সুকান্ত চৌধুরীর প্রবন্ধ ‘কর্মনাশা হিসাবহীন’ (১২-১১) অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। প্রশ্ন ওঠে, এই পরিমাণ ছুটি কি সরকারি কর্মচারী এবং শিক্ষকরা আশা করে বসে থাকেন? যিনি কাজ করবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন তিনি অর্থের বদলে কি এত ছুটি চাইবেন? তা তো হতে পারে না। তা হলে, ডিএ-র বদলে ছুটির কথা বলে সরকার কী ভাবে কর্মচারীর আর্থিক চাহিদা এবং বর্ধিত ছুটিকে এক পঙ্ক্তিতে বসাচ্ছে?
প্রাবন্ধিক বুঝিয়ে দিয়েছেন এগুলি প্রশাসনের ব্যর্থতার ফল। এই বক্তব্যে একটু সংযোজন করতে চাই। খেয়াল করলে দেখা যাবে বাড়তি ছুটি দিলে সরকারের লাভের দিকও আছে। তা হল, সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা এবং আকর্ষণকে সমূলে উৎপাটিত করে দেওয়া। ফাঁক গলে শক্ত হচ্ছে বেসরকারি সংস্থার হাত। তাই পুঁজিবাদী শক্তিকে ধীরে ধীরে জায়গা করে দেওয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপগুলিকে সরকারি ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচনা করলে ভুল হবে না তো? রাজ্য এবং কেন্দ্রের মতাদর্শগত হাজার বিরোধের মাঝেও এই একটি বিষয়ে বড্ড মিল দেখা যাচ্ছে।
আজকাল তো দীর্ঘ ছুটির পরেই আবার ছুটির নোটিস আসছে। কখনও বর্ষায়, কখনও বেশি গরমে বাড়তি ছুটি ভোগ করছে শিক্ষার্থীরা। অথচ সেই একই পরিবেশে বেসরকারি স্কুলগুলি খোলা থাকছে। বাড়তি ছুটিতে মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ছে বহু ছাত্রছাত্রী। কত নাবালিকার বিবাহ হয়ে যাচ্ছে ছুটি সংস্কৃতির তোড়ে। গত কয়েক বছরে রেল, ব্যাঙ্ক, অফিস, স্কুল-কলেজে ছুটির জোয়ার এসেছে। কর্মসংস্থান কমেছে। ফলে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সংস্থা তথা বেসরকারি স্কুলের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ছে। বহু সরকারি স্কুল ছাত্রশূন্য হয়ে বন্ধের মুখে। অথচ তারই পাশে বেসরকারি স্কুল চলছে রমরমিয়ে! মানুষের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছে যে সরকারি কর্মচারীরা ফাঁকিবাজ। তাই আমার প্রশ্ন, যাকে প্রশাসনের ব্যর্থতা বলা হচ্ছে, তা কি শুধুই ব্যর্থতা, না কি সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা? যার মাধ্যমে বেসরকারি উদ্যোগকে অক্সিজেন জোগানো চলছে?
দীপায়ন প্রামাণিক, গড়পাড়া, উত্তর ২৪ পরগনা
কুঅভ্যাস
বামফ্রন্টের আমলে কর্মনাশা ‘বন্ধ’-এর রাজনীতি রাজ্যের কর্মসংস্কৃতিকে নষ্ট করেছিল, প্রতিবাদীদের রক্ষণশীল, বুর্জোয়া ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করা হত। বর্তমানের রাজ্য সরকার সেই আন্দোলনের পথ হিসাবে বন্ধকে বন্ধ করেছে বটে, কিন্তু উল্টো পথে কর্মনাশা দেদার ছুটিকে রাজনীতির হাতিয়ার করেছে। মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, রাজ্য সরকার মহার্ঘ ভাতা কম দেয় বটে কিন্তু ছুটি দিয়ে সেই ক্ষতিপূরণ করে দেয়। ছুটিপ্রিয় বাংলার শিক্ষক, কর্মচারীদের অনেকেই নাকের বদলে নরুন পেয়ে বেশ মজাতেই আছেন।
বিদ্যালয়গুলিতে ছুটির সংখ্যা ১৫০ দিনের উপর যুক্ত হচ্ছে নানা ধরনের ব্যক্তিগত ছুটি। সংখ্যা গড়ে বছরে কম করে ৩০ দিন। ছুটির পরে নতুন কর্মোদ্যম সৃষ্টির পরিবর্তে কাজে অনুৎসাহ তীব্র হচ্ছে। সারা বছর ছুটি থাকলেও অনেকেরই তাতে ক্লান্তি আসে না। দেদার ছুটির ফলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও পড়াশোনা এবং বিদ্যালয়ে আসার প্রতি অনীহা লক্ষ করা যাচ্ছে। আসলে ছাত্রছাত্রীরা কিন্তু বিদ্যালয়ে নিয়মিত আসতেই চায়। বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে চায়, আনন্দ ভাগ করে নিতে চায়। কিন্তু আমরা তাদের সেই অভ্যাস নষ্ট করে দিচ্ছি। তা ছাড়া সস্তায় জনসমর্থন পাওয়ার জন্য বিভিন্ন ভাবে পাইয়ে দেওয়ার যে রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকে, সেগুলি রূপায়িত করতেই শিক্ষক থেকে শিক্ষাধিকারিক, শিক্ষাপ্রশাসন পর্যন্ত সকলেরই সিংহভাগ সময় ও মনোযোগ চলে যাচ্ছে। তাই বিদ্যালয়গুলি যেন পঞ্চায়েতেরই আর এক রূপে পরিবর্তিত হয়েছে। সেখানে যেন অভিভাবকদের আসা-যাওয়া বেড়েছে শুধু পাওনা-গন্ডা বুঝে নেওয়ার জন্য! বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা যেন প্রধান করণিকে পরিণত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ভাব জিনিসটাই সকল অনুষ্ঠানের গোড়ায়। যদি ভাব না থাকে তবে নিয়ম থাকতে পারে, টাকা থাকতে পারে, কমিটি থাকতে পারে কিন্তু কর্মের শিকড় কাটা পড়ে তা শুকিয়ে যায়।
সুতরাং বিদ্যালয় একটা শিক্ষা দেওয়ার কলমাত্র নয়। শিক্ষাঙ্গনে যদি শিক্ষার ভাব ও পরিবেশ না থাকে তা হলে ক্রমশ বিদ্যালয়গুলি শুষ্ক ও নির্জীব হয়ে পড়বে।
সন্দীপ সিংহ, হরিপাল, হুগলি
ছুটির সার্কাস
স্কুল-কলেজ ও সরকারি দফতরে ছুটির হাল-হকিকত নিয়ে সুকান্ত চৌধুরীর প্রবন্ধ বিষয়ে কিছু কথা। সরকার বছরে ২০০-২২০ দিন স্কুলে কর্মদিবসের কথা বললেও বহু ক্ষেত্রেই বাস্তবে তা সম্ভব হয় না। বাড়তি এই ছুটির কারণ অনুসন্ধান করলে দেখব— প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আগে ও পরে স্কুলবাড়িটি ত্রাণশিবির হয়ে উঠেছে অনির্দিষ্ট কালের জন্য, স্কুলে নির্বাচন কেন্দ্র স্থাপন, নির্বাচন মিটলেও রক্ষী বাহিনীর অবস্থান, স্পর্শকাতর অঞ্চলে কেন্দ্রীয় বাহিনী বা পুলিশি টহলদারি, দুয়ারে সরকারের কাজকর্মের জন্য পঠনপাঠন নির্বাসন, দুটো বোর্ড পরীক্ষার জন্য আগে ও পরে পরীক্ষার মাঝেও পড়াশোনা বন্ধ, অঞ্চলের নানান সমস্যায় স্কুলবাড়ি দখল, অতিবৃষ্টিতে ‘রেনি ডে’। তার উপর রয়েছে শিক্ষকদের ক্লাসের বাইরে নানান দায়িত্ব পালন। যেমন, নির্বাচন, সরকারি সমীক্ষা, জনগণনা। সর্বোপরি শিক্ষকের অভাবের জন্য কিছু স্কুলে সব শ্রেণিতে রোজ পঠনপাঠন সম্ভব হচ্ছে না। অর্থাৎ পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির ক্লাস তিন দিন হচ্ছে, বাকি তিন দিন হয়তো নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির জন্য স্কুল বসছে। প্রয়োজনে একই সময়ে জোড়া ক্লাস দিয়ে শিক্ষকের অভাব পূরণ করছেন প্রধান শিক্ষক। জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষকের কাজ শুধু পাঠদান, তবে তা এখন শুধুই খাতায়-কলমে থাকছে। স্কুলে কেরানির কাজ থেকে ঘণ্টা বাজানোর কাজও মাঝেমধ্যে প্রধান শিক্ষককে করতে হচ্ছে। পাশাপাশি রয়েছে পাঠ্যবই সময়ে বণ্টন না হওয়া, ইউনিফর্ম সময়ে না পাওয়ার ঝামেলা। গত বছর গরমের ছুটি দফায় দফায় হওয়ায় প্রায় দেড় মাস ছুটি দেওয়া হল। এ তো ছুটির সার্কাস চলছে!
একেই আজ সরকারি বিদ্যালয়গুলো অপুষ্টিতে ধুঁকছে, এই সুযোগে বেসরকারি স্কুলগুলোর রমরমা বাজার গড়ে উঠছে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষাব্যবস্থায় এমনই এক অদ্ভুত আঁধার নেমে আসায় কচিকাঁচারা কিছু শিখছে না। ভিত তৈরি না হলে শিক্ষার্থীরা কী ভাবে জীবন গড়বে? কত ছেলেমেয়ে হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে! কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কম, তারা বুঝে নিতে পারে নিজেদের সমস্যা কোথায়! সেই অনুযায়ী তারা নিজের তাগিদে তৈরি হয়। কিন্তু এই সমস্ত প্রান্তিক অঞ্চলের অভিভাবকরা, কচিকাঁচারা নিজেদের সমস্যা কতটুকু বোঝে! আর যাঁরা তথাকথিত শিক্ষিত, তাঁরা প্রতিবাদ করতে গেলে কি তা আর সহ্য করা হবে?
সূর্যকান্ত মণ্ডল,কলকাতা-৮৪
ধ্বংসের পথে
রাজ্যে ৮০ শতাংশ পড়ুয়া সরকারি বা সরকারি সহায়তাপ্রাপ্ত স্কুলে পড়াশোনা করে। অনেকের টিউশনের সুযোগ কম, এরা মূলত স্কুলের পড়াশোনার উপর নির্ভরশীল। যত বেশি দিন স্কুল খোলা থাকবে তত এদের লাভ। সরকারি স্কুলের মানোন্নয়ন না হলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের শিক্ষায় আলোকিত করা সম্ভব হবে না। সব গোলমাল করে দিচ্ছে রাজ্যের ছুটি-সংস্কৃতি। এখনও রাজনৈতিক মিটিং হলে স্কুল বন্ধ করে সেখানে পার্টির লোকজনের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। দুয়ারে সরকার, ভোট, শব্দদূষণ স্কুলশিক্ষার প্রভূত ক্ষতি করছে। রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি এই অনৈতিক আচরণ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিরাট ক্ষতি করবে। অতিমারিতে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাজগৎ এ বার ধ্বংসই হয়ে যাবে অতিরিক্ত ছুটির দরুন।
গৌতম পতি, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy