‘স্বাধীনতার দিনরাত্রি’ (১৮-৮) শীর্ষক প্রবন্ধে অনুরাধা রায় খুব তাৎপর্যপূর্ণ ভাবেই উল্লেখ করেছেন যে, একটা রাষ্ট্র স্বাধীনতা পেলেও দেশের ক’জন তার স্বাদ পায়! সাধারণ মানুষের ব্যক্তিজীবনের অনেকটাই আজ নিয়ন্ত্রিত হয় দলীয় রাজনীতির ছত্রছায়ায়। সেই হিসাবে রাজনৈতিক নেতাদের অঙ্গুলিহেলনে নাগরিকের অধিকার আজ বিপন্ন। আশার কথা এই যে, গণতন্ত্রকে ঢাল করে যে ঢালাও লাঞ্ছনা, সেটা সইতে সইতে মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের আগুনের বহিঃপ্রকাশ আজ ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। প্রতিবেশী বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের এই ক্ষোভের আগুনই সে দেশে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করেছে সম্প্রতি। আর জি কর কাণ্ডকে সামনে রেখে যে ভাবে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে সমাজের প্রতিটি স্তরেই, সেটা আমাদের রাজ্য সরকারের কাছে অশনিসঙ্কেত।
জোর করে নিজস্ব মতামত মানুষকে মানতে বাধ্য করা যায় কিছু দিনের জন্য, চিরকালের জন্য নয়। নিজের ভাললাগা নিয়ে নিজের আনন্দে বাঁচার স্বাধীনতার স্বাদ প্রতিটি মানুষই পেতে চায়। তাতে অনেক সময়ই দেখা যায় প্রতিযোগিতায় পরাজয়ের গ্লানিকে উপেক্ষা করেও মানবিকতার স্বাধীনতা হয়ে ওঠে মুখ্য। যে ভাবে প্যারিস অলিম্পিক্সে রুপোজয়ী নীরজ চোপড়ার মা পাকিস্তানের সোনাজয়ী আরশাদ নাদিমকে নিজের ছেলের সঙ্গেই একাসনে বসিয়েছেন, সেই প্রসঙ্গ চমৎকার ভাবে উত্থাপন করা হয়েছে এই প্রবন্ধে। দাঙ্গাপীড়িত অঞ্চলে হিন্দু বাড়িতে মুসলমান পরিবারকে আশ্রয় দেওয়া কিংবা সম্প্রতি হিন্দুদের ধর্মীয় স্থানে হামলা রুখতে মুসলমান সম্প্রদায়ের রাত জেগে হিন্দুদের মন্দির পাহারা দেওয়ার মধ্যেই নিহিত আছে এক মানবিক স্বাধীনতার দায়িত্ববোধ। ডুরান্ড কাপে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের ডার্বি বাতিলের প্রতিবাদে চির প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের সমর্থকদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিবাদ প্রমাণ করে অনৈতিকতার বিরুদ্ধে সকলের এক হয়ে থাকার স্বাধীনতা অনেক অসাধ্য সাধন করতে পারে। সরকারের যেমন স্বাধীনতা আছে সরকারি অর্থ দুর্গাপুজো কমিটিকে অনুদান হিসাবে দেওয়ার, তেমন পুজো কমিটিগুলোরও স্বাধীন ভাবে ভাবা উচিত নারীর লাঞ্ছনার প্রতিবাদে মায়ের পুজোর জন্য এই অনুদান নেওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত।
রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের যত দূর সম্ভব ‘নাইট ডিউটি’ থেকে বিরত থাকার বার্তা দিয়ে নারীদের সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা আসলে নারীদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ এবং আরও পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে যাওয়া। এ যেন চোরকে না ধরতে পেরে মানুষকে দরজায় খিল দিয়ে বসে থাকার নিদান। তাই স্বাধীনতা এমন হওয়া উচিত, যেখানে দিন আর রাত বলে আলাদা কিছু থাকবে না। যেখানে মানুষকে কখনওই বলতে না হয়, ‘এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার’, অথবা নিজেদের সুরক্ষার দাবিতে নারীকে যেন পথে নামতে না হয় ‘রাত দখল’-এর আহ্বানে।
অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি
সত্যিই স্বাধীন?
‘স্বাধীনতার দিনরাত্রি’ প্রবন্ধের সঙ্গে সহমত পোষণ করছি। প্রবন্ধকার লিখেছেন, স্বাধীনতার মুহূর্ত এমনই ক্ষণস্থায়ী? এর প্রধান কারণ শাসকশ্রেণির আধিপত্য বিস্তার করতে চাওয়া এবং আগ্রাসী মনোভাব। যেমন, লেনিনবাদ, মার্ক্সবাদের মতো বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সেখানকার জনসাধারণ মুজিববাদে দীক্ষিত হয়ে উঠছিলেন। এর প্রতিবাদে রাতারাতি বিরোধী দল গড়ে উঠেছিল। যেখানে সত্তরের দশকে স্বাধীনতা লাভের জন্য বঙ্গবন্ধুর ডাকে দল মত নির্বিশেষে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেখানেই স্বাধীন বাংলাদেশে সেনাবাহিনী শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। অর্থাৎ, স্বাধীনতার মূল অর্থ থেকে সরে গেলেই অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। ক্ষমতা লাভের পর যখন শাসকেরা পরিকল্পিত ভাবে ভুলিয়ে দিতে চাইছেন মানুষের সহাবস্থানের মাহাত্ম্য এবং ভালবাসার সংস্কৃতি— তখন সমস্ত জনসাধারণ তো বিদ্রোহ করবেই। আর এই বিদ্রোহের আগুনেই জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায় ক্ষমতার দম্ভ।
আমরা অর্থ-যশ-প্রতিপত্তি অর্জনের জন্য যে হিংসার আশ্রয় নিই, তা প্রবৃত্তির তাড়নার বশবর্তী হয়ে নয় কি? যদি সেটাই হয়, তা হলে আমাদের অন্তরের স্বাধীনতা তো খর্ব হয় সেখানেই। কেন আমরা এই প্রবৃত্তির তাড়না থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যত্নবান হই না? আসলে সাফল্য বা জয়ের অহঙ্কারই আমাদের বিপথে চালিত করে। স্বাধীনতা বলে যতই চেঁচাই না কেন, সত্যিকারের স্বাধীনতার স্বাদ অনুধাবন করার শক্তি আমরা একেবারে হারিয়ে ফেলেছি।
নারায়ণ সাহা, কলকাতা-৮৪
মানবিকতা
অনুরাধা রায়ের ‘স্বাধীনতার দিনরাত্রি’ প্রবন্ধটি স্বাধীনতা-দিবস উদ্যাপনের পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তার উদ্রেককারী কিছু বক্তব্যের সমাহার রূপেই আমার কাছে প্রতিভাত হয়েছে। বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে ব্যক্তি-স্বাধীনতা, বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও নারী-স্বাধীনতার দুর্দশাগ্রস্ততা এবং স্বাধীনতার প্রকারভেদ সম্পর্কে আলোকপাত পাঠককে ঋদ্ধ করে।
‘নিজের ভাল লাগা ভালবাসা নিয়ে নিজের আনন্দে বাঁচার স্বাধীনতা’, যাকে ফরাসিতে বলে ‘আমু দ্য সোয়া’, তার উদাহরণ প্রসঙ্গে প্রবন্ধকার উল্লেখ করেছেন, “...এ বারের অলিম্পিক্স দেখিয়ে দিল ‘আমু দ্য সোয়া’র দু’টি চমকপ্রদ দৃষ্টান্ত।” তার একটি হিসাবে তিনি উল্লেখ করেছেন জ্যাভলিনে রুপোজয়ী নীরজ চোপড়ার মায়ের সেই স্মরণীয় উক্তি— তিনি তো আরশাদ নাদিমেরও (সোনাজয়ী) মা। আর অন্য উদাহরণটি স্পেনের দৌড়বাজ আইভান ফার্নান্ডেজ় আনায়া-র সেই অবিস্মরণীয় ঔদার্য। ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয়েছে উপরোক্ত দুটো ঘটনাতে যতটা না ‘নিজের আনন্দে বাঁচার স্বাধীনতা’র মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে, তার চেয়ে ঢের বেশি ফুটে উঠেছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ‘মানসিক উদারতার বিষয়টি’-ই।
তবে আইভান ফার্নান্ডেজ় আনায়া-র উপরোক্ত ঘটনাটি এ বারের প্যারিস অলিম্পিক্সে ঘটেনি। এটি ঘটেছিল ২০১২ সালের ২ ডিসেম্বর স্পেনের নাভারে প্রদেশের বুরলাডা অঞ্চলে অনুষ্ঠিত একটা ‘ক্রস-কান্ট্রি রেস’-এর সময়। ফার্নান্ডেজ় কখনও অলিম্পিক্সে অংশগ্রহণ করেননি আর মুতাই ২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিক্সে ৩০০০ মিটার ‘স্টেপলচেজ়’-এ ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেছিলেন।
গৌতম নারায়ণ দেব, কলকাতা-৭৪
দলিতের প্রাণ
আমেরিকায় পুলিশ-কর্মীদের বর্ণবিদ্বেষের জেরে কৃষ্ণাঙ্গদের হত্যার প্রতিবাদে তীব্র গর্জন উঠেছে। কিন্তু আমাদের দেশে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও প্রতিনিয়ত সাফাই-কর্মীদের প্রাণ দিতে হচ্ছে বিষাক্ত ম্যানহোল পরিষ্কার করতে গিয়ে (‘অমৃতকালের বিষ’, ৭-৮)। এর উপর কোনও কোনও রাজ্যে নির্বিচারে আজও চলছে মনুষ্যবিষ্ঠা বয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো মর্মান্তিক ঘটনা। ভারত দেশটি যে প্রকৃতই স্বাধীন, সে কথার উদ্যাপন কেবলমাত্র ঢাকঢোল বাজিয়ে, নেতাদের ভাষণ আর পতাকা উড়িয়েই প্রমাণ করা হবে কি? যাঁরা দলিত, অবদমিত, তাঁদের দুর্দশা দূর হলে তবেই প্রকৃত অর্থে দেশটাকে স্বাধীন বলা চলবে।
সঞ্জিত ঘটক, নরেন্দ্রপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy