মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শুধু ইস্কুলটাই খুলল না’ (২৩-১২) লেখাটি এক জন ছাত্রী হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতা প্রকাশে উৎসাহিত করল। আমি সদ্য ইতিহাসে এম এ পাশ করেছি। গত ১৬ ডিসেম্বর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় গ্রন্থাগারে গিয়েছিলাম বই ফেরত দিয়ে লাইব্রেরি কার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা করে দেওয়ার জন্য। সে দিন কিছু পুরনো প্রশ্নপত্র দেখতে চাইলে ও বসে বই পড়তে চাইলে গ্রন্থাগারিক জানান, করোনা থেকে সাবধানতার কারণে বাড়ি থেকে বই এনে বসে পড়া যেতে পারে, কিন্তু এখানকার কিছু ছোঁয়া যাবে না। বই জমা নিলে করোনা হয় না, অথচ লাইব্রেরির বই সেখানে বসে পড়লে করোনা ছড়ায়, এমন বিচার কোন বৈজ্ঞানিক যুক্তির দ্বারা সিদ্ধ আমি জানি না। বিভাগীয় প্রধানের কাছে এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে উনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী যে হেতু আমি এম এ পাশ করে গিয়েছি সে হেতু যাদবপুরে নতুন করে ভর্তি না হওয়া পর্যন্ত আমি বহিরাগত। তাই লাইব্রেরি ব্যবহারের স্বাধীনতা আমার নেই। পাঁচ বছর এক জায়গায় পড়ার পর এবং পরবর্তী অধ্যয়ন এখান থেকেই চালিয়ে যাওয়ার অভিপ্রায়ের মাঝে, ‘বহিরাগত’ হওয়ার পর্যায় আত্মস্থ করতে আমার সপ্তাহখানেক সময় লেগে গেল। এখনও দুটো সিমেস্টারের মার্কশিট, সার্টিফিকেট পাওয়া বাকি। ২২ ডিসেম্বর ন্যাশনাল লাইব্রেরির সদস্য পদ গ্রহণ করতে গিয়ে ফিরে আসতে হল। দ্বাররক্ষীরা জানালেন, নতুন করে সদস্য পদ দেওয়া হচ্ছে না। কবে থেকে ফর্ম বিলি হবে সে নিয়েও খবর নেই। যাঁদের আগে থেকে সদস্য পদ রয়েছে, কেবল তাঁরাই অনলাইনে সিট সংরক্ষণ করে তবে পড়তে আসছেন। শপিং মল, সিনেমা হল, রেস্তরাঁ, বাস, ট্রেন, পুজো মণ্ডপ ভিড় কোথায় নেই! সবই চলছে, বিধিনিষেধ যত শিক্ষাক্ষেত্রে! আমার মতো যাঁরা ভিন্ন জেলা, ভিন্ন রাজ্য থেকে এখানে এসে পড়াশোনা চালাচ্ছেন তাঁদের বহু অর্থ অপচয় হচ্ছে। সরকারের উচিত ভবিষ্যৎ গবেষকদের গবেষণার কাজে উৎসাহিত করা, সহযোগিতা করা।
দেবর্ষিতা সান্যাল, কলকাতা-৩২
ফিরবে কি?
মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিবেদনে সংযোজন করতে চাই। আমার স্কুলটি প্রত্যন্ত গ্রামে অবস্থিত, ছাত্রছাত্রীরা বেশিরভাগ প্রান্তিক পরিবারের। পুরো করোনাকালে আমাদের ব্রাত্য রাখা হয়েছে, অসহনীয় লাগছিল। তাই জুনের শেষাশেষি ছাত্রছাত্রীদের খোঁজে স্কুলসংলগ্ন গ্রামগুলোতে অভিভাবকদের কাছে গিয়েছিলাম। বুঝেছিলাম নাবালিকা বিয়ে মারাত্মক বেড়ে গিয়েছে! কারণ তীব্র অর্থাভাব, তার উপর নিরাপত্তাহীনতা। নবম শ্রেণির ছাত্রীর অভিভাবক জানিয়েছিলেন— স্কুল তো বন্ধ, দুপুরবেলায় ঘরে মেয়েকে একলা রেখে খাটতে যেতে পারছেন না, তাই বিয়ে দিয়েছেন। আরও দেখেছিলাম ছেলেরা এ দিক ও দিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, বইখাতা থেকে শত যোজন দূরে, অর্থাভাব ঘোচাতে কেউ কেউ দিনমজুরি খাটছে। যত দিন যাবে, এদের বিদ্যালয়ে ফিরে পাওয়া দুঃসাধ্য হবে। এদের জন্যই করোনাবিধি মেনে সহকর্মীর বাড়ির উঠোনে সে দিন পাঠশালা খুলেছিলাম, যা অদ্যাবধি চলছে। তবে প্রথম প্রথম যে ভাবে ছাত্রছাত্রীদের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া পেয়েছিলাম, আজ যেন অনেকটাই স্তিমিত। সে দিন তো দশম শ্রেণিকে নিয়ে স্কুল খুলতে পারে বলতেই অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রী অভিমানী সুরে বলেই ফেলল, ‘‘তা হলে আমি আর পড়ব না।’’ বুঝতে পারি, ওরা আজ অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। তাই আর দেরি নয়, সরকার মহোদয়ের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে প্রতিটি ক্লাসকে সপ্তাহে অন্তত দু’দিন স্কুলে আসার বন্দোবস্ত করে দিয়ে স্কুল খোলায় উদ্যোগী হোন।
শুভ্রা সামন্ত, বালিচক ,পশ্চিম মেদিনীপুর
শুধুই সার্টিফিকেট
সব আন্দোলন হয়, কেবল ‘স্কুল খোলো’ বলে আন্দোলন হয় না। মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। সত্যি শিশুদের, ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ভাবার যেন কেউ নেই। অথচ কেন্দ্রে, রাজ্যে একটি করে সরকার রয়েছে। অনলাইনে শিক্ষা কোনও মতেই যে ক্লাসরুমের বিকল্প হতে পারে না, তা বোঝার যেন মানুষ নেই। গ্রাম দিয়ে ঘেরা এই বাংলায় অনলাইন ক্লাস চালানোর যে পরিকাঠামোই নেই, তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু ক্লাস চলল কি চলল না, এটা নিয়ে যেন ভাবার দরকার নেই। তাই খুব সহজেই তাঁরা উল্টো পথে হেঁটে সিলেবাস কমিয়ে দেন। হয়তো সরকারি কর্তারা ভেবে নিয়েছেন, এখন তো কোচিং-এর যুগ। স্কুলটা শুধুই সার্টিফিকেট পাওয়ার বাড়ি। তাঁরা বোঝার চেষ্টা করেননি, গ্রামের ক’জনই বা কোচিং-এর আওতায় আসে! আবার যারা আসে, সেই সব কোচিং সেন্টারে কি অতিমারির নিয়ম মেনে চলা হচ্ছে? এটা দেখারও কেউ নেই। অথচ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দিয়ে বিকল্প ভাবে ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করে কিছু ক্লাস করানোই যেতে পারত। পড়ুয়ারাও চায় স্কুলঘরে ফিরে আসতে। কিন্তু সে সব নিয়ে ভাবার জন্য যথাযোগ্য মানুষের বড়ই অভাব। আমরা সবাই ব্যস্ত আয়ারাম-গয়ারামের নাটক নিয়ে আলোচনা করতে। গ্রামের স্কুলের এক ছাত্রী তার দিদিমণিকে রাস্তায় দেখতে পেয়ে আবদার করে বললে, ‘‘দিদিমণি, এ বছরের সরস্বতী পুজোটা অন্তত করো। আর আমাদের ফেয়ারওয়েলটা দেওয়ার ব্যবস্থাটাও।’’
সুদীপ মাইতি, কাঁথি, পূর্ব মেদিনীপুর
নিষ্ক্রিয় নন
মনীষা বন্দোপাধ্যায়ের লেখায় শিক্ষার অধিকার এবং শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনার অবকাশ আছে। করোনা-পরবর্তী নব্য স্বাভাবিকতায় ধীরে ধীরে সব বাঁধন খুলে যাচ্ছে, খুলল না স্কুল। তবে শিক্ষকরা বাড়ি বসে আছেন, এ রকম কথা যাঁরা বলেন তাঁদের জানানো যায়, লকডাউন পর্বে প্রায় ন’মাস মিড-ডে মিলের খাদ্যশস্য বিতরণের দায়িত্ব নিয়েছেন শিক্ষকরাই। স্কুল করণিক, অন্য দু’-এক জন স্টাফদের নিয়ে সামাজিক দূরত্ব ও নিয়ম মেনে কাজ করতে হয়েছে। সঙ্গে ছিলেন অভিভাবকেরা। এ ছাড়াও লকডাউন পরিস্থিতিতে শিক্ষক-শিক্ষিকারা অনলাইনে বহু পরিশ্রমে ছাত্রছাত্রীদের এক একটি গ্রুপে ভাগ করে রুটিন সময় বেঁধে দিয়ে শিক্ষার পরিবেশ তৈরির প্রভূত চেষ্টা করে গিয়েছেন। এখনও করছেন। আর যে মুষ্টিমেয় ছাত্রছাত্রী নেট পরিষেবা পাচ্ছে না, তারা ‘অ্যাক্টিভিটি টাস্ক’-এর মাধ্যমে স্কুলের সঙ্গে যুক্ত থাকছে। সুতরাং পরিস্থিতি-পরিবেশ আমাদের যে পথেই নিয়ে যাক, আমাদের খুঁজতেই হবে সমাধানের পথ। ছাত্রছাত্রীর কচি মনে স্কুলের সবুজ গাছ, ক্লাসঘর, বিরাট খেলার মাঠ, উদার আকাশ যে প্রভাব বিস্তার করে, সেই পরিবেশ থেকে ওরা বর্তমান সময়ে বঞ্চিত হচ্ছে। আমরা আশাবাদী, এই নির্জন ইট-কাঠের ক্লাসঘর, সবুজ খেলার মাঠ আবার মুখর হয়ে উঠবেই।
মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস, নতুনপাড়া, জলপাইগুড়ি
চাল নিতে
মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমস্ত কথা সত্য হলেও একটি কথা সম্পূর্ণ সত্য নয়। তিনি লিখেছেন, ‘‘শিক্ষকদের এখন কাজ মাসে দুই-তিন দিন গিয়ে মিড-ডে মিলের সামগ্রী অভিভাবকদের হাতে তুলে দেওয়া, শিক্ষাবর্ষ শেষে নতুন ভর্তি ইত্যাদিতে তাঁরা যুক্ত।’’ প্রথমত, সমস্ত শিক্ষক মিড-ডে মিল বিলি বা ভর্তির কাজে যুক্ত নন। দ্বিতীয় তথ্যটি হল, লকডাউন চলাকালেও গ্রামের স্কুলগুলিতে খুব কম অভিভাবকই মিড-ডে মিলের সামগ্রী সংগ্রহ করতে স্কুলে যেতেন। আনলক পর্বে তো অভিভাবকেরা নিজেদের কাজ ফেলে প্রায় কেউই স্কুলে যান না। দূরত্ববিধি না মেনে, মুখাবরণ ছাড়াই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে মিড-ডে মিলের সামগ্রী সংগ্রহ করতে। গত ৩ ডিসেম্বর মুর্শিদাবাদ জেলার একটি শতাব্দীপ্রাচীন স্কুলে সেই ছবি দেখা গেল। সব স্কুলেরই চিত্র একই রকম।
চন্দ্রপ্রকাশ সরকার, বিবেকানন্দ পল্লি, বহরমপুর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy