অসুর।
অসুরের মুখের স্থানে গান্ধীর আদল প্রকাশ্যে আসতেই বাংলার সবর্ণ সমাজের প্রতিনিধিরা প্রবল প্রতিবাদে নেমেছেন (‘অসুরের মুখে কি গান্ধীর আদল, তুলকালাম শহরে’, ৩-১০ এবং ‘মণ্ডপে গান্ধী-বিতর্ক, কাউকে ধরেনি পুলিশ’, ৪-১০)। তাঁদের কিন্তু এক বারও কষ্ট হয়নি আদিবাসী মানুষের আদলে নির্মিত অসুরকে কুপিয়ে-খুঁচিয়ে হত্যার দৃশ্য দেখে। আদিবাসী সমাজের ভাবাবেগে আঘাত লাগছে, এই বোধ হয়নি। সরকারি ভাবে পশ্চিমবঙ্গের তফসিলি জনজাতির তালিকার প্রথমেই রয়েছে ‘অসুর’ জনগোষ্ঠী! একটি সম্প্রদায়ের প্রতি ধর্মীয় মোড়কে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ ভাবে ঘৃণার বার্তা দেওয়া হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে সবর্ণ সমাজ কখনও প্রশ্ন তোলেনি। এর কারণ লুকিয়ে আছে আর্য সংস্কৃতি ও অসুর সংস্কৃতির দ্বন্দ্বে। বৃহৎ বঙ্গে আর্য সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ও প্রতিষ্ঠা হয় সেন আমলে। এর পরেই শাস্ত্রকাররা ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য নানা বিধি-নিষেধ, নিয়ম-নীতি রচনা করেন, যার অনেকটাই অসুর সংস্কৃতির বিরোধিতার জন্য। যেমন, ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রঘুনন্দন ভট্টাচার্য অষ্টবিংশতি তত্ত্ব শাস্ত্রগ্রন্থে বাংলার শূদ্রদের জন্য এক মাস অশৌচ পালনের নির্দেশ দেন। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য রচিত পুরোহিত দর্পণ-এও এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার চিহ্ন মেলে।
পঞ্চদশ শতকে কৃত্তিবাস ওঝা অকালবোধন তত্ত্ব এনে বাংলার নিজস্ব অসুর সংস্কৃতির সর্বজনীন শারদ উৎসবের মোকাবিলা করার জন্য দুর্গাপুজোর তত্ত্ব প্রচলন করলেন, বা কৃত্তিবাস ওঝাকে দিয়ে করালেন তৎকালীন ব্রাহ্মণ্য শাসকগোষ্ঠীর প্রতিভূরা। কেন? কারণ, বর্ষা-শেষে শরৎকালে এই বঙ্গের নিজস্ব সংস্কৃতি, শাকম্ভরী এবং নবপত্রিকার উৎসব পালিত হত প্রতিটি ঘরে। যে উৎসব প্রকৃতই ছিল সর্বজনীন শারদোৎসব। এই শারদোৎসব শেষ হত গাসি পরবের মধ্যে দিয়ে। গাসি পরব ঘরে ঘরে পালিত হত। ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকরা অসুর সংস্কৃতিকে দমন করে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যেই দুর্গাপুজোর প্রচলন করেছিলেন, যা মহীরুহ রূপ ধারণ করে পলাশি যুদ্ধের পরে।
ঋগ্বেদে মোট ১৫০ বার অসুর শব্দের উল্লেখ রয়েছে। যার মধ্যে ১৩৫ বার ‘শুভ’ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। হরপ্পা বিশেষজ্ঞ ফিনল্যান্ডের আস্কো পার্পোলা তাঁর দ্য রুটস অব হিন্দুইজ়ম: দি আর্লি আরিয়ানস অ্যান্ড দি ইন্দাস সিভিলাইজ়েশন বইয়ে ভাষাতাত্ত্বিক উৎস দেখিয়ে বলেছেন ‘অসুর’ কথার অর্থ প্রভু, রাজপুত্র, দয়াশীল নেতা। নেদারল্যান্ডসের অসুর গবেষক এফ বি জে ক্যুইপার বলেছেন “অসুররাই হল উন্নত মানব সভ্যতার সৃষ্টিকারী।”
কোন সময়ে ‘অসুর’ শব্দটি শুভ থেকে ধীরে ধীরে অশুভ অর্থে প্রয়োগ হতে শুরু করা হল? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সময় এসেছে।
চণ্ডাল বিশ্বাস, চাকদহ, নদিয়া
জাতির জননী
কলকাতার রুবি পার্ক এলাকায় অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা আয়োজিত পুজোয় অসুররূপে মহাত্মা গান্ধীকে দেখতে পাওয়ার পর আমাদের বুঝি নতুন করে ভেবে দেখার প্রয়োজন, আজ ভারতে রাজনৈতিক-সামাজিক জীবনে গান্ধীর দর্শন কতটা তাৎপর্যপূর্ণ। গান্ধীকে এক শ্রেণির মানুষ ভগবান বলে মানেন, তাঁর কোনও সমালোচনাই যাঁরা মানতে নারাজ। অন্য দিকে আর এক শ্রেণি, বিশেষত যাঁরা দেশভাগের নৃশংসতার ভুক্তভোগী, তাঁদের কাছে তিনি খলনায়ক। এই দুই শ্রেণির বাইরে যাঁরা তাঁকে বোঝার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের অন্যতম বিনয় লাল। তাঁকে অনুসরণ করে বলি, গান্ধী পুরুষতান্ত্রিকতার ঊর্ধ্বে ছিলেন এমন দাবি করা যায় না, সংসারে পুরুষরাই মূলত রোজগার করবেন এবং মেয়েদের জন্য কিছু নির্দিষ্ট কাজ বরাদ্দ বলে তিনি মনে করতেন (ঠিক যেমন এক-একটি জাতের মানুষের জন্য এক-একটি কাজ বরাদ্দ বলে তিনি ভাবতেন)। কিন্তু মেয়েদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। মেয়েদের গৃহকাজের উপযুক্ত সম্মান দাবি করেছেন তিনি। আজ আমরা, নাগরিক মেয়েরা যখন কর্মসূত্রে অফিস যাই, আমাদের ঘরের কাজগুলো যে মহিলারা নিত্য সামলে দেন, তাঁদের আমরা আজও যোগ্য সম্মান দেওয়ার থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছি। মেয়েদের ‘পবিত্রতা’র নিদান মিলছে ঝকঝকে শহুরে আধুনিক মধ্যবিত্ত জীবনেও। গান্ধী কিন্তু প্রশ্ন করেছিলেন, “মেয়েদের পবিত্রতা নিয়ে এত উদ্বেগ কেন? পুরুষদের পবিত্রতা নিয়ে মেয়েদের কথা বলার জায়গা কি আছে? পুরুষদের কী অধিকার আছে মেয়েদের পবিত্রতার নিয়ম নির্ধারণ করার?”
তাঁর আশ্রমে মেয়েদের নিয়োগ করে গান্ধী তাঁদের বিয়ে আর ঘরকন্নার বাইরের একটা জীবনের সন্ধান দিয়েছিলেন। কমলা চট্টোপাধ্যায়, সরোজিনী নাইডু, উষা মেহতা, সুশীলা নায়ার, অরুণা আসফ আলির মতো অগণিত মেয়েকে ঘর থেকে বার করে এনে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে শামিল করা, মেয়েদের রান্নাঘরে কাটানোর সময় কী ভাবে কমানো যায়, গান্ধী সে-বিষয়েও ভেবেছিলেন। তাঁর খাদ্যতালিকায় অধিকাংশ খাবার ছিল রান্না-না-করা। গান্ধী মনে করতেন, প্রতিরোধের পথে মেয়েরা পুরুষদের চেয়ে এগিয়ে আছেন। বিগত কয়েক বছর ধরেই আমরা শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আমাদের দেশের মেয়েদের সাহসী প্রতিরোধের সাক্ষী হচ্ছি বার বার। তাঁর জীবনের অনেকটা সময় গান্ধী কাটিয়েছেন সেবার (নার্সিং) কাজে, যা আর একটি ‘মেয়েলি’ কাজ বলেই ধরা হয়।
গান্ধীর ১২৬ বছরের জন্মদিন উপলক্ষে মানুষী পত্রিকার নভেম্বর-ডিসেম্বর সংখ্যায় ‘দ্য মাদার ইন দ্য ফাদার অব দ্য নেশন’ প্রবন্ধে ইতিহাসবিদ বিনয় লাল জাতির জনকের মধ্যে জাতির জননীকে পেয়েছেন, যিনি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রসব করায় মুখ্য ভূমিকা নিতে পারেন। তাঁর ঘাতক মরাঠি ব্রাহ্মণ নাথুরাম গডসে-সহ গান্ধী-বিরোধীদের কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগের একটি ছিল তাঁর ‘মেয়েলিপনা’। তাঁর বিরুদ্ধে যে মুসলিমদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ছিল, তা আর আলাদা করে উল্লেখ না করে বরং আফরাজুল, আখলাক, আসিফা, শিবতুল্লা— সাম্প্রতিক সময়ের এই সহনাগরিকদের নামগুলো উল্লেখ করি, শুধুমাত্র ধর্মপরিচয়ের কারণে যাঁদের মতো আরও অনেকের অসহায় মৃত্যু অথবা লাঞ্ছনা আমরা ভুলতে পারি না। কলকাতার স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী দাঙ্গা কিন্তু গান্ধী প্রায় একা হাতে রোধ করেছিলেন। দুর্গাপুজোর আঙ্গিকে যদি গান্ধীকে ভাবতেই হয়, তবে অভয় দানকারী, সর্বমঙ্গলা মাতৃমূর্তিই কি বেশি উপযোগী নয়?
অন্য দিকে, অসুরকে আমরা অশুভ শক্তির প্রতীক বানিয়ে রেখেছি। কিন্তু সময়ের নিজস্ব দাবি থাকে। গত অন্তত এক দশক ধরে আমরা ক্রমশ পরিচিত হচ্ছি হুদুড় দুর্গার আখ্যানের সঙ্গে। হুদুড় দুর্গাই মহিষাসুর, তিনি মহিষাধিপতি। আমাদের দেশের মাটির বীর রাজা। লোহা গলানোর কাজ করতেন তিনি এবং তাঁর সঙ্গীরা। স্বর্গ-মর্ত-পাতালে কেউ যখন এই প্রবল পরাক্রমশালী রাজাকে পরাস্ত করতে পারছেন না, তখন তাঁকে বধ করার জন্য এক অপরূপ সুন্দরী আর্য রমণীকে পাঠান দেবতারা। কারণ, মহিলাদের আঘাত করা অসুর জনজাতির কাছে অধর্ম। সেই সুন্দরীর প্রেমের জালে ভুলে হুদুড় তাঁর সব অস্ত্র মাটিতে পুঁতে দিলে, সেই রমণী তাঁর উপরে চড়ে তাঁকে অন্যায় ভাবে হত্যা করেন, হুদুড় দুর্গাকে বধ করে তিনিই ‘দুর্গা’ নামে পরিচিত হন। গণমাধ্যমের দৌলতে এই নতুন আখ্যানের সঙ্গে আজ আমরা অনেকেই পরিচিত। অনেকে প্রশ্ন তোলেন, এই আখ্যানের ভিত্তি কী? এত দিন কোথায় ছিল এই আখ্যান? কিন্তু আধুনিক সময়ে বিভিন্ন পুরাণ-কাব্য-লোককথার ‘কাউন্টার ন্যারেটিভ’ উঠে আসছে খুব সঙ্গত কারণেই। এক জন কেবলই শুভ, আর তাঁর বিপরীতে দাঁড়িয়ে আর এক জন সম্পূর্ণত অশুভ— এই ভাবে আমরা দুনিয়াটাকে আর কত দিন দেখব? মহাত্মা গান্ধী ভারতের ইতিহাসে তাঁর যোগ্য স্থান পান। একই সঙ্গে, অসুর চরিত্রটিকেও নতুন আলোয় দেখা হোক, এই দাবি রাখছি।
স্বাগতা দাশগুপ্ত, কলকাতা-৬৪
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy