Advertisement
১৮ ডিসেম্বর ২০২৪

সম্পাদক সমীপেষু: দ্বারকানাথ বিষয়ে

রামলোচন বর্ণময় চরিত্র। বাবু কালচারের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। তাঁরই আমলে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে কবিগান, বাইনাচ ইত্যাদি শুরু হয়। তিনিই কলকাতায় বিকেলে গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে বেরোনোর প্রথা চালু করেন। 

শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

সোনালী দত্তের ‘একাই ছিলেন অনেক’ (১৮-৮) শীর্ষক নিবন্ধে বলা হয়েছে, নীলমণি ঠাকুরের ‘‘নিজের সন্তান ছিল না বলে ভাই রামমণির ছেলে দ্বারকানাথকে দত্তক নিয়েছিলেন তিনি।’’ তা ভুল। নীলমণি ঠাকুরের চার জন সন্তান ছিলেন, তিন ছেলে আর এক মেয়ে। তাঁর বড় ছেলে রামলোচন ঠাকুর অপুত্রক ছিলেন, তাই তিনি (রামলোচন) তাঁর ভাই রামমণির ছেলে দ্বারকানাথকে দত্তক নিয়েছিলেন। সুতরাং, দ্বারকানাথের পালক পিতা ছিলেন রামলোচন, নীলমণি নন।

রামলোচন বর্ণময় চরিত্র। বাবু কালচারের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। তাঁরই আমলে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে কবিগান, বাইনাচ ইত্যাদি শুরু হয়। তিনিই কলকাতায় বিকেলে গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে বেরোনোর প্রথা চালু করেন।

লেখিকা লিখেছেন, দ্বারকানাথকে অনেকেই চেনেন ‘ব্রাহ্ম আন্দোলন’-এর অন্যতম মুখ হিসেবে। রামমোহন রায়ের ব্রাহ্ম আন্দোলনের প্রতি দ্বারকানাথের সমর্থন ছিল ঠিকই, এও ঠিক যে রামমোহনের মৃত্যুর পর তিনি ব্রাহ্ম সমাজকে পোষণ করেছিলেন, কিন্তু দ্বারকানাথ নিজে ছিলেন নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব ব্রাহ্মণ। এমনকি বিলেতের হোটেলে গিয়েও তিনি ঘরে গঙ্গামাটির প্রলেপ লাগিয়ে ইষ্টমন্ত্র জপ করতেন, যা জানিয়ে গিয়েছেন তাঁর জীবনীকার ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

লেখিকা বলেছেন, একের পর এক জমিদারি কিনেছিলেন দ্বারকানাথ, ‘‘রাজশাহি, শাহজাদপুর, বহরমপুর, পাণ্ডুয়া ইত্যাদি’’, আর তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর ‘‘জীবনের অনিত্যতা বুঝেছিলেন বলে’’ দ্বারকানাথ তাঁর এই সব জমিদারি উত্তরাধিকারীদের ট্রাস্ট করে দেন। প্রকৃতপক্ষে দ্বারকানাথ তাঁর উত্তরাধিকারীদের জন্যে চারটি জমিদারি ট্রাস্ট করে দেন: বিরাহিমপুর, শাহজাদপুর, তৎকালীন রাজশাহি জেলার পতিসর এবং ওড়িশার কটকের অন্তর্গত পাণ্ডুয়া এবং বালিয়া। লেখিকা সম্ভবত বিরাহিমপুরকেই ভুল করে বহরমপুর লিখেছেন, এ জমিদারি দ্বারকানাথের কেনা নয়, এটি কিনেছিলেন রামলোচন। ঠিক তেমনই, ওড়িশার জমিদারিও দ্বারকানাথের কেনা নয়, সেটি কিনেছিলেন নীলমণি।

এ ছাড়া, তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর ‘জীবনের অনিত্যতা’ বুঝে দ্বারকানাথ এই ট্রাস্ট করেছিলেন, এ ব্যাখ্যাও সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। দ্বারকানাথের বড় ছেলে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ লিখে গিয়েছেন, দ্বারকানাথ তাঁর তীক্ষ্ণ বৈষয়িক বুদ্ধি দিয়ে বুঝেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলেরা এই বিশাল সম্পত্তি রক্ষা করতে পারবেন না, আর তাই এই ট্রাস্ট ডিড তৈরি করেছিলেন। যাতে সর্বস্ব চলে গেলেও, অন্তত এই চারটি জমিদারি রক্ষা পায়। দ্বারকানাথ যে কত সঠিক কাজ করেছিলেন তা বোঝা গিয়েছিল তাঁর মৃত্যুর পর, যখন তাঁর সব ব্যবসা অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায়, পাওনাদারদের ভিড় বাড়তে থাকে, কিন্তু ট্রাস্ট করা ছিল বলে পাওনাদারদের হাত থেকে ওই চারটি জমিদারি রক্ষা পায়।

সন্দীপন সেন

কলকাতা-৫

মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া

‘একাই ছিলেন অনেক’ শীর্ষক নিবন্ধে সোনালী দত্ত লিখেছেন দ্বারকানাথ ঠাকুর সম্পর্কে, ‘‘তবু সব কিছু ছাপিয়ে এই ‘ঠাকুর’-এর আসল পরিচয় এমন এক কর্মযোগী হিসেবে, যিনি বাণিজ্য এবং ক্ষমতার খেলায় ব্রিটিশকে সমানে সমানে টক্কর দিয়েছেন জীবনের শুরু থেকেই।’’ এ বিষয়ে ভিন্ন মতের অবকাশ আছে।

বৈদেশিক সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির সঙ্গে সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে পরাধীন ভারতবর্ষে ভারতীয় উদ্যোগপতিরা দুই ভাগে বিভক্ত ছিলেন— ন্যাশনাল বা জাতীয় বুর্জোয়া এবং কমপ্রাদর বা মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া। পরাধীন ভারতবর্ষে পুঁজির ধ্রুপদী বিকাশ হয়নি, এ দেশে পুঁজিবাদ গড়ে উঠেছিল বিদেশে পুঁজির বিকাশের অভিঘাতে। জাতীয় বুর্জোয়া গোষ্ঠী চেয়েছিলেন, সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির উপর নির্ভর না করে ভারতবর্ষে পুঁজির স্বাধীন বিকাশ। এঁদের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের ছিল শত্রুভাবাপন্ন অন্তর্বিরোধ। কিন্তু মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ারা সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির এজেন্ট হিসেবে কাজ করতেন, সাম্রাজ্যবাদের বিকাশের সঙ্গে এঁদের স্বার্থ ছিল অঙ্গাঙ্গি। এঁরা ছিলেন একান্ত ভাবেই বৈদেশিক পুঁজির উপর নির্ভরশীল। দ্বারকানাথ এই কমপ্রাদর বুর্জোয়াদেরই অন্যতম প্রতিনিধি। আবার প্রফুল্লচন্দ্র রায় (বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কসের প্রতিষ্ঠাতা), বি ডি আমিন (অ্যালেম্বিক কেমিক্যালস), নরেন্দ্রনাথ দত্ত (বেঙ্গল ইমিউনিটি), আলামোহন দাস (ইন্ডিয়ান মেশিনারি) চেয়েছিলেন বৈদেশিক পুঁজির উপর নির্ভরশীলতা ত্যাগ করে পুঁজির স্বাধীন বিকাশ। এঁরা ন্যাশনাল বুর্জোয়া গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এ বিষয়ে সুনীতি কুমার ঘোষের ‘দি ইন্ডিয়ান বিগ বুর্জোয়া’ একটি আকর গ্রন্থ।

ন্যাশনাল এবং কমপ্রাদর বুর্জোয়ার পার্থক্য খুব স্পষ্ট হয়ে যায়, যদি আমরা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত জাহাজ কোম্পানি (ইনল্যান্ড রিভার স্টিম নেভিগেশন সার্ভিস) এবং দ্বারকানাথ ঠাকুরের ‘কার, টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি’র তুলনামূলক বিশ্লেষণ করি। ব্রিটিশ পুঁজি নিয়ন্ত্রিত ফ্লোটিলা কোম্পানির সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ভারতীয় উদ্যোগটি ভেঙে পড়ে। ফ্লোটিলা তাদের ভাড়ার হার এতটাই কমিয়ে দেয়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সংস্থা পাল্লা টানতে পারেনি। তা ছাড়া বিড়লার (আর এক জন কমপ্রাদর বুর্জোয়া) মালিকানাধীন পাটের কলগুলি স্বাধীন ভারতীয় শিল্পোদ্যোগীদের জাহাজে বাহিত মালপত্র কিনতে অস্বীকার করে। কিন্তু ব্রিটিশ পুঁজির সহযোগিতায় তৈরি ‘কার, টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি’র উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল। কারণ খুব স্পষ্ট। পরাধীন দেশে বিদেশি শাসক হিসেবে ভারতে পুঁজিবাদের বিকাশকে অবদমিত করাও ছিল ইংরেজের স্বার্থসিদ্ধির অনুকূল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, চিনে আফিম রফতানিতে দ্বারকানাথের এই কোম্পানির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। ১৮৪৮-এ সংস্থাটির পতন হয়।

দ্বারকানাথ একা ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক স্থাপন করেননি। এটি ছিল বৃহত্তম ব্রিটিশ ভারতীয় ব্যাঙ্কিং উদ্যোগ। ব্রিটিশ পুঁজি নিয়ন্ত্রিত এই ব্যাঙ্কের আট জন ডিরেক্টর ছিলেন ইউরোপিয়ান এবং চার জন ভারতীয় ডিরেক্টরের মধ্যে ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং রুস্তমজি কাওয়াসজি। দুর্নীতি এবং ফাটকাবাজির কারণে ১৮২৯-এ প্রতিষ্ঠিত এই ব্যাঙ্কে ১৮৪৮-এ লালবাতি জ্বলে। ব্লেয়ার বি ক্লিং-এর ‘পার্টনার্স ইন এম্পায়ার: দ্বারকানাথ টেগোর অ্যান্ড দি এজ অব এম্পায়ার ইন ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’ বইতে আছে, কী ভাবে এই ব্যাঙ্ক ঘৃণ্য নীলকরদের আর্থিক সহায়তা দিত (আ জায়ান্ট স্যাটেলাইট অব দি ইন্ডিগো এক্সপোর্টিং এজেন্সি হাউসেস)। ইউরোপীয় পুঁজি নিয়ন্ত্রিত কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কেরও অন্যতম ডিরেক্টর ছিলেন দ্বারকানাথ। সুতরাং সাম্রাজ্যবাদী শাসকের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিতেন দ্বারকানাথ— এ কথা অতিশয়োক্তি দোষে দুষ্ট।

বরং উল্টোটাই সত্য। তিনি ছিলেন ভারতে ব্রিটিশ শাসনের একনিষ্ঠ সমর্থক এবং বশংবদ ভক্ত। ১৮৪২ সালে তাঁর সম্মানে লন্ডনের লর্ড মেয়রের দেওয়া ভোজসভায় বলেন ‘‘ইংল্যান্ড ক্লাইভ এবং কর্নওয়ালিসকে পাঠিয়েছে যাতে তাঁদের সুপরামর্শ এবং অস্ত্রের দ্বারা ভারতের উপকার হয়। এই দেশে মুসলমানদের অত্যাচার এবং অপশাসন থেকে ভারতবর্ষকে রক্ষা করেছে। এটা করা হয়েছে কোনও প্রতিদানের আশা না করেই, শুধুমাত্র ভাল কাজ করার আকাঙ্ক্ষা থেকে।’’ (লন্ডন মেল, ৪ অগস্ট ১৮৪২)। হ্যাঁ, বলেছিলেন চোস্ত ইংরেজিতেই। সাধে কি আর রানি ভিক্টোরিয়া তাঁকে চমৎকার, বুদ্ধিমান মানুষ বলেন? দ্বারকানাথ আরও বলেছিলেন, ‘‘দ্য হ্যাপিনেস অব ইন্ডিয়া ইজ় বেস্ট সিকিয়র্ড বাই হার কানেকশন উইথ ইংল্যান্ড।’’ চরম অত্যাচারী নীলকরদের পক্ষেও সওয়াল করে দ্বারকানাথ বলেন, নীলকররা কৃষক ও জমিদারদের অনেক উপকার করেছে। যে ক্লাইভকে মার্ক্স বলেছিলেন, ‘দ্যাট গ্রেট রবার’, তাঁকে বাক্‌চাতুর্যে ভারতবন্ধু বানিয়ে দেন দ্বারকানাথ।

সাধে কি আর রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, পূর্বপুরুষদের সঙ্গে তাঁর ব্যবধানটা ‘‘কেবল কালের দূরত্বের দিক দিয়া নহে, গুণের গুরুত্বের দিক হইতেও দুর্লঙ্ঘ্য?’’

শিবাজী ভাদুড়ী

সাঁতরাগাছি, হাওড়া

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

অন্য বিষয়গুলি:

Dwarkanath Tagore Nilmoni Tagore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy