নেব্রাস্কার নির্জন রাস্তা।
দু’এক দিন আগে হঠাৎ আবহাওয়া ঠান্ডা হওয়াতে কিছুটা তুষারপাত হয়েছে। আমার ডেরা থেকে ল্যাব বিল্ডিং পর্যন্ত পৌঁছতে মিনিট ১৫ সময় লাগে। এর মধ্যে মাত্র মিনিট পাঁচেক বাইরে হাঁটতে হয়, বাকি পুরোটাই হাসপাতালের করিডোর ধরে হাঁটা পথ। শীতকালে ওই পাঁচ মিনিট বাদে, বাকিটা বিশেষ অসুবিধা হয় না। কিন্তু হাসপাতালের ভিতরের পথ এড়িয়ে বাইরে দিয়ে আসতে চাইলে ১৫ মিনিটের সোজাসাপ্টা পথটাই আরও খানিকটা বেড়ে যায়। আর সঙ্গী হয় শীতের কামড়ও। গতকালও বড় কষ্ট হয়েছে কনকনে হাওয়া আর হিমাঙ্কের নীচে চলে যাওয়া তাপমাত্রায়। তাও নির্দ্বিধায় বাইরের পথটাই নিতে হচ্ছে। হাসপাতালের ভেতরের রাস্তা এখন অপ্রয়োজনে এড়িয়ে চলারই নির্দেশ এসেছে গত সপ্তাহে। হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল দিকটায় গেলেই ওরা এখন একটা করে সার্জিক্যাল মাস্ক দিচ্ছে। গতসপ্তাহে এখানেই একটা রিসার্চের ফল দেখে, এই সতর্কতা নিচ্ছে ওরা।
অথচ কয়েক সপ্তাহ আগেও কোনও কিছুই হয়নি, এমন একটা আবহাওয়া ছিল চারিদিকে। মনে আছে, ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আমাদের ল্যাবেরই এক জন ছাত্র তার সাংহাইয়ের শহরতলির বাড়িতে কয়েক বাক্স সার্জিক্যাল মাস্ক পাঠাচ্ছিল পোস্টে। ফেডেক্সের অফিসে তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। ৭৫ না ৭৮ ডলার লেগেছিল শিপিং চার্জ। বেরিয়ে এসে বলেছিলাম, ‘‘ওরে বাবা! এতো অনেক!’’ যে ছেলেটির তেমন কোনও বন্ধু নেই, কোনও শখ আহ্লাদ নেই, কোনওক্রমে সেদ্ধ সব্জি, মাংস, সাদা ভাত আর ফলমূল হলেই চলে যায়, সেই ছেলেটি নির্দ্বিধায় বলে উঠেছিল, ‘‘কখনও কখনও পয়সা নয়, পরিস্থিতির কথাই গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত।’’ এমন একটা দার্শনিক উক্তি, ওই রকম একটা ‘কিছুতেই কিছু আসে যায় না’ টাইপের মানুষের মুখে গত ৪ বছরে সেই আমার প্রথম শোনা। অত্যন্ত অবাক হলেও, এখন বুঝতে পারি, বিপদের সময় বাড়ির লোকের নিরাপত্তাটা কতটা গুরুত্ব নিয়ে আসে। তখন ওর স্বদেশেই কেবল বিপদ ছিল। আমার স্বদেশে ছিল না। তাই ও জানত, পড়তো, আপডেটেড থাকত সেই বিপদ সম্পর্কে। আমি থাকতাম না। সে বিপদ যে এ দেশেও যে ঘাঁটি গাড়বে সে সম্পর্কে আজ থেকে ২ মাস আগেই সে ওয়াকিবহাল ছিল। সেই আসন্ন বিপদের গুরুত্ব বুঝে আগাম সতর্কতায় প্রায় তখন থেকেই ও হাসপাতালের বাইরে দিয়ে যাতায়াত করে। তখন ওকে দেখে আমরা ভাবতাম, “ধুস বাড়াবাড়ি।” আসলে বিপদ যত ক্ষণ না আমাদের ঘাড়ে চেপে বসছে, আমাদের নিজেদের ব্যক্তিগত স্তরে ক্ষতি না করছে, তত ক্ষণ আমাদের সে বিপদ সম্পর্কে যা থাকে তা মেকি সহানুভূতি। তা মোটেই সতর্কতা নয়। আমরাও তাই তখন থেকে সতর্ক হইনি।
নেব্রাস্কায় তুষারপাত
আমাদের এই ইউনিভার্সিটি অফ নেব্রাস্কা মেডিক্যাল সেন্টার যদিও ইউনাইটেড স্টেটসের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আগেই একটু বেশি তৎপর ছিল। তার কারণ, ওই ক্রুজ শিপ থেকে এ দেশীয় সমস্ত যাত্রীদের এখানেই আনা হয়েছিল কোয়রান্টিন আর অবর্জাভেশনের এর জন্য। গত বার ইবোলার সময়ে এত ভাল কাজ করেছিল যে সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে এই বিশ্ববিদ্যালয় এখন একটা নাম। সে সব যাত্রীদের সাধারণের নাগালের অনেক বাইরে বহু সতর্কতায় রাখা হয়েছি, তাঁদের নিয়ে আমাদের চিন্তার কোনও কারণ ছিল না। তার পর দিন বদলাতে থাকলো। পূর্ব উপকূলের রাজ্যগুলি বিশেষত নিউইয়র্কে মারণযজ্ঞ তখন সবে শুরু হয়েছে। আমাদের এই শহরেও ভয় আর আতঙ্ক বাড়তে থাকলো। নানা রকম খবর শুনি। জিনিসপত্র কিনে রাখতে শুরু করেছে অনেকেই। সব বন্ধ হয়ে গেলে রেঁধে খাবার জিনিস বাড়ন্ত হবে যে। কিন্তু তখনও বেশ অনেকের কাছেই ব্যাপারটা হাস্যকর, নতুন একটা ব্যাপার। ফেসবুক, টুইটার ইনস্টাগ্রাম খুলে লোকে নানান মজা দেখাচ্ছে। লোকে টয়লেট সিট চেটে দেখাচ্ছে যে, দেখো আমি কত সাহসী। আমার রোগের ভয় নেই। এ দিকে সমস্ত সুপার মার্কেটে টয়লেট পেপার, কিচেন টাওয়েল, হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং সমস্ত রকমের জীবাণুনাশক তখন বাড়ন্ত। এক দিন বাজার করতে গিয়ে সারা শহর খুঁজে খুঁজেও একটা হ্যান্ড স্যানিটাইজার পেলাম না। আমাদের বাজার করতে যেতে দেরি হয়ে গিয়েছিলো। মোটামুটি সপ্তাহ দু’য়েক রান্না-বান্না চলার মত বাজার করলাম। এটাও শুনলাম যে, এখানে নাকি বন্দুক কেনার হিড়িক পড়ে গিয়েছে। অর্থাৎ আমি আমার খাবার লুঠ হওয়া থেকে বাঁচাতে বন্দুক কিনে রাখছি। শুনে কি প্রতিক্রিয়া দেওয়া উচিত সেটা বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
এর মধ্যে খবর পাচ্ছিলাম, আস্তে আস্তে পূর্ব দিকের শহরগুলির রিসার্চ ল্যাবগুলো বন্ধ হচ্ছে। বন্ধ মানে, ওয়ার্ক ফ্রম হোম। কিন্তু যাদের বেঞ্চে এসে কাজ না করলে হবে না, তারা কী করবে? অদ্ভুত এক দোলাচল। এ দিকে আমি সদ্য একটা পেপার জমা দিয়েছি। সপ্তাহ দুই পরেই তার রিভিউয়ারদের কমেন্ট আসবে। তাঁদের মতামত অনুসারে আমায় যদি আরও বেশ কয়েকটা এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে হয়, তা হলে আমি এই অবস্থায় কী করে করবো? যদিও এই অবস্থায় সকলেই সময় বাড়াচ্ছে। দেখা যাক। এদিকে ভারতেও সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। বাড়ির জন্য চিন্তা বাড়ছে। আমার বাড়ির অনেককেই এখনও নিয়মিত বাইরে বেরোতে হচ্ছে। সত্যি কথা বলতে, রাতে ঘুম আসতে দেরি হচ্ছে। দিনের বেলা ল্যাবে গিয়ে নানা রকম খবর পাই। সঙ্গে নেটের খবর তো আছেই। ১৬ মার্চ এখানে জিম, বার, নাইট ক্লাব, রেস্তোরাঁ সব জায়গাতেই ১০ জনের বেশি একসঙ্গে জড়ো হওয়া বারণ। তার পর এ সব কিছুই বন্ধ হয়ে গেলো। রেস্তোরাঁ থেকে যদিও খাবার অর্ডার করার অপশন এখনও খোলা আছে। তবে পাবলিক হেলথ সম্পর্কে নিজের নিজের ধারণা মেনে কেউ এটাকে বেছে নিচ্ছেন। কেউ অবশ্য মানছেন না। সারা দিন ইউনিভার্সিটির জিমটা সরব থাকত। গমগম করত ভোর বেলা আর সন্ধ্যা বেলা। এখন যখন জিমের পাশ দিয়ে রোজ হেঁটে আসি, তখন মনে হয়, একটা মৃত্যুপুরী। তারপর আস্তে আস্তে ল্যাব বিল্ডিংয়ে রিসার্চারের সংখ্যা কমতে থাকলো। কেউ কেউ রাতের দিকে কাজ করতে শুরু করলো। কেউ খুব ভোরে এসে তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে চলে যাবার চেষ্টা করছে। আসলে যতটা মানুষের সংস্পৰ্শ এড়ানো যায়। আমাদের ল্যাবেরও সেল কালচার বা মাইক্রোস্কোপের ঘর গুলোতে একসাথে এক জনের বেশি এখন ঢোকা বারণ। কারণ ঘরগুলো ছোট। ডিপার্মেন্টাল মিটিংগুলো জুম দিয়ে অনলাইনে করা হচ্ছে। প্রতিটা ল্যাব থেকে দু’জনের নাম নিয়ে রাখা আছে এসেন্সিয়াল পার্সন হিসেবে, যাতে পুরোপুরি বন্ধ করতে হলে অ্যানিম্যাল হাউসের খাঁচায় রাখা ইঁদুরদের দেখাশোনা বা অন্য জরুরি প্রয়োজনে সেই দু’জন আসতে পারেন। আমাদের রিসার্চ করোনা বা সংক্রামক রোগ নিয়ে নয়। যাঁরা এই কাজ করছেন তাদের ল্যাবে এখন দিবারাত্র কাজ হচ্ছে হয়ত। মাঝে পার্সনাল প্রোটেশকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই)-এর যোগান না থাকায় ব্যবহৃত পিপিই কী করে পুনরায় ব্যবহার করা যায় তার পদ্ধতি প্রকাশ করেছে আমাদের ইউনিভার্সিটি। বেশ কিছু অ্যান্টিভাইরাল কম্পাউন্ডের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালও চলছে। আমাদের ইউনিভার্সিটিতেও চলছে। এত দ্রুত বায়োমেডিক্যাল রিসার্চকে আর কখনও প্রোমোট করা হয়নি এর আগে। সায়েন্টিস্টরা পাগলের মত কাজ করছেন। এত চেষ্টার ফল নিশ্চয়ই অতি দ্রুত সামনে আসবে। কিন্তু ততদিনে বড় বেশি প্রাণহানি হয়ে যাবে। এটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।
গত সপ্তাহেও দেখেছি মাস দু’তিনের বাচ্চাকে প্র্যামে নিয়ে মা ওয়ালমার্টে বাজার করছেন। চারটি শিশুকে নিয়ে বাবা-মা ছুটির মুডে বাজার করতে বেরিয়েছেন। শিশুটি সব্জির আইলের ধাতব অংশে হাত ঘষে পরে সেই হাতই মুখে দিচ্ছে। আমি দেখে আতঙ্কিত হয়েছি। মনে মনে চেয়েছি, কেন মানুষের হাঁটাচলা নিয়ন্ত্রণ করা হবে না, যদি তাঁর নিজের দায়িত্বশীলতা না থাকে! কিন্তু এ দেশে সেটি হওয়া সম্ভব নয়। ইটালির খবর শুনে শুনে, হঠাৎ এক দিন ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। তত দিনে বিষয়টার ভয়াবহতা স্পষ্ট বুঝতে পারছি। একটা ইতিহাস তৈরি হচ্ছে, যার চলন্ত কুশীলব আমরা। আমাদের আজকের বর্তমান, আমাদের আজকের চিন্তাভাবনা, আমাদের আজকের আচরণ, আমাদের ভবিষ্যৎ তৈরি করছে। এটা প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতোই গুরুত্বপূর্ণ হবে ভবিষ্যতের পৃথিবীর জন্য। যার বহুমুখী প্রভাব পড়বে প্রতিটি দেশেই। আমাদের আজকের আচরণের ফলে তৈরি হওয়া পরিস্থিতির দায়ভার সেদিন নিতে পারব তো? ভয় পাচ্ছি।
ভারতের লকডাউনের খবর পেয়ে কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছিলাম। যাক আমার বাড়ির লোকের আশেপাশে আসা লোকের সংখ্যা কমবে কিছুটা হলেও। কিছুটা হলেও কমবে তাঁদের অসুস্থ হবার সম্ভাবনা। এখানে কবে মানুষ সচেতন হবে জানি না। গত সপ্তাহে পার্কে অজস্র লোকে নাকি হাঁটতে, দৌড়াতে, গল্ফ খেলতে বেরিয়েছিল। ওমাহা নিউয়র্কের মত জনবহুল নয়। কিন্তু তাতেও ঝুঁকি কিছু কম নয়। নেব্রাস্কার সংখ্যাটা সরকারি ভাবে এখনও চারশোর আশেপাশে। কিন্তু বাড়তে কতক্ষণ? এই ঋতু পরিবর্তনে একটু আধটু গলা খুসখুস করলেই ভয় করছে। সারা পৃথিবীর সাথে সাথে আমরাও আশা নিয়ে আর আতংক নিয়ে বেঁচে আছি এখনও। আর বেঁচে আছি যখন, তখন যে কাজ করার জন্য বাড়ি ছেড়ে এখানে আসা, সে কাজটাই মন দিয়ে করে চলেছি প্রতিদিন। যত দিন সকালে উঠে ল্যাবে আসার সুযোগ পাচ্ছি। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে, মানুষের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে। এ ভাবে ভয়ে ভয়ে থাকতে ভাল লাগছে না। কিন্তু আপাতত এই পথই রয়েছে খোলা। ".....now the priority is different."
এর চাইতে ভাল, এর চাইতে আলোর পথের প্রত্যাশায়।
অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়
ওমাহা, নেব্রাস্কা
ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy