Advertisement
২৮ ডিসেম্বর ২০২৪
Denver

২০২০-তে মানুষের নতুন মন্ত্র সামাজিক দূরত্ব

এই লকডাউন পরিস্থিতিতে পাঠকদের থেকে তাঁদের অবস্থার কথা, তাঁদের চারপাশের অবস্থার কথা জানতে চাইছি আমরা। সেই সূত্রেই নানান ধরনের সমস্যা পাঠকরা লিখে জানাচ্ছেন। পাঠাচ্ছেন অন্যান্য খবরাখবরও। সমস্যায় পড়া মানুষদের কথা সরকার, প্রশাসন, এবং অবশ্যই আমাদের সব পাঠকের সামনে তুলে ধরতে আমরা ম‌‌নোনীত লেখাগুলি প্রকাশ করছি।এই লকডাউন পরিস্থিতিতে পাঠকদের থেকে তাঁদের অবস্থার কথা, তাঁদের চারপাশের অবস্থার কথা জানতে চাইছি আমরা। সেই সূত্রেই নানান ধরনের সমস্যা পাঠকরা লিখে জানাচ্ছেন। পাঠাচ্ছেন অন্যান্য খবরাখবরও। সমস্যায় পড়া মানুষদের কথা সরকার, প্রশাসন, এবং অবশ্যই আমাদের সব পাঠকের সামনে তুলে ধরতে আমরা ম‌‌নোনীত লেখাগুলি প্রকাশ করছি।

লকডাউনে স্তব্ধ ডেনভার।

লকডাউনে স্তব্ধ ডেনভার।

শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২০ ১৯:২৪
Share: Save:

পড়ন্ত বিকেলে এক কফি কাপ হাতে জানলার বাইরে চোখ রাখলাম। চতুর্দিক সাদা। যত দূর চোখ যায় সব বরফে ঢাকা। এখন এপ্রিল। দিন দু’য়েক আগে নতুন বাংলা বছর শুরু হয়েছে। কয়েক দিন আগেও দৈনিক তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর আশেপাশে ছিল। আর এখন শূন্যের থেকে কয়েক ডিগ্রি নীচে। ডেনভার শহরের এটাই বিশেষত্ব। অতি দ্রুত তাপমাত্রার পরিবর্তন হয়। এখানে এপ্রিল, এমনকি মে মাসেও তুষারপাত হয়। আবার ভীষণ তুষার ঝড়ের পর দিনই ঝকঝকে রোদ্দুর।

এক দশকের বেশি সময় ধরে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছি। আগে থাকতাম সান ফ্রান্সিসকোতে। এখন থাকি কলোরাডো রাজ্যের ডেনভার শহরে। আমি আর আমার স্ত্রী চেষ্টা করি প্রতি বছর অন্তত এক বার কলকাতা যেতে। আমাদের বাবা-মা আর নিকটাত্মীয়রা কলকাতা ও তার আশ পাশের এলাকায় থাকেন। এ বছর আমরা তিন সপ্তাহের ছুটিতে দেশে গিয়েছিলাম। ফিরেছি মার্চের মাঝামাঝি। প্রতি বছরই ফেরার পরে কিছু দিন মনমরা হয়ে থাকতাম। সব সময় ভাবতাম, এত তাড়াতাড়ি ছুটি শেষ হয়ে গেল। আমাদের আত্মীয়, বন্ধুরাও বলতো,, ‘‘আর কয়েকটা দিন থাকলে পারতিস।’’ এই বছর প্রথম সেই নিয়ম ভাঙল। ডেনভার ফিরে মনে হল, ভাগ্যিস ফিরে এসেছি। আর কিছু দিন দেরি হলে হয়তো লকডাউনের জন্যে ওখানেই আটকে যেতাম। আত্মীয়-বন্ধুরাও এক বাক্যে বলল, ‘‘তোরা সময় থাকতে ফিরে গেছিস, খুব ভালো করেছিস’’

আমরা ভারত থেকে ফেরার ঠিক পরেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট দেশবাসীকে ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখার আর্জি জানান। তার দিন কয়েকের মধ্যে আমাদের রাজ্যের গভর্নর ‘স্টে অ্যাট হোম’-এর নির্দেশ দেন। গত এক মাস ধরে সারা বিশ্বের মতো আমরাও গৃহবন্দি হয়ে রয়েছি। ইন্টারনেট এর দৌলতে আমি আর আমার স্ত্রী অফিসের কাজ যতটা সম্ভব বাড়ি থেকেই করছি। এর পোশাকি নাম হলো ‘ওয়ার্ক ফ্রমহোম’। আমাদের তিন বছরের ছেলে সারা ক্ষণ দৌরাত্ম্য করে চলেছে। খুব খুশি যে তাকে প্রি স্কুলে যেতে হচ্ছে না। আরও খুশি কারণ ২৪ ঘন্টা মা ও বাবাকে কাছে পাচ্ছে। রকি মাউন্টেন এর কোলে বিরাজমান এই প্রাণবন্ত মাইল হাই সিটি (সমুদ্রতট থেকে এক মাইল উচ্চতায় অবস্থিত ডেনভার শহর) আজ কার্যত সুনসান। কলোরাডো যেমন শীতকালে প্রসিদ্ধ স্কি তথা অন্যান্য উইন্টার স্পোর্টসের জন্য। তেমনি গ্রীষ্মকালে বিখ্যাত হাইকিং, রক ক্লাইম্বিং ইত্যাদি সামার অ্যাক্টিভিটির জন্যে। প্রতি বছর দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অ্যাডভেঞ্চার প্রেমীরা এখানে জমায়েত করেন। কিন্তু আজ সবকিছু স্তব্ধ। কোভিড -১৯' নামক অদৃশ্য শত্রুর মোকাবিলা করতে সবাই স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি। আর তাই চেরি ক্রিক স্টেট পার্ক হোক অথবা রকি মাউন্টেন ন্যাশনাল পার্ক, সবই খাঁ খাঁ করছে।

ডেনভারের দৃশ্য।

খুব দরকার না হলে আমরাও বাড়ি থেকে বেরচ্ছি না। বেশিরভাগ জিনিসপত্র কেনাকাটা করছি অনলাইনে। ওষুধ, সবজি, ডিম, দুধ, প্যাকেটজাত মাছ, মাংস ছাড়াও যাবতীয় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র অনলাইনে কেনা যাচ্ছে। তবে সার্জিক্যাল মাস্ক, টয়লেট পেপার, হ্যান্ড স্যানিটাইজার নয়। তবে আগের থেকে বেশি সময় লাগছে সে গুলি বাড়িতে আসতে। বেশিরভাগ ডিপার্টমেন্টাল গ্রোসারি স্টোর (এককথায় বিশালাকায় মুদির দোকান) অবশ্য খোলা আছে। প্রয়োজন মতো সেখান থেকে আমরা ‘কার্ব সাইড পিক আপ’ করে নিচ্ছি। এ ক্ষেত্রে অনলাইনে অর্ডার ও পেমেন্ট করে, গ্রাহককে নির্দিষ্ট সময় দোকানের সামনে গাড়ি নিয়ে আসতে হয়। দোকানদার গাড়িতে জিনিসপত্র তুলে দেন। বেশিরভাগ রেস্তোরাঁ বন্ধ। তবে ফাস্ট ফুডের দোকান খোলা আছে। কখনও বাইরের খাবার খেতে ইচ্ছে করলে, ফাস্টফুডের দোকান থেকে drive-through করে নিচ্ছি। সেটা হল এক বিশেষ ধরনের পরিষেবা, যার মাধ্যমে ক্রেতা গাড়ি থেকে না নেমেই যে কোনও পণ্য কিনতে পারেন। গাড়িতে বসেই অর্ডার দেওয়া, পেমেন্ট করা আর ডেলিভারি নেওয়া যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই ধরনের পরিষেবা খুব জনপ্রিয়।

আমাদের এখানে গ্রোসারি স্টোর খোলা থাকলেও, অন্যান্য দোকানপাট বন্ধ। বিশেষতঃ যেখানে অনলাইন বিক্রয়ের সুযোগ কম। বরং ফুট ট্রাফিক অর্থাৎ পদাতিক ক্রেতার আনাগোনা বেশি। শপিং মল, মুভি থিয়েটার, কফি শপ, জিম, সুইমিং পুল, স্পা, বিউটি পার্লার সব কিছুই সাম্প্রতিককালে তালাবন্ধ। বেশিরভাগ হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য কেন্দ্র রোগীদের অনুরোধ করেছে, খুব জরুরি না হলে অনলাইন বা ফোন কন্সালটেন্সি ব্যাবহার করতে। উদ্দেশ্য একটাই, '‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রেখে পরিষেবা প্রদান করা। একথা বলাই বাহুল্য যেসব হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা হচ্ছে সেখানে ডাক্তার, নার্স আর বাকি স্বাস্থ্য কর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন।

এ ভাবে কতদিন চলবে জানি না। ফেডারেল এবং স্টেট গভর্নমেন্ট ডাক্তার আর বিজ্ঞানীদের সাথে নিয়মিত আলোচনা করে চলেছে , কী ভাবে এই বিধিনিষেধ শিথিল করা যায়। কিছু অর্থনীতিবিদের মতে, ব্যবস্যা বাণিজ্য পুনরায় খুলতে বেশি দেরি করলে খুব বড় ধরনের আর্থিক মন্দা আসতে চলেছে। সেটা ২০০৮-০৯-এর মন্দাকেও হার মানাতে পারে। ইন্টারন্যাশনাল মানিটরি ফান্ড ইতিমধ্যেই ২০২০-তে সম্ভাব্য আর্থিক মন্দাকে ‘দ্য গ্রেট লকডাউন’ নামে অভিহিত করেছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, গত এক মাসে আমেরিকাতে ২ কোটির বেশি মানুষ জীবিকা হারিয়েছে। এই নিয়ে সম্প্রতি জনমানসে কিছু অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে। আমেরিকার বেশ কিছু শহরে মানুষ বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। তাঁদের মতে এই লকডাউন মানুষের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের সামিল। কিন্তু এ দেশের পরিস্থিতি এখনও বেশ খারাপ। সারা দেশে প্রতিদিন কয়েক হাজার নতুন সংক্রমণ ধরা পড়ছে। দেশের সর্বোচ্চ পদের ডাক্তাররা জানাচ্ছেন, সব কিছু স্বাভাবিক হতে আরও সময় লাগবে। শুধু তাই নয়, পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে বছর গড়িয়ে যেতে পারে। দেশের বহু মানুষ ভয়ে আছেন যে, খুব দ্রুত ব্যবসা বাণিজ্য চালু হয়ে গেলে করোনার ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ আসতে পারে। তখন হয়তো আবার নতুন করে লকডাউন শুরু হবে। আরও বহু মানুষ প্রাণ হারাবে।

ভাবতে অবাক লাগে এ কোন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা। ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি, মানুষ সামাজিক জীব। আর আজকে আমরা বাধ্য হচ্ছি মানুষের থেকে দূরে থাকতে। হাত মেলানো বা আলিঙ্গন করা দূরে থাক, অচেনা লোকের সংস্পর্শে আসতেও আমরা সঙ্কোচ বোধ করছি। ট্রেন, বাস এমনকি লিফ্টে কোনও অপরিচিত লোক খুব কাছাকাছি এলে কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। এত দিন যা অকল্পনীয় ছিল, দুর্ভাগ্যবশত আজকে সেটাই সত্যি! ২০২০-তে মানুষের বেঁচে থাকার নতুন মন্ত্র ‘সামাজিক দূরত্ব’। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজের, আত্মীয় এবং গোটা সমাজের সুরক্ষায় আমাদের অন্তত আরও কিছু দিন সামাজিকতা ভুলে থাকতে হবে। এত কিছুর পরেও কিন্তু আমি আশাবাদী। এই অসময় অচিরেই কেটে যাবে। তবে পরিস্থিতি ভাল হওয়ার আগে, আরও খারাপ হতে পারে। এই কঠিন সমস্যা খুব তাড়াতাড়ি মেটার নয়। তাই আমাদের আরও কিছু দিন ধৈৰ্য্য ধরে রাখতে হবে। ঘরে বন্দি থেকেই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে অদৃশ্য প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে। আমি নিশ্চিত, সময় যতই লাগুক, বরাবরের মতো মানুষ এবারও জয়ী হবে। শেষ করছি দিন-দুয়েক আগে লেখা কবিতার কয়েকটি পংক্তি দিয়ে।

স্তব্ধ হয়েছে সারা পৃথিবী, এই অসময়ে থেমেছে প্রগতি।
এখনই খুঁজো না অন্তিম মার্গ, এখনই ভেবো না কবে নিষ্কৃতি।
তুমি নও একা এই যুদ্ধে, দুনিয়া ঢেকেছে এক কালো মেঘে।
যতই আসুক অশুভ সময়, অবিচল থেকো নিজের লক্ষ্যে।


রজত শুভ্র দত্ত
ডেনভার, কলোরাডো, আমেরিকা

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

অন্য বিষয়গুলি:

Denver Colorado America Coronavirus Covid 19
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy