রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্র।
প্রলয় চক্রবর্তী ‘পাশে দাঁড়াননি রবীন্দ্রনাথ’ (রবিবাসরীয়, ২৬-১) প্রবন্ধে জানিয়েছেন, শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ উপন্যাস ইংরেজ সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পর সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেননি রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্র দুঃখিত হয়েছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের চিঠি থেকে যে আংশিক উদ্ধৃতি দিয়েছেন, তা থেকে এ বিষয়ে কবিগুরুর প্রকৃত অবস্থান প্রতিফলিত হয়নি।
রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন প্রত্যাঘাত সুনিশ্চিত জেনেই শত্রুকে আঘাত করতে হবে এবং আঘাতের তীব্রতা নিয়ে হাহাকার করে লাভ নেই। শরৎচন্দ্রকে চিঠির এক জায়গায় তিনি লেখেন (২৭ মাঘ, ১৩৩৩): ‘‘...রাজশক্তির আছে গায়ের জোর, তার বিরুদ্ধে কর্তব্যের খাতিরে যদি দাঁড়াতেই হয়, তা হলে অপর পক্ষে থাকা উচিত চারিত্রিক জোর— অর্থাৎ আঘাতের বিরুদ্ধে সহিষ্ণুতার জোর। কিন্তু আমরা সেই চারিত্রিক জোরটাই ইংরেজরাজের কাছেই দাবি করি, নিজের কাছে নয়। তাতে প্রমাণ হয় যে, মুখে যাই বলি নিজের অগোচরে ইংরেজকে আমরা পূজা করি— ইংরেজকে গাল দিয়ে কোনো শাস্তির প্রত্যাশা না করার দ্বারাই সেই পূজার অনুষ্ঠান। ...কিন্তু তাই বলে কি কলম বন্ধ করতে হবে? আমি তা বলি নে— শাস্তিকে স্বীকার করেই কলম চলবে। যে কোনো দেশেই রাজশক্তিতে প্রজাশক্তিতে সত্যকার বিরোধ ঘটেচে সেখানে এমনই ঘটেচে— রাজবিরুদ্ধতা আরামে নিরাপদে থাকতে পারে না, এই কথাটা নিঃসন্দেহে জেনেই ঘটেচে। তুমি যদি কাগজে রাজবিরুদ্ধ কথা লিখতে তাহলে তার প্রভাব স্বল্প ও ক্ষণস্থায়ী হত— কিন্তু তোমার মত লেখক গল্পচ্ছলে যে কথা লিখবে তার প্রভাব নিয়ত চলতেই থাকবে— দেশে ও কালে তার ব্যাপ্তির বিরাম নেই। ...এমন অবস্থায় ইংরেজরাজ যদি তোমার বই প্রচার বন্ধ করে না দিত তা হলে এই বোঝা যেত যে সাহিত্যে তোমার শক্তি ও দেশে তোমার প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে, তার নিরতিশয় অবজ্ঞা ও অজ্ঞতা। শক্তিকে আঘাত করলে তার প্রতিঘাত সইবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, এই কারণেই সেই আঘাতের মূল্য— আঘাতের গুরুত্ব নিয়ে বিলাপ করলে সেই আঘাতের মূল্য একেবারেই মাটি করে দেওয়া হয়।’’
সহজেই অনুধাবন করা যায় লেখক হিসেবে শরৎচন্দ্রের প্রতি রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধা কত গভীর। ‘পথের দাবী’ যে নিষিদ্ধ হয়েছে, তা সাহিত্যিক হিসেবে শরৎচন্দ্রের শক্তিমত্তারই নিদর্শন, তাঁকে অবজ্ঞা করার দুঃসাহস ইংরেজ শাসকের হয়নি, এমনটিই মনে করেন তিনি।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ নেপাল মজুমদারের মত বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন, ‘‘শরৎচন্দ্র অবশ্য কবির বক্তব্যের সঠিক তাৎপর্যটি তখন ঠিক উপলব্ধি করতে পারেননি। তাঁর সেই সাময়িক ক্ষোভ ও চিত্তবিক্ষেপের সুযোগে কেউ কেউ তাঁকে কবির বিরুদ্ধে প্ররোচিত করার চেষ্টা করেছিল। অর্বাচীন এবং দুই এক জন প্রবীণ রবীন্দ্র-বিদ্বেষী সমালোচকও কবির এই চিঠির অপব্যাখ্যা করে এমনও ইঙ্গিত করেছেন যে, কবি শরৎচন্দ্রের প্রতি ব্যক্তিগত ঈর্ষাবশত ‘পথের দাবী’র সরকারী নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদ জানাতে চাননি।’’ (রবীন্দ্রনাথ: কয়েকটি রাজনীতিক প্রসঙ্গ)।
এঁরা হয়তো ইচ্ছা করেই ভুলে যান, জেটি সান্ডারল্যান্ডের ‘ইন্ডিয়া ইন বন্ডেজ’ বইটি প্রকাশের অপরাধে যখন কবির অন্তরঙ্গ সুহৃদ, ‘প্রবাসী’ ও ‘মডার্ন রিভিউ’-এর সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কারাবাস ও জরিমানা হয়, তখনও রবীন্দ্রনাথ কোনও প্রতিবাদ-বিবৃতি দেননি।
শুধু তা-ই নয়, তাঁর নিজের লেখা ‘রাশিয়ার চিঠি’র ইংরেজি অনুবাদ ‘অন রাশিয়া’ ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর যখন ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ করে, তখনও রবীন্দ্রনাথ বিষয়টিকে কোনও
গুরুত্বই দেননি, কারণ তিনি জানতেন স্টালিন জমানার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা এবং তাকে অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন কোনও সাম্রাজ্যবাদী, পুঁজিবাদী শক্তির পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়, প্রত্যাঘাত অবশ্যম্ভাবী।
১৯৩৫ সালে গ্যোটে, শিলার, হাইনে, ব্রেখট প্রমুখ লেখকদের সঙ্গে যখন রবীন্দ্রনাথের বইগুলিও জার্মানিতে নিষিদ্ধ হয়ে গেল, তখন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘‘...আমার পক্ষে হিটলারের প্রয়োজনই হয় না। মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিই যে একদা এমন ছিল যখন কালিদাস প্রভৃতি কবি রসজ্ঞমহলে তাঁদের কাজের প্রচার হলে খুশি হতেন। আমার দুঃখ এই যে বিক্রমাদিত্যের সংবাদ পাওয়া যায় না। ...বাণীকে সোনার দরে বিক্রির বৈশ্যরীতি বর্বরতা এ কথা মানতেই হবে।’’ (প্রবাসী, শ্রাবণ ১৩৪২)।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে, শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ উপন্যাসের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলেও, রবীন্দ্র-প্রয়াণের পরেও ‘অন রাশিয়া’র উপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকে। স্বাধীনতার পরেও তা প্রকাশিত হয়নি। অবশেষে ১৯৬০ সালে বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত হয় ‘লেটার্স ফ্রম রাশিয়া’। কেন এই কালক্ষেপ? আসলে সাম্যবাদের অবিমিশ্র প্রশংসা এ দেশে অনেকেরই ছিল না-পসন্দ।
শিবাজী ভাদুড়ী
সাঁতরাগাছি, হাওড়া
তাঁর মূল্যায়ন
কলকাতা বন্দরের নাম পরিবর্তন প্রসঙ্গে ‘নায়ক?’ (১৯-১) শীর্ষক সম্পাদকীয়টিতে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে যে ভাবে আঁকা হয়েছে, আমরা যারা বয়সে স্বাধীনতার সমকালীন, বেদনাহত হই। বিশেষত, রচনাটির শেষাংশে ‘‘তিনি স্বঘোষিত ভাবে হিন্দু বাঙালির নেতা ছিলেন, মুসলিম বাঙালি বিষয়ে তাঁহার ঘৃণা ও দ্বেষ ছিল প্রকট’’ বিশ্বস্ত কোন আকরগ্রন্থ থেকে জানা গেল?
সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে তুলনা টেনে যতই বক্রোক্তি প্রকাশ করা হোক, বয়সে প্রায় ১২ বছরের ছোট শ্যামাপ্রসাদ ১৯৪১ সালের আগে রাজনীতিতে শামিল হননি। তখনও পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে— শিক্ষাজগতে সংস্কার করে নতুন নতুন বিভাগ খুলছেন। ১৯৪১ সালে ফজলুল হক মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী হিসেবে ভারতীয় রাজনীতিতে তাঁর আবির্ভাব। ১৯৪২-এ কংগ্রেসের ডাকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ। তিনিই বড়লাট লর্ড লিনলিথগোকে (১২-৮-১৯৪২) চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন ভারতের যাবতীয় রাজনৈতিক দাবির মীমাংসাকারী হিসেবে মহাত্মা গাঁধীকে স্বীকার করে নেওয়া প্রয়োজন। ফজলুল হকের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর ছিল। মুসলমান বাঙালি বিষয়ে তাঁর ঘৃণা ও দ্বেষ প্রকটিত হওয়ার যুক্তি ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না।
তবে হ্যাঁ, মুসলিম লিগ সম্পর্কে মহাত্মা গাঁধী ও শ্যামাপ্রসাদের অবস্থান ছিল বিপরীত মেরুতে।
জাতীয় রাজনীতিতে শ্যামাপ্রসাদের স্থিতিকালও ছিল অতি স্বল্প— ১২ বছরের মতো। মেদিনীপুর জেলায় সরকারি নির্যাতন মাত্রাছাড়া হলে (১৬-১২-১৯৪২) মন্ত্রিসভা থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। এর পরে ১৯৪৩ সালে বাংলার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে ত্রাণকার্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। নীতিগত বিরোধের ফলে নেহরু মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। বিরোধী নেতা হিসেবে লোকসভায় অসামান্য বাগ্মিতার পরিচয় দেন।
তাঁর বিস্তৃত কর্মধারার পরিচয় এই চিঠিতে দেওয়া সম্ভব নয়, তা উদ্দেশ্যও নয়। নিবন্ধে এই নিরলস দেশপ্রেমিককে যতই খাটো করে দেখানো হোক, তাঁর সমকালে চিত্তরঞ্জন ও সুভাষচন্দ্রের পরেই তাঁর স্থান, রাজনীতিতে তাঁকে উপেক্ষা করা যাবে না। হিন্দু মহাসভা ও জনসঙ্ঘের সঙ্গে বাংলা বিভাজনে তাঁকে জড়িয়ে বাঙালিদের মতো সারা ভারতে কেউ এত কুৎসায় সরব হয়নি। আবার কাশ্মীরে সরকারি বন্দিত্বে তাঁর মৃত্যুর তদন্ত-প্রশ্নে এত নীরবতা কোনও জাতি দেখাতে পারেনি।
স্নেহেন্দু মাইতি
পূর্ব মেদিনীপুর
হেমন্ত
‘হেমন্তের অাবহ’ (৩০-১) চিঠি প্রসঙ্গে বলি, অজয় করের ‘কাঁচ কাটা হীরে’ ছবির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। হেমন্ত সুরারোপিত এটিই একমাত্র ছবি, যেখানে একটিও গান ছিল না। পুরো ছবিতে হেমন্ত-সৃষ্ট অনন্য আবহ, পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্ব, মায়ের মমতা, নায়ক-নায়িকার প্রেমকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল।
হীরালাল শীল
কলকাতা-১২
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy