Advertisement
২৬ অক্টোবর ২০২৪
Communal Discrimination

সম্পাদক সমীপেষু: বিভেদের পশ্চাতে

শাসক দল বিজেপি ভেবেছিল রামমন্দির ভোট বৈতরণি পার করে দেবে। সে কারণে শঙ্করাচার্যদের আপত্তিকে উপেক্ষা করে অসমাপ্ত রামমন্দিরের উদ্বোধন হল।

শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০২৪ ০৬:৫৩
Share: Save:

“যা হচ্ছে, ঠিক হচ্ছে’?” শীর্ষক প্রবন্ধে (১৩-৫) ঈশানী দত্ত রায় ধর্মের নামে বিষ যে ভাবে ভারতকে আত্মহননের পথে নিয়ে যাচ্ছে, তার একটা পূর্ণাঙ্গ চিত্র আঁকার চেষ্টা করেছেন। তিনি যথার্থই বলেছেন— আমরা ভিতরে ভিতরে সাম্প্রদায়িক নিশ্চয়ই ছিলাম, এখন জল-বাতাস পেয়ে ফনফন করে বেড়ে উঠেছি। অর্থাৎ, মাটি প্রস্তুতই ছিল। সেই মাটিতে ভোটসর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলো ফসল ফলিয়ে মুনাফা তুলছে। এই মাটি কী ভাবে প্রস্তুত হল, তার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। তবে আমাদের দেশ পুঁজিবাদী, আর এই পুঁজিবাদ বিশ্বব্যাপী ক্ষয়িষ্ণু। এই ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদ বিভেদমূলক মানসিকতার জন্ম দেয়। সাম্প্রদায়িকতা, গোষ্ঠীগত বিদ্বেষ, প্রাদেশিকতা প্রভৃতির মাধ্যমে জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মারাত্মক প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। অপর দিকে, যে সব দেশে সমাজের গণতন্ত্রীকরণ অসম্পূর্ণ রয়েছে, সেই সব দেশে এর তীব্রতা আরও বেশি। আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব গণতন্ত্রীকরণের এই কাজটিকে অবহেলা করেছে, তাই এখানে সাম্প্রদায়িকতার মাটি উর্বর। এই মাটিকে কাজে লাগিয়েই এই ব্যবস্থার সেবক বা সেবা করতে প্রস্তুত এমন সমস্ত রাজনৈতিক দল সাম্প্রদায়িকতাকে হাতিয়ার করে তাদের স্বার্থ সিদ্ধ করতে চায়। এর বিপজ্জনক দিকগুলির কথা মাথায় রেখে সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে সমাজের বুকে সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী মানসিকতা গড়ে তোলার ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে।

শাসক দল বিজেপি ভেবেছিল রামমন্দির ভোট বৈতরণি পার করে দেবে। সে কারণে শঙ্করাচার্যদের আপত্তিকে উপেক্ষা করে অসমাপ্ত রামমন্দিরের উদ্বোধন হল। কিন্তু ভোটের পালে তেমন হাওয়া ধরল কই! সাত ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির ফলাও প্রচারও সাধারণ মানুষকে তেমন আকর্ষণ করছে না। ‘সব কা সাথ/ সব কা বিকাশ’— এমন সব স্লোগানও আমজনতার কাছে এখন তেমন আকর্ষণীয় নয়। মূল্যবৃদ্ধি, বেকার সমস্যার মতো বিষয় স্বাভাবিক কারণেই সামনে চলে আসছে। তাই এখন ‘মোদী কি গারন্টী’ নিয়ে বিপুল অর্থ ব্যয়ে রকমারি প্রচারের হুল্লোড় চলছে। কিন্তু তাতেও বাজার জমছে না। মানুষের দৃঢ় ধারণা ‘অচ্ছে দিন’-এর মতো এও এক সময় জুমলার বহরকে বাড়িয়ে তুলবে। এই গ্যারান্টি এ দেশের পুঁজিপতি শ্রেণির সম্পদ বাড়ানোর গ্যারান্টি, যা দেশের আমজনতাকে শোষণের মধ্য দিয়েই সম্ভব। তাই তো সাম্প্রদায়িক জমির উপর ভরসা করে তাঁদের বলতে হয়, কংগ্রেস ক্ষমতা হাতে পেলে মানুষের সম্পত্তি তুলে দেবে ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ হাতে, তুলে দেবে তাদের হাতে যাদের সন্তান সংখ্যা বেশি। মা-বোনেদের মঙ্গলসূত্রও নাকি বেহাত হয়ে যাবে। এমন বিদ্বেষ-বিষই বিজেপির ভোট বৈতরণি পার হওয়ার বর্তমান ভরসা।

যে দেশ বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১২৫টি দেশের মধ্যে ১১১তম স্থানে নেমে গেছে, যে দেশের ২০ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ প্রতি দিন ক্ষুধা নিয়ে বিছানায় যায়, সেখানে মন্দির নিয়ে, রামনবমী উৎসব উদ্‌যাপনের উন্মাদনার কারণ বুঝে নিতে হবে। এর বিরুদ্ধে এগিয়ে আসতে হবে সমস্ত গণতন্ত্রপ্রিয়, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে।

গৌরীশঙ্কর দাস, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

মিথ্যা দুর্নাম

ঈশানী দত্ত রায়ের প্রবন্ধের সঙ্গে একেবারেই একমত নই। লেখাটি পড়ে মনে হচ্ছে, যে ‘ধর্মের নামে বিষ, আত্মঘাতী ভারতের’ কথা তিনি বলছেন, সেটা দশ বছরে নতুন করে হয়েছে। তার আগে ধর্মীয় মেরুকরণ বা রাজনীতি ভারতে ছিল না। এ দেশ ভাগ হয়েছে ধর্মের নামে, ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’-এর মতো বিপুল হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের গণহত্যা এবং ভিটেছাড়া করা হয়েছে। স্বাধীনতার পরে ষাট বছর ধরে রাজনীতির নামে রাজনৈতিক দলদের ধর্ম-ব্যবসা চলেছে। এ সবই যেন চোখ এড়িয়ে গিয়েছে তাঁর।

প্রবন্ধকারের উল্লিখিত ‘ছবিতে রামায়ণ/মহাভারত’ আমরাও পড়েছি। ১৫-২০ পাতার সেই বইকে তিনি নিশ্চয়ই রামায়ণ শিক্ষা বা মহাভারত শিক্ষার মতো গুরুগম্ভীর বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেননি। তাঁর লেখায় ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে বাইবেলকে নেওয়া বা খ্রিস্টীয় গানের কথার উল্লেখ পেলাম। জানার ইচ্ছে রইল, তাঁর ছাত্রাবস্থায়, বা আজকের ভারতে, কোন কোন শ্যামাসঙ্গীত, শৈব সঙ্গীত বা বৈষ্ণব সঙ্গীতকে ঐচ্ছিক হিসেবে পড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে? গীতা, উপনিষদ বা রামায়ণ মহাভারতকেও ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে কোনও স্কুলের পাঠ্যক্রমে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে? মাদ্রাসা বোর্ড বা খ্রিস্টান মিশনারি শিক্ষাব্যবস্থা ভারতে প্রচলিত রয়েছে বহু কাল। হিন্দু শিক্ষার প্রচলনের জন্য শেষ দশ বছরে কী শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়েছে?

হিন্দু মন্দিরই একমাত্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, যাকে তার হিসাব-নিকেশের খাতা প্রত্যেক বছর অডিট করাতে হয় এবং সরকারকে মোটা টাকা ট্যাক্স দিতে হয়। বাকি কোনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে সেই করের আওতায় পড়তে হয় না। তার পরেও প্রবন্ধকারের মনে হয়েছে হিন্দু ব্যতীত বাকি সবাইকে কেন্দ্রীয় সরকার পায়ের তলায় রাখার চেষ্টা করছে।

প্রবন্ধকারের বক্তব্য, ধর্মের অছিলায় উন্নয়নের বিভিন্ন দিককে নাকি অপ্রধান করে দেওয়া হয়েছে। আমার প্রশ্ন, অতীতের বিভিন্ন দলের সরকার এত বছর ক্ষমতায় থাকা এবং আদর্শ পদ্ধতিতে সরকার চালানো সত্ত্বেও নির্বাচনের একই অ্যাজেন্ডা কেন থাকে? আমি আমার ৪২ বছরের জীবনে, যবে থেকে ‘ভোট উৎসব’ দেখছি, ভোটের অ্যাজেন্ডা এক চুলও এ দিক-ও দিক হয়নি। সেই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, সার্বিক উন্নতি এবং রোটি-কাপড়া-মকান। মানে প্রতি বারই এ সবের উন্নতির দাবি করা হয়, কিন্তু বাস্তবে কাজ হয় না। অথচ, দুর্নাম হচ্ছে বর্তমান শাসক দলেরই!

যে দেশ অতিমারির প্রবল ধাক্কা সামলেও তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ থেকে পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়, তার ধার্মিক উন্মাদনায় যদি ‘রিলিজিয়াস টুরিজ়ম’-এর মতো ক্ষেত্র এক বছরে ২৮-৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, এবং তাতে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়, তা হলে সেই ধর্মীয় উন্মাদনার কারণে খুব ক্ষতি বোধ হয় এই দেশের নেই, যদি না অন্য কারও সঙ্গে স্বার্থের সংঘাত লাগে।

সৌমাভ ভট্ট, কৃষ্ণনগর, নদিয়া

পুরুষের দেশ

“‘যা হচ্ছে, ঠিক হচ্ছে’?” প্রবন্ধে লেখক ধর্মীয়, জাতিগত ভেদাভেদ ছাড়াও সমাজে “ধনী, দরিদ্র, শাসক, বিরোধী, নিরামিষাশী, আমিষভোজী” ইত্যাকার অমানবিক ভাগাভাগির কথা উল্লেখ করেছেন। এই প্রসঙ্গে নারী-পুরুষ বিভাজনের কথাও উল্লেখ করা দরকার। বাপ-ভাই নয়, শুধুমাত্র মা-বোনেদের ইজ্জত রক্ষার কথা ভেবে মন্ত্রী, নেতা, নাগরিক সমাজ প্রায়শই যে সরব হয়ে ওঠে, এর কারণ কী? কারণ, ধরেই নেওয়া হয় যে পুরুষদেহ নয়, নারীদেহের শুচিতাই রক্ষণীয়। তাই ‘পরপুরুষ’ কোনও মেয়ের গায়ে হাত দিয়েছে, এই অজুহাতে রাজ্য তথা দেশ জুড়ে লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে দেওয়া যায়। নারীদেহ ঘিরে এই যে সংস্কার, তা নারীকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে। প্রশ্ন হল, শরীর ঘিরে নারী-পুরুষের মধ্যেকার এই বৈষম্যের কারণ পুরুষতন্ত্র। এ হল এক আরোপিত শুদ্ধাচার, যা নারীকে সমাজের চোখে দেবীতুল্য করে তুলতে চায়। অপর দিকে নারীকে ভোগ্যবস্তু করে রাখার যে কৌশল, তাতেও নারীকেই অবর্ণনীয় লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়। জীবনানন্দ দাশের ‘সুখের শরীর’ গল্পে মেজোখুড়িমাকে বলতে শুনি:“...নিজেকে একটা রাতের জন্য শুধু কনে মনে করেছিলাম, তারপর থেকেই দাসী হয়ে আছি।” এক দিকে দেবী, অপর দিকে ভোগ্যা— নারীকে ঘিরে এই বৈপরীত্যই সমাজে বহাল। নারীর অধিকার নিয়ে বাগাড়ম্বর যাই থাক, নারী দুর্বল, পুরুষ সবল— এই অজুহাতে দেশটাকে কমবেশি পুরুষদের দেশ বানিয়ে রাখার এও এক মতলবই বটে।

শিবাশিস দত্ত, কলকাতা-৮৪

অন্য বিষয়গুলি:

Post Editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE