সম্পাদকীয় ‘তর্কশীল’ (১৫-৯) প্রসঙ্গে কিছু কথা। ইসরোর চেয়ারম্যান মহাকাশবিজ্ঞানী কৈলাসাভাড়িভূ শিবনের চন্দ্রযান অভিযানের আগেই সাফল্যের জন্য তিরুপতির পদতলে কৃপাপ্রার্থী হওয়ার ঘটনা এবং জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল বাম ছাত্রনেত্রী ঐশী ঘোষের মুষ্টিবদ্ধ হাতে কবচধারণ নিয়ে লেখাটিতে বেশ কিছু অ্যাকাডেমিক যুক্তিতর্কের অবতারণা করেও ‘‘বরং কেন কেহ অন্যের ঘরে ঢুকিয়া অন্যের আচার পালন (এবং খাদ্য চয়নে) বাধা দিতেছেন, তর্কশীলের প্রশ্ন হওয়া উচিত তাহাই’’ লেখার সঙ্গে সঙ্গেই সমগ্র বক্তব্যটি ফোকাস থেকে সরে গিয়ে অকারণে রাজনীতির কথায় শেষ হল।
এ কথা মানতেই হবে যে বিজ্ঞান জানা আর বিজ্ঞানমনস্কতা— এ দুটো এক নয়। আমার পরিচিত অনেক বিখ্যাত সফল চিকিৎসক আছেন যাঁরা বাড়িতে প্রতি দিন সকালে এক ঘণ্টা ধরে পুজো করে প্রসাদী ফুল পকেটে নিয়ে তার পর অপারেশন থিয়েটারে ঢোকেন। অনেক বছর আগে এক জন অত্যন্ত শিক্ষিত এবং কমিটেড কমিউনিস্ট নেতার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত ভাবে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল যিনি তাঁর বাড়ির ঠাকুরঘরে রীতিমতো ঘণ্টা বাজিয়ে রোজ পুজো করতেন। আসলে সংস্কার ও জন্মগত বিশ্বাসের শিকড় মানুষের মনের এত বেশি গভীরে প্রোথিত যে পরিণত বয়সে পৌঁছেও তাকে সমূলে উৎপাটিত করা যথেষ্ট কঠিন। জোর করে যেমন কাউকে কিছু বিশ্বাস করানো যায় না, তেমনই কোনও গভীর বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে যাওয়া নিয়ে জবরদস্তি করা যায় না। সোভিয়েট ইউনিয়নে বিপ্লব সংঘটিত হয়ে যাওয়ার পর পার্টি চেয়েছিল সব চার্চ ভেঙে দেওয়া হোক কিন্তু রাজি হলেন না স্বয়ং লেনিন। এ বিষয়ে তাঁর বিখ্যাত উক্তি: "Let God die his natural death." পরবর্তী কালের ইতিহাস অবশ্য প্রমাণ করেছিল সেখানে ঈশ্বরের স্বাভাবিক কিংবা অস্বাভাবিক মৃত্যু কোনওটাই ঘটেনি।
আমাদের রাজ্যের কোনও এক জনপ্রিয় ক্রিকেটার যাতে সেঞ্চুরি করতে পারেন তার জন্যে কারা যেন এক বার বিরাট যজ্ঞ করেছিল মনে আছে। গ্রহগুলো একটি বিশেষ দিনে এক জায়গায় এসে ধুন্ধুমার বাধাবে যার ফলে পৃথিবীর ধ্বংস অনিবার্য— কয়েক বছর আগে জ্যোতিষীদের এ-হেন ভবিষ্যদ্বাণীকে ব্যর্থ করতে বিশাল যজ্ঞের কথাও খবরে এসেছিল। এ সব কর্মকাণ্ড নিয়ে মজা করা যেতে পারে কিন্তু দীর্ঘ গবেষণার সাফল্যের জন্যে কোনও বৈজ্ঞানিক সর্বসমক্ষে মন্দিরের দেবতার পায়ে ভক্তিভরে পুজো দিচ্ছেন অথবা ঘোষিত ভাবে বামপন্থী মতবাদে বিশ্বাসী কোনও ছাত্রনেত্রীর হাতে তাবিজ বা গলায় রুদ্রাক্ষ— এই দৃশ্য শুধু দৃষ্টিকটুই নয়, এ ঘটনা প্রগতিশীল যুক্তিবাদী মানুষের চোখে চূড়ান্ত এক অনাচার। ‘স্থানিক দেশাচার ও সময়ের কালাচার’ বা তথাকথিত ‘নম্য হিন্দুত্ব’ ইত্যাদি শব্দচয়নে এই নিদারুণ মানসিক দৈন্য ও বৈপরীত্য সমর্থন করা যায় না।
অনিলেশ গোস্বামী
শ্রীরামপুর, হুগলি
ভাষাসন্ত্রাস
2 কুমার রাণার ‘আনুগত্য আদায়ের ভাষা’ (২০-৯) নিবন্ধটির প্রেক্ষিতে এই সংযোজন। ভাষা যেখানে খাদ্যের মতো মানুষের জৈব-মানসিক সত্তার অঙ্গীভূত তাকে কি কোন পরিসংখ্যান দিয়ে বেশি কম অনুযায়ী শ্রেণিবিন্যাস করে গুরুত্ব আরোপ করা যায়? আসলে একটি ভাষা বা খাদ্য তার গুণগত উৎকর্ষের জন্য সমাদৃত হয়। সেই দিক দিয়ে দেখলে নিঃসন্দেহে ইংরেজি ভাষার বিশাল শব্দভাণ্ডার আমাদের আকৃষ্ট করে। আমরা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং সরকারি পরিসরে সাহিত্য, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, বাণিজ্য, কারিগরি এবং অন্যান্য শাখার ইংরেজি শব্দভাণ্ডার থেকেই অনায়াসে শব্দের চয়ন করে থাকি। এটা জোরজবরদস্তি করে হয়নি। বিভিন্ন শাখায় যুগ যুগ ধরে ইংরেজদের ব্যুৎপত্তি, গবেষণা এবং কর্মকুশলতায় এই বিশাল শব্দভাণ্ডার গড়ে উঠেছে। এবং এই কার্যকারিতার জন্যই ইংরেজির এই ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। তাই ইংরেজিকে বাদ দেওয়া মূর্খামি। তেমনই খাদ্যের মধ্যে চাইনিজ় খাবার সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয়, তার উৎকর্ষের জন্যই। এই প্রসঙ্গে ভারতে ছাতুর জনপ্রিয়তাও উল্লেখযোগ্য। তাই মনে প্রশ্ন জাগে: হিন্দি ভাষার উৎকর্ষতা কি ওই রকম বা ভারতের অন্য সমৃদ্ধ ভাষার মতো? মোটেই তা নয়। শুধু সংখ্যাধিক্যের পরিসংখ্যানের জোরে কেন্দ্র হিন্দিকে চাপিয়ে দেওয়ার কুমতলবে সক্রিয়। ইংরেজ জনসংখ্যার জোরে কি সারা পৃথিবীতে ইংরেজি ভাষার প্রতিষ্ঠা হয়েছে? ইংরেজির প্রতিষ্ঠা তার গুণগত মানের জন্য। অন্য দিকে বিভিন্ন রাজ্যে হিন্দির আগ্রাসন যা হয়েছে বা হচ্ছে, তা কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষাটির প্রতি আনুগত্য-পুষ্ট পৃষ্ঠপোষকতায়, কদর্য হিন্দি সিনেমা এবং হিন্দি বিনোদন চ্যানেলগুলির মাধ্যমে, জোরজবরদস্তির মাধ্যমে। গুণগত মানের জন্য নয়। এটা এক ধরনের ভাষাসন্ত্রাস। যে ভাষাসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল। ভারতে যাতে সেই পরিস্থিতির সৃষ্টি না-হয়, রাজনৈতিক নেতাদের সেটা খেয়াল রাখা উচিত। অহিন্দিভাষী রাজ্যগুলি থেকে অবিলম্বে হিন্দি ভাষাকে গুটিয়ে নিয়ে সেই রাজ্যের ভাষাকে কেন্দ্রীয় দফতরগুলিতে এবং সিবিএসই, আইসিএসই বিদ্যালয়গুলিতে প্রতিষ্ঠা করা হোক। না-হলে অসন্তোষের বীজ থেকেই যাবে। যা ভারতের একতার পক্ষে ভাল নয়।
অশেষ দাস
কলকাতা-১১০
ষড়যন্ত্র
2 কেন্দ্রের ‘এক দেশ এক ভাষা’ নীতির পিছনে লুকিয়ে আছে এক গভীর ষড়যন্ত্র। এত দিন যেন দেশের মানুষের ভাষা নিয়ে দুর্দশার সীমা ছিল না আর হিন্দি পড়লেই সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে। আসলে বিদ্যালয়ে হিন্দি ভাষাকে বাধ্যতামূলক করতে পারলে অহিন্দিভাষী রাজ্যগুলোর বিদ্যালয়ে বহু সংখ্যক হিন্দিভাষীকে চাকরি দেওয়ার সুযোগ খুলে যাবে। এটি পিছনের দরজা খুলে দেওয়ার একটি কৌশল। আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা যখন বিদেশে যান, তখন তাঁদের দোভাষীর শরণাপন্ন হতে হয়। কিন্তু তাঁরা যদি ইংরেজি ভাষা ভাল ভাবে রপ্ত করেন, তা হলে তাঁরা বিদেশে অনেক সাবলীল ভাবে কথা বলতে পারেন।
অর্ধেন্দু সরকার
বেলিয়াতোড়, বাঁকুড়া
আত্মসমর্পণ
আমরা সবাই এক ভাষায় কথা বলব— এর থেকে আনন্দের আর কী হতে পারে? কিছু লোক— কবরস্থ কিছু মানুষ— এই সাম্যবাদে যারপরনাই দুঃখ পেতেন— মার্ক টোয়েন তাঁদের মধ্যে এক জন। সেই কোন যুগে হাকলবেরি ফিনের অভিযানসমূহ লিপিবদ্ধ করার সময় তিনি মার্কিন ইংরেজি ভাষার সাত-আটটি আঞ্চলিক উপভাষার ব্যবহার করেছিলেন। পাছে পাঠক গুলিয়ে ফেলেন তাই ভূমিকায় উল্লেখও করে দেন, 'I make this explanation for the reason that without it many readers would suppose that all these characters were trying to talk alike and not succeeding.'
ভাষা এক হলে সংস্কৃতিও এক হয়ে যাবে ধীরে ধীরে। এখন বিশ্বকর্মা পুজোর ‘অমর সঙ্গী’ আর দুর্গাপুজোর ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ একে অপরের বিবাদ ভুলে ‘ওম জয় জগদীশ হরে’র সাগরে লীন হয়ে যাবে। অনেক কাল আগে আমার এক আফগান বন্ধুকে বলেছিলাম ‘কাবুল এক্সপ্রেস’ সিনেমাতে কী চমৎকার পশতু ভাষার ব্যবহার হয়েছে। বন্ধুর আমাকে প্রায় মারতে যাওয়ার উপক্রম— তাঁর কথার সারমর্ম হল: এ মোটেই পশতু নয়, ফারসির অপভ্রংশ— এ দুইয়ের মধ্যে জমিন আসমান ফারাক। ও ভাষা মোটেও তাঁদের ভাষা নয়।
সেই কথাটাই আজ কানে বাজে— সে ভাষা মোটেও আমাদের ভাষা নয়, অথচ সে ভাষাতেই আমাদের মুখ বন্ধ হতে চলেছে। আরও একটা আত্মসমর্পণ। আরও এক বার আত্মসমর্পণ।
অরিজিৎ সেন
কলকাতা-৪৭
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy