‘নিদ নাহি আঁখিপাতে’ (১১-৪) শীর্ষক প্রবন্ধে ঐশী চট্টোপাধ্যায় আমাদের একটি কঠিন প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছেন, ‘অনিদ্রাও কি এক অন্য মহামারি?’ বেশ কয়েক বছর আগে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের গবেষকরা ঘুমের উপর প্রযুক্তির প্রভাব এবং কম ঘুমোনোর কারণে শারীরিক সমস্যা সংক্রান্ত গবেষণা করে দেখিয়েছেন, অনিদ্রার কারণে মানুষের বোধশক্তি কমে এবং একটানা দীর্ঘ দিন ধরে ঘুম কম হলে স্থূলতা, ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদ্রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। যে কোনও মানুষের দৈনিক সাত-আট ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, জৈবিক প্রক্রিয়ায় মানুষের ঘুমোনোর কথা সন্ধ্যার পরই। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তিময় জীবনযাত্রা বাধ্য করে দেরি করে ঘুমোতে এবং সঙ্কটের শুরু এখান থেকেই।
টেলিভিশন, ল্যাপটপ, মোবাইল আসার পর মানুষ দিন দিন অনলাইন বিনোদনে আসক্ত হয়ে পড়ছে। দৈনন্দিন কাজকর্ম সারার পরও এই সমস্ত যন্ত্রের পিছনে অনেক সময় দিচ্ছে। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, রাতে মানুষের ঘুম আসার পিছনে কারণ হল শরীরে মেলাটোনিন নামক এক হরমোনের ক্ষরণ। বৈদ্যুতিন মাধ্যমগুলি থেকে যে নীল আলো নির্গত হয়, সেটা এই মেলাটোনিন ক্ষরণ ব্যাহত করে, যার অবশ্যম্ভাবী ফল হল দেরিতে ঘুম আসা। বিশেষত স্মার্টফোন এমন একটি আবিষ্কার, যেটা মানুষকে একা বাঁচতে শেখাচ্ছে। সমাজ, পরিবার, বন্ধুবান্ধব, শিক্ষক, আত্মীয়স্বজন সব কিছুকে বাদ দিয়ে একরত্তি মুঠোফোন সম্বল করে মানুষ ঘরবদ্ধ জীবন কাটাতে ভালবাসছে। প্রযুক্তির নেশা এতটা গভীরে পৌঁছে গেছে যে, কিছু সময় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ হয়ে গেলে মানুষের মধ্যে এক সব হারানোর হাহাকার তৈরি হয়। ওইটুকু সময়ের মধ্যে চার পাশে, গোটা বিশ্ব জুড়ে কত কী যে ঘটে গেল, কত ভিডিয়ো পোস্ট হয়ে গেল, কত কমেন্ট, লাইক নজর এড়িয়ে গেল, এই বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকেই তৈরি হয় আশঙ্কা আর অশান্তি। ইদানীং মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে বাবা-মায়েরা বহু ছেলেমেয়ে নিয়ে আসছেন, যারা ‘অ্যাকিউট উইথড্রয়াল সিন্ড্রোম’-এর শিকার। সম্প্রতি ইটালির বকোনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক বিজ্ঞানী ফ্রান্সেসকো বিল্লারির মতে, গড়ে সাত-আট ঘণ্টা ঘুমোনো উচিত হলেও এই ইন্টারনেট পরিষেবা মানুষের ঘুমের সময় কমিয়ে দিচ্ছে। ঘুমের মানেরও অবনতি ঘটাচ্ছে। ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের অধ্যাপক ড্যানিয়েল ফর্জার বিষয়টি সহজ ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তাঁর মতে, রাতে বেশি ক্ষণ জেগে থাকার ইচ্ছা আর সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার মধ্যে নিরন্তর একটা লড়াই চলতে থাকে। প্রযুক্তি আমাদের দেরিতে ঘুমোনোর দিকে ঠেলে দিচ্ছে, অন্য দিকে জৈব ঘড়ি আমাদের সকাল সকাল জাগিয়ে দিতে চাইছে। এই দুই বিপরীত শক্তির মাঝখানে পড়ে গড় ঘুমের সময় দিন দিন কমে যাচ্ছে।
গৌতম সরকার, কলকাতা-৭৮
নিয়ম মতে
আমাদের অনেকেরই, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের রাত জেগে সমাজমাধ্যমে সক্রিয় থাকা, সিনেমা দেখা, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ল্যাপটপ ঘাঁটা, আর দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা রীতিমতো অভ্যাস হয়ে গেছে। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কারণে ঘুমের ধরনে বিশেষ প্রভাব পড়ছে। আমরা অনুভব করি, ঠিকমতো ঘুম হলে শরীর ও মন দুটোই ভাল থাকে।
আসলে আমাদের ঘুমচক্রকে নিয়ন্ত্রণ করে মেলাটোনিন হরমোন। যখন অন্ধকার হয়, তখন শরীরে মেলাটোনিন বৃদ্ধি পায় ও ঘুম আসে। আলোতে এটি কমে যায় এবং আমরা জেগে উঠি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেলোটোনিন কমতে থাকে। চিনিযুক্ত খাদ্য, অ্যালকোহল, ক্যাফেন, মশলাদার খাবার, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এই হরমোনের কার্যক্ষমতা অনেকটা ব্যাহত করে। এ ছাড়া অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, ঘুমের আগে ও ঘুমের সময় অতিরিক্ত ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রের ব্যবহারও এই হরমোনের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত করে। অতএব ভাল ঘুমের জন্য অবশ্যই প্রতি দিন রাতে তাড়াতাড়ি শুতে হবে ও খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়তে হবে। এ ছাড়া নিয়মিত যোগব্যায়াম, প্রাতর্ভ্রমণ, গায়ে সূর্যালোক লাগানো, ঘুম থেকে ওঠার এক-দু’ঘণ্টার মধ্যেই প্রাতরাশ করা আবশ্যক।
তরুণ কুমার নিয়োগী, কাঁচরাপাড়া, উত্তর ২৪ পরগনা
উল্টোযাপন
ঐশী চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ পড়ে অনিদ্রার মহামারির কথা জেনে আশঙ্কিত না হয়ে পারলাম না। প্রবন্ধকার অনিদ্রার নেপথ্যে যে কারণগুলো বলেছেন, তার সঙ্গে সহমত হয়েই আমার কয়েকটি কথা। এই অনিদ্রা রোগ জীবনযাপনের ধারাতে একটা বড় রকমের পরিবর্তনের কারণেই আমাদের শরীরে বাসা বাঁধছে। বেশ কিছু আগেও শোনা যেত— তাড়াতাড়ি শোয়া, ভোরবেলা ওঠা। আর এখন সাধারণত তার উল্টোটাই দেখা যায়— রাত করে শোয়া, দেরি করে ওঠা। শুরুতেই গোলমাল। বলা হয়, ‘রাত জেগে কাজ’, ‘রাত জেগে পড়াশোনা’ অনেক বেশি কার্যকর। শরীর যদি ঠিকঠাক না থাকল, তা হলে সে কার্যকারিতার কী মূল্য।
আগেও মানুষের কাজের চাপ ছিল, পড়াশোনাটাও ছিল। তবে হ্যাঁ, মুঠোফোন নামক অনিদ্রার প্রধান কারণটি ছিল না। যৌথ পরিবারগুলোতে যাঁরা বাড়ির কর্তা বা কাজকর্ম দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের উপরও তো চাপ কম ছিল না। কিন্তু তাঁরা সেই চাপ সামলাতে পারতেন শুধুমাত্র জীবনযাত্রায় নিয়মনিষ্ঠ ও সময়নিষ্ঠ থাকার জন্য। অর্থাৎ, কাজের সময় কাজ, খাওয়ার সময় খাওয়া, ঘুমোনোর সময় ঘুম। ফলে তাঁদের শরীর ঠিকঠাক চলত। অনিদ্রা রোগে কম আক্রান্ত হতেন।
স্বরাজ সাহা, কলকাতা-১৫০
সৃষ্টিশীল ঘুম
আমার ঘোর আপত্তি ‘অনিদ্রা মহামারি’ শব্দবন্ধটিতে। ‘অতিমারি’, ‘মহামারি’ শব্দগুলি ব্যবহৃত হয় পৃথিবীর একাধিক স্থানে দ্রুত সংক্রমিত রোগের ক্ষেত্রে, যেখানে সংশ্লিষ্ট রোগের প্রত্যক্ষ আক্রমণে রোগীর মৃত্যু ঘটার আশঙ্কা থাকে। অনিদ্রার সমস্যা অনেক রোগের রাস্তা খুলে দেয় সত্যি, কিন্তু বাড়িতে এক জন ঘুমের সমস্যায় ভুগলে অন্যরাও আক্রান্ত হবেন এবং নিদ্রা-বিরহে মারা যাবেন, এমন কথা বলা যায় না।
নিদ্রাহীনতা যদি একটি মারাত্মক রোগই হবে, তবে তো নিদ্রা-বিরহিত এত কবি-সাহিত্যিকদের রোগ-জর্জরিত ক্লেশকালে সৃষ্টির সুষমায় মেতে ওঠা নেহাতই অসম্ভব হত। নির্ঘুম রাতই গভীরে ডুব দেওয়ার আদর্শ সময়। কবি-লেখক কি স্রষ্টার গভীর রাতযাপনের ফল হিসাবে পাই বহুবিধ অমূল্য রতন। অন্যান্য সাধনার ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি, মধ্যরাতের তেল না পোড়ালে মহান সৃষ্টি প্রায় অসম্ভব। অন্য ভাবে বলতে গেলে, সমাজের এক-তৃতীয়াংশের নিদ্রাহীনতা বাকি দুই-তৃতীয়াংশের সুখনিদ্রার চবিকাঠি। ভারতে নাকি ৬১ শতাংশ মানুষ প্রয়োজনীয় পরিমাণ ঘুমোতে পারছেন না। অতএব, ভারতে সৃষ্টিশীল মানুষের অনুপাত বাকি দুনিয়ার চেয়ে বেশ খানিক বেশি।
সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমোতেই হবে— এই সাবধানবাণী ইদানীং বহুল প্রচারিত। না হলে ভয়ঙ্কর সব রোগ ঝাঁপিয়ে পড়বে। প্রশ্ন হল, কে না চায় ক্লান্তিহরা সুখনিদ্রা? কী করলে অথবা কোন অভ্যাস থেকে বিরত থাকলে বালিশে মাথা ঠেকালেই নিদ্রাদেবীর ক্রোড়ে আশ্রয় লাভ, সে কথা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারেন না। তা হলে কেন নানা সতর্কবাণী শোনানো? বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতেই হবে। সাধারণ জীবনযাপনে সে ভয়াবহতার পর্যায় নেই বললেই চলে। সুস্থ শরীরে এক-আধ দিন ঘুম না আসতেই পারে। তার জন্য ঘুমকে কখনও মাথায় চড়তে দেওয়া যাবে না। ক্লান্তিবোধ করলে শয়ন। প্রয়োজনে হট্টমন্দিরে। ঘুম নিয়ে দুশ্চিন্তা বাদ দিতে পারলেই ঘুমিয়ে একেবারে কাদা।
বিশ্বনাথ পাকড়াশি, শ্রীরামপুর, হুগলি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy