Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
religion

সম্পাদক সমীপেষু: ধর্ম, বিশ্বাস, যুক্তি...

আদালতের কোনও রায় সমর্থনযোগ্য হলে, সব রায়কেই সেই অনুযায়ী সমর্থন করতে হবে— এ কেমন কথা?

শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:০৫
Share: Save:

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তোমার দুটো হাতের আশ্রয়ে’, ২৬-১১) নিবন্ধ বিষয়ে কতকগুলি কথা বলার থাকে। রামজন্মভূমি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘিরে যে তর্ক-বিতর্ক চলছে, তার ফলে যদি সম্প্রদায়গত কোনও অশান্তি না ঘটে, তার কৃতিত্ব অবশ্যই তাঁদের, যাঁরা এই রায়ের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। তাঁরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিচয় দিয়েছেন। সবাই জানেন, আধ্যাত্মিকতার আধারে, এমনকি অপব্যাখ্যাত ইতিহাসের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে যাঁরা রামের অস্তিত্বের উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস রাখেন, সেই বিশ্বাসকেই মূল্য দেওয়া হয়েছে এই রায়ে। রামচন্দ্র ছিলেন, অতএব ছিলেন; রামচন্দ্র এখানেই জন্মেছিলেন, অতএব এখানেই জন্মেছিলেন। প্রবন্ধ জুড়ে তাঁদেরই কথা, তাঁদেরই ভাবনাচিন্তা ঘুরে ফিরে এসেছে। এঁদেরই কেউ কেউ ধর্মীয় ভাবাবেগাচ্ছন্ন হয়ে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যার ঐতিহাসিক ওই সৌধের উপর চেপে তাকেই ধুলায় মিশিয়ে দেওয়ার সযত্ন প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। এখন বলা যেতেই পারে, তাঁরা কিন্তু অপরাধী ছিলেন না। তাঁরা তাঁদের বিশ্বাসকে মর্যাদা দিয়েই এ কাজ করেছিলেন। সে দিন সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের আবহে যে অশান্তি হয়েছিল, তার জন্য কাদের দায়ী করা হবে, তা নিয়ে নিবন্ধে আলোকপাত করা হয়নি।

আদালতের কোনও রায় সমর্থনযোগ্য হলে, সব রায়কেই সেই অনুযায়ী সমর্থন করতে হবে— এ কেমন কথা? তা ছাড়া, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যা বলে সেটাই সত্য, এ কথাও ভিত্তিহীন, অবৈজ্ঞানিক। এক সময় প্রায় সব মানুষই বিশ্বাস করতেন, পৃথিবী স্থির, সূর্য তাকে প্রদক্ষিণ করছে। তাই বলে তা সত্য হয়নি।

লেখক বলেছেন, ‘‘আধ্যাত্মিকতা এই দেশের শক্তিই শুধু নয়, সবচেয়ে বড় ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি।’’ এ কথা বলে তিনি আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতার একটি নিবিড় সংযোগ স্থাপন করতে চেয়েছেন। অথচ, কোনও একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের নাগরিক যে কোনও ধর্মের অনুসারী হতে পারেন; সেই ধর্মীয় আচরণ পালনেও তাঁর সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে। সেই স্বাধীনতা যাতে খর্ব না হয় তার দেখভাল করবে রাষ্ট্র। কিন্তু ওই রাষ্ট্র কোনও বিশেষ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে না। আমাদের দেশে অবশ্য এই চিন্তাকে কোনও ভাবেই মূল্য দেওয়া হচ্ছে না। অবাক কথা, আদালতও সেই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকেই মন্দির নির্মাণের দায়িত্ব দিয়েছে।

গৌরীশঙ্কর দাস

সাঁজোয়াল, খড়্গপুর

বিশ্বাসের জোর

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় শৈব সংস্কৃতির সঙ্গে রামরাজত্বের কষ্টকল্পিত যোগসূত্র খুঁজতে গিয়ে, মন্দির-মসজিদ রাজনীতির পঙ্কিল আবর্তে পথ হারিয়েছেন। রায়ের ফলে কোনও সাম্প্রদায়িক অশান্তি বাধেনি, সেটা রায়ের সঙ্গতির পরিচয়বাহক না-ও হতে পারে। ধর্মান্ধ রাজনীতির ফলাফল সম্পর্কে, সম্প্রদায় নির্বিশেষে নাগরিক সমাজের সার্বিক নিস্পৃহতা ও উপেক্ষার পরিচয়ও হতে পারে। আর রায় পছন্দসই না হলে
বিরূপ প্রতিক্রিয়া শুধু ঘৃণ্য লিবারালদের একচেটিয়া কেন হবে, ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতার পরিসর খুঁজতে চিনে কেন যেতে হবে, এ দেশেই তার পরিচয় যথেষ্ট দেখা গিয়েছে, শবরীমালায় ঋতুযোগ্য নারীদের প্রবেশাধিকার রায়ের
উদ্ধত প্রতিক্রিয়ায়।

রাম হিন্দুদের বা ঈশ্বর-বিশ্বাসীদের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়, এটা অনিতা বসুর সাম্প্রতিক গবেষণার অনেক আগেই, এ কে রামানুজমের তিনশত রামায়ণের গবেষণায় বিধৃত আছে। রাহুল সংকৃত্যায়নের উল্লিখিত পুস্তকের বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন। বরং রাহুলের ‘ভোল্গা সে গঙ্গা’ পুস্তকে অবক্ষয়ী বৌদ্ধ যুগের অবসানে, পুনরুত্থিত হিন্দু সামরিক শক্তির দ্বারা বৌদ্ধ মন্দির ও বিগ্রহ ধ্বংস ও অধিগ্রহণের ইতিহাস প্রণিধানযোগ্য। এই পরিবর্তন রক্তক্ষয়ী হতেও পারে, ইতিহাস জানা যায় না, কিন্তু এটা দেখা যায়, সমগ্র ভারতভূমি থেকে বৌদ্ধরা বিতাড়িত হয়েছিলেন। সোমনাথ মন্দির যারা ভেঙেছিল, তাদের ধর্ম ছিল লুটতরাজ। সামন্ত রাজারা যে ধনসম্পদ মন্দিরে লুকিয়ে রাখতেন, সেটাই ছিল লক্ষ্য। ধর্মের সঙ্গে যখন থেকে রাজশক্তির যুগল মিলন হয়েছে, সেই থেকেই আক্রমণের শিকার হয়েছে মন্দির মসজিদ গির্জা গুরুদ্বার, কারণ এগুলো রাজশক্তির প্রতীক হয়ে গিয়েছে। তাই এক দিন যারা মারে, আর এক দিন তারাই ভক্ত সাজে। মরাঠা সেনারা মহীশূরের শৃঙ্গেরী মঠ ভেঙে ফেলে, পুনরুদ্ধার করেন টিপু সুলতান। আর বিষ্ণুপুরের মল্লরাজারা মদনমোহন দেবকে রক্ষার জন্য দলমাদল কামান ব্যবহারের শক্তি পান দেবতার আশীর্বাদে, মরাঠা বর্গী দস্যুর আক্রমণ ঠেকাতে। আওরঙ্গজেব বিশ্বনাথ মন্দির ভাঙেন, আবার গোলকুন্ডার মসজিদও ধূলিসাৎ করেন। আকবর সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য হিন্দু রাজাদের সঙ্গে সন্ধি করেন ও অনেক মন্দিরে দান করেন। যারা এক দিকে রামমন্দির গড়ে, আর এক দিকে তারাই সন্ত রবিদাস মন্দির ভাঙে।

সোমনাথ বা বিশ্বনাথ নয়, রামের রামায়ণের বিপরীতে নারীর সীতায়নও বরাবরই আছে সব আঞ্চলিক ভাষায়। তেলুগুতে ও বাংলার চন্দ্রাবতী রামায়ণে। সদ্যপ্রয়াত গবেষক নবনীতা দেব সেনের রচনাগুলিতে এ বিষয়ে তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা আছে।

লেখক ঠিকই বলেছেন, রামচন্দ্র আধ্যাত্মিক সভ্যতার দু’হাতের আশ্রয়েই ছিলেন। ১৯৪৯-এ মসজিদে রামলালার আবির্ভাবের আগে পর্যন্ত। তার পর ১৯৯২-এর তাণ্ডব আর ১৯৯৩-তে পূজারি লালদাসের হত্যার পর, সেই হাতের আশ্রয় ছেড়ে তাঁকে নিতে হয়েছে রাজনৈতিক তরবারির আশ্রয়। তখন থেকে ‘জয় সিয়ারাম’-এর মৃদু মন্ত্রকে ঢেকে দিয়েছে ‘জয় শ্রীরাম’-এর উচ্চকিত জয়ধ্বনি। আর রায় সেই পক্ষেই গিয়েছে বলেই হয়তো ধর্মোন্মাদদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেই। রায় অন্য রকম হলে, কী হত বলা যায় না।

আদালত বলেনি, মসজিদের নীচে মন্দিরই ছিল। কারণ পুরাতাত্ত্বিক গবেষণায় বিপরীত মতও আছে। প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডি এন ঝা ভিন্নমত পোষণ করেন। আর কোথাও কোনও পুরাণেই ওই বিশেষ স্থানটির বর্ণনা নেই মহাপুরুষের জন্মস্থান বলে। এই দেশে, আদিম এপম্যান থেকে মানুষ বিবর্তিত হয়েছে এটা চাক্ষুষ না করার ফলে ডারউইন ভুল হয়ে যান, কিন্তু শুধু বিশ্বাসের জোরে মহাপুরুষ ওখানেই জন্ম নেন।

আশিস গুপ্ত

কলকাতা-৭৩

ভারতাত্মা

2 শ্রীবন্দ্যোপাধায় তাঁর লেখায় রামকে নরচন্দ্রমা হিসেবেই অভিহিত করেছেন। কিন্তু যারা বাবরি মসজিদ ভেঙে সেখানে রামলালাকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তারা তো রামকে স্বয়ং ভগবান প্রমাণ করে সব যুক্তির ওপরে বসানোর চেষ্টা করছে। আজকে উত্তর ভারতের বেশির ভাগ প্রধান মসজিদের তলায় মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যাবে, সত্য। কিন্তু তা হলে তো বৃন্দাবনের মদনমোহন মন্দিরের তলায় জৈন বা বৌদ্ধদের মন্দিরও খুঁড়ে বার করে তার পুজো চালাতে হয় ন্যাস স্থাপন করে। আজকেও কুম্ভমেলায় শৈব-বৈষ্ণবদের লড়াই চলে আগে শাহি স্নান করবার জন্য। তা হলে রামনাম সঙ্কীর্তন করে লাভ কি হল? বিতর্কিত মন্দির যদি শৈবদের হয়, তা হলে রামলালার জন্মস্থানের প্রসঙ্গ আসেই বা কোত্থেকে? আসলে ভাঙার খেলা অতীতে কারা শুরু করেছে তা বিচার করে আজকেও সেই খেলা চালিয়ে যাওয়া, বর্বরতারই নামান্তর। লেখকের নিজের যুক্তি, ধ্বংস দিয়ে ধ্বংসের প্রতিবিধান অসম্ভব। এই কারণেই সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান রায়ের সঙ্গে ‘রামরাজ্য’-এর ন্যায়বিচার মেলাতে পারছেন না চিন্তাবিদরা। মন্দির-মসজিদ বিতর্ক জিইয়ে না রেখে বিতর্কিত জমি সরকারের হাতেই রেখে তার দু’পাশে মন্দির-মসজিদ গড়ে নেওয়া যেত। ‘ওহি মন্দির’ রাজ-অনুগ্রহে বা প্রভাবে বানানো যায়। কিন্তু পাশাপাশি বসে চা খাওয়া ভারতীয়ের পাঁচ হাজার বছরের ঐতিহ্য বানিয়ে তোলা যায় না। তার জন্য ভারতাত্মার যে বোধের প্রয়োজন, সেটা এই রায়ে নেই বলেই মনে হয়।

নীলোৎপল বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা-৫১

অন্য বিষয়গুলি:

Faith Rama Babri Mosque Ram Janmobhumi Ayodhya Letters To Editor
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy