে বুঝেছেন।
ক্ষুধা কোনও বিধি মানে না। ক্ষুধিতদের জাত হয় না। তাই ছোট্ট ছেলেটি বৃষ্টিতে ভিজে স্কুলে এসে কাঁপতে থাকলেও বাড়ি ফিরতে নারাজ। তার বাড়ি ফেরায় আনন্দ নেই, মিড-ডে মিলের আশায় স্কুলে আসা। তার বাবা ভিন রাজ্যে আর মা অন্যের বাড়ি কাজ করেন। তাই বাড়ি গেলে খাওয়া জুটবে না। শিক্ষিকার বয়ান অনুযায়ী, ছোট শিশুকে মিড-ডে মিলের ভাত খাইয়ে দেওয়ার সময় ক্ষুধার তাড়নায় সন্তানের থালা থেকে মা ভাত খেয়ে নিচ্ছেন, এমন দৃশ্যও চোখে পড়ে। সেই সময় চোখ সরিয়ে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। এই সমস্ত মা ও সন্তানের মন খারাপ হয়ে ওঠে স্কুলে ছুটি পড়লে! স্কুলে ছুটি পড়লে তারা খাবে কী? শিশুদের মতোই গর্ভবতী ও সদ্যপ্রসূতিরাও এ দেশে খাদ্যের অভাবে অপুষ্টিতে ভোগেন। এ দেশের অসংখ্য শিশুর (সরকারি বিদ্যালয়ে) মাথাপিছু যেটুকু বরাদ্দ, তা-ও পচা, পোকা ধরা চাল বা নিম্নমানের ডাল ও সয়াবিন। এর কারণ অনুসন্ধানে দেখা যায়, খাদ্যশস্য বণ্টনে দুর্নীতি। আজ ভারত বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসাবে পঞ্চম স্থান অধিকার করেও ১২৫টি দেশের মধ্যে ক্ষুধা সূচকে ১১১-তে অবস্থান করছে।
সম্প্রতি মাননীয় মোদীজি ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা’-র মাধ্যমে আগামী পাঁচ বছর দেশের ৮০ কোটি মানুষকে বিনামূল্যে রেশন দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন। এই ‘আমিত্ব’-এর আড়ালে সূক্ষ্ম রাজনীতি আছে— তা হল ভোটব্যাঙ্ক। আসলে সামনেই লোকসভার নির্বাচন। তাই এমন দাতা কর্ণের ভূমিকায় তিনি অবতীর্ণ। তবে আমাদের রাজ্যই বা কম কিসে! এই সরকারেরও দান-খয়রাতির অন্ত নেই। ভোট কেনার অভিনব কৌশলে সকলেই একই পথের পথিক। আর সাধারণ মানুষ প্রাপ্য বুঝে না পেলেও প্রতিবাদ করতে সাহস পান না, কারণ তাতে ঝুঁকি বেশি। প্রাণটিও চলে যেতে পারে।
সূর্যকান্ত মণ্ডল, কলকাতা-৮৪
দুর্নীতিরাজ
তূর্য বাইন তাঁর ‘ক্ষুধা অতশত বোঝে না, তাই’ শীর্ষক প্রবন্ধে ক্ষুধার্ত অসহায় মানুষের একেবারে বাস্তব কথা বলেছেন। শিল্প না থাকায় এ রাজ্যের অধিকাংশ মানুষ পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে অন্য রাজ্যে কাজ করছেন। শিশুদের দুপুরের খাবারের জন্য ভরসা স্কুলের মিড-ডে মিল। সেখানে এত কারচুপি থাকে যে, তারা অল্প পরিমাণে অতি নিম্নমানের পোকাধরা চালের ভাত, তিতকুটে ডাল খেতে বাধ্য হয়। তাদের জন্য নির্ধারিত মানের ও পরিমাণের খাবার তারা পায় না। এ ছাড়া খোলা জায়গায় অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে রান্না হওয়ার জন্য আরশোলা, টিকটিকি, এমনকি ছোট সাপও খাবারের সঙ্গে সেদ্ধ হতে দেখা গেছে। অথচ, কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক দল এলে দু’দিনের মধ্যেই ঝকঝকে পরিষ্কার বাসনপত্রে ভাল গুণমানের খাবার পরিবেশন করে দেখানো হয়। তার মানে সদিচ্ছা ও শিশুদের জন্য একটু মায়া-মমতা থাকলে তাদের ভাল খাবার দেওয়া সম্ভব। আইসিডিএস প্রকল্পের আওতায় চলা অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিতেও অন্তঃসত্ত্বা, সদ্যপ্রসূতি মায়ের খাবারের একই হাল, তাঁরা রীতিমতো অপুষ্টিতে ভোগেন। এঁদের বাইরে যে বিরাট সংখ্যক গরিব মানুষ রেশনের খাদ্যশস্য নেন, তাঁদেরও বঞ্চিত করে অতি নিম্নমানের ও কম পরিমাণের চাল আটা দেওয়া হয়। এক সংগঠিত দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে গোটা রাজ্য, নইলে খোদ প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রীকে জেলে যেতে হয়! করোনার সময়কালে লকডাউনে লোকাল ট্রেন না চলাতে আমার কাজের দিদি আসতে পারেননি। পরে এসে বলেছিলেন, “মা গো, ধুলোভর্তি খুদকুঁড়ো খেয়ে পরাণ ক’ডা বাঁচায়ে রেখেছিলাম, কিছু বললে মারতে আসে, বলে বিনা পয়সায় পাচ্ছ, আবার কথা!”
সুষম বণ্টনের মাধ্যমে দেশবাসীর উন্নত মানের খাদ্য সরবরাহ সুনিশ্চিত না করে রাজনৈতিক নেতারা শুধু বিনা পয়সায় রেশনের প্রতিশ্রুতি দেন। দেশের মানুষের করের টাকায় রেশন দিয়ে নিজেদের নামে ভোটের জন্য ঢাক পেটান। সত্যিই গরিব মানুষের খিদে অতশত বোঝে না, সেই জন্যই অসাধু ব্যবসায়ী, মধ্যস্বত্বভোগী, মন্ত্রী-আমলাদের সম্পদ এত ফুলেফেঁপে উঠেছে।
শিখা সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
ভয় অমূলক
“রেখেছ ‘বাঙালি’ করে” (১৮-১১) প্রবন্ধে কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহকপাট’-এর সুরবিকৃতি প্রসঙ্গে বিশ্বজিৎ রায় অকারণে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং একমাত্রিক কেন্দ্রীয় শক্তির কথা টেনে এনেছেন। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রের কথা সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা আছে। আর বহু বৈচিত্রের মধ্যে একতা আনতে তার প্রয়োজনও আছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা এক ঐতিহাসিক সত্য। তাকে এ ভাবে লঘু না করাই শ্রেয়। প্রবন্ধকার মাস্টারদার লড়াইয়ের কথা বলেছেন। কিন্তু মনমোহন সরকারের কার্যকালে এনসিআরটি-র যে ইতিহাস লেখা হয় (২০০৬-২০০৭ সংস্করণ), বাংলা এবং মহারাষ্ট্রের বিপ্লবীদের অবদান তো দূরের কথা, নাম পর্যন্ত মুছে দেওয়া হয়। বাঘা যতীন, বিনয় বাদল দীনেশ, সূর্য সেনের বীরত্ব, দেশপ্রেম এবং আত্মবলিদানের অনুপ্রেরণাময় ইতিহাস জানবে না ছাত্রছাত্রীরা? মুছে দেওয়া হয়েছে আন্দামানের জেলে বিপ্লবীদের উপর বর্বর নারকীয় অত্যাচারের কথা। সুভাষ এক প্রান্তিক চরিত্র। একমাত্রিক, মূলত অহিংস আন্দোলনের ইতিহাসই এখনও পড়ানো হচ্ছে এই পাঠক্রমে। যাঁরা থেকে থেকে গৈরিকীকরণের ধুয়ো তোলেন, তাঁরা এই ইতিহাস বিকৃতির প্রতিবাদে একটি শব্দও উচ্চারণ করেন না। রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ এবং অবিভক্ত বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামীরা বাংলাকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলেই মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন। আর তাঁরা কেউই রামকে-হনুমানকে বহিরাগত মনে করতেন না। রামমোহন, রামপ্রসাদ, রামতনু, রামেন্দ্রসুন্দর, রামসেবক, রামরাজাতলায় বাঙালি সমাজ সম্পৃক্ত, লৌকিক জীবন সমৃদ্ধ। এসেছে প্রবাদবাক্য “সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই”, “একা রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব দোসর”। শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন এক রামভক্তেরই সন্তান। নজরুলের গানের সুর বিকৃতির থেকে ‘দিল্লির একবগ্গা একক লৌহদৃঢ় নেতৃত্ব’কে প্রবন্ধকারের ভয় বেশি। এই ভয় এবং তার প্রচার অমূলক এবং ভ্রান্তিকর। আমরা বাঙালিরা এখন স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করার নামে এক কূপমণ্ডূকতায় ঘুরপাক খাচ্ছি। আমরা বাঙালিরা নজরুলের গানের সুরবিকৃতির নিঃশর্ত প্রতিবাদ করছি, কিন্তু সমৃদ্ধ শক্তিশালী ভারত থেকে নিজেদের আলাদা করে নয়, একাত্ম হয়ে।
অলোক রায়, বেহালা, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy