দীপাঞ্জন চক্রবর্তীর ‘দেশপ্রেমের দিনমজুর’ (২২-৬) একটি প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধ। ভাড়াটে সৈনিকের ব্যাপারটা বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে ইউরোপে চালু ছিল। আইরিশ নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ-এর নাটক আর্মস অ্যান্ড দ্য ম্যান-এ ভাড়াটে সৈনিকের কথা পাওয়া যায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে এ ধরনের সেনা নিয়োগ চালু ছিল। প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে চিন ও পাকিস্তান ছাড়া অন্য কোনও দেশের সঙ্গে সে রকম সীমান্ত বিরোধ নেই আমাদের। এখনই কারও সঙ্গে যুদ্ধ লাগার সম্ভাবনাও নেই বলে মনে হয়। ফলে ভাড়াটে সৈনিকের প্রয়োজন কেন হল, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। দু’বছর বাহিনীতে নিয়োগ না হওয়ায় যে শূন্যপদ তৈরি হয়, তা অস্থায়ী সেনা নিয়োগের মাধ্যমে পূর্ণ করতে হবে কেন? যাঁদের চাকরিতে স্থায়িত্ব নেই, নেই পেনশন-গ্র্যাচুইটিও, তাঁরা কী মনোভাব নিয়ে দেশরক্ষার কাজে ঝাঁপাবেন? এখনকার যুদ্ধ যেমন শারীরিক দক্ষতা দাবি করে, তেমনই প্রয়োজন হয় মস্তিষ্কের তীক্ষ্ণতা, দীর্ঘ সময়ের প্রশিক্ষণেও যা সব সময় রপ্ত করা যায় না। স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণে তা কি সম্ভব? চার বছরের চুক্তিতে ‘অগ্নিবীর’রা কতটা দেশরক্ষার কাজে দক্ষ হয়ে উঠবেন? এই প্রকল্প কি সরকারের বেকারত্ব দূর করার ক্ষেত্রে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা নয়? এই জন্যই হয়তো প্রতিরক্ষা খাতে সুপরিকল্পিত ভাবে বাজেট বরাদ্দ কমানো হয়েছে। চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে ওঁরা কোথায় যাবেন, স্পষ্ট নয়। এত কাজ আমাদের দেশে আছে কি?
পাক-অধিকৃত কাশ্মীর ভারত দখল করে নেবে— এই প্রাক্-ভোট গুজব কত জন মানুষ বিশ্বাস করবেন? যাঁরা ন্যূনতম খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা বোঝেন পাকিস্তান আয়তনে ছোট হলেও পরমাণু শক্তিধর। পাক-অধিকৃত কাশ্মীর দখলে রাখা সে দেশের বিদেশনীতির অঙ্গ। ফলে ভারত বিষয়টি যতটা সহজে করবে বলে মনে করছে, ব্যাপারটা ততটা সহজ নয়। অন্য দেশও তখন পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াবে, সেটা ভুললে চলবে না।
রঘুনাথ প্রামাণিক, কালীনগর, হাওড়া
ঠিকা কর্মী প্রকল্প
দীপাঞ্জন চক্রবর্তীর প্রবন্ধ প্রসঙ্গে এই চিঠি। নব্বইয়ের দশকের আগে পর্যন্ত ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ কেবলমাত্র উৎপাদন শিল্পে অস্থায়ী কাজের জন্য সীমাবদ্ধ ছিল। উদারীকরণের হাত ধরে এক সময় ঠিকা শ্রম ধীরে ধীরে সরকারি-বেসরকারি, সংগঠিত-অসংগঠিত— সব ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ল। শিল্প ছাড়াও স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুলিশ-প্রশাসন ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে আজ ঠিকা শ্রমের রমরমা। স্থায়ী চাকরির আয়তন সঙ্কুচিত হওয়ার সুযোগটা শুধুমাত্র বেসরকারি সংস্থাগুলোই নয়, সরকারি অফিস ও প্রতিষ্ঠানগুলোও লুফে নিয়েছে। এই আবহে প্রতিরক্ষা বাহিনীতে ঠিকা শ্রমের অনুপ্রবেশ ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। ‘প্যারা টিচার’, ‘সিভিক ভলান্টিয়ার’ ইত্যাদি গালভরা নামের ঠিকা শ্রমিকদের সঙ্গে আমরা এ বার দেখব আরও জমকালো ‘অগ্নিবীর’ নামের ঠিকা সৈনিকদের। সরকারের দাবি, এই ব্যবস্থায় বাহিনীতে তারুণ্যের সঞ্চার হবে। অনেক বিশেষজ্ঞ আর প্রাক্তন সমর নায়করা এর বিরোধিতা করলেও সরকার তার সিদ্ধান্তে অটল। সতেরো থেকে কুড়ি বছরের কিশোর-যুবকদের চার বছর অন্তর বসিয়ে আবার নতুন এক দলকে নিয়োগ করার ফলে বাহিনীর গড় আয়ু কমলেও প্রভাবিত হবে বাহিনীর পেশাদারিত্ব। দু’টি পরমাণু শক্তিধর দেশের তপ্ত নিঃশ্বাস সহ্য করা ভারতের কাছে এর ফল সুদূরপ্রসারী হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। ‘তারুণ্যের সঞ্চার’, ‘মোবিলিটি’— এ সব অসার শব্দ। আসলে সরকারের উদ্দেশ্য হল, সৈনিকদের পেনশন, গ্র্যাচুইটি, সাবসিডাইজ়ড ক্যান্টিন ইত্যাদির পিছনে বিপুল খরচের উপর রাশ টানা। প্রবল বিক্ষোভের আবহে সরকার প্রায় প্রতি দিন সম্ভাব্য ঠিকা সৈনিকদের সুযোগ সুবিধার উপর একটু একটু করে মধু ঢেলে যাচ্ছেন। পরিকল্পনার উপযোগিতা বোঝাতে মাঠে নামিয়েছেন দেশের তিনটি বাহিনীর বর্তমান প্রধানদের।
তবে এই বিক্ষোভ-অসন্তোষ ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে যাবে। কারণ, এর পুরো ভাগে আছেন সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণরা। কয়েক প্রজন্ম ধরে এঁদের পরিবার বাহিনীর নিচু তলার সৈনিকের জোগান দিয়ে গেলেও পঞ্জাব-হরিয়ানার আন্দোলনকারী কৃষকদের মতো আর্থিক সঙ্গতি এঁদের নেই। অন্য দিকে, প্রতিরক্ষা বাহিনীতে ঠিকা শ্রমের নিয়োগ বাস্তবায়িত হলে পরবর্তী পর্যায়ে এই মডেলের প্রয়োগ হবে বিএসএফ, সিআরপি ইত্যাদি আধা-সামরিক বাহিনীর নিচুতলার সৈনিক নিয়োগের ক্ষেত্রেও। সরকার তখন এই ঠিকা জওয়ানদের গালভরা কী নাম দেবেন?
বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায়, কুলটি, পশ্চিম বর্ধমান
ভবিষ্যৎ অন্ধকার
দীপাঞ্জন চক্রবর্তীর লেখাটি সময়োপযোগী এবং সঠিক। ১৯৭৯ সালে আমি ভারতীয় বায়ুসেনায় গ্রাউন্ড ট্রেনিং ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে যোগ দিই। আমাদের এই ট্রেডের কাজ ছিল নতুন নিযুক্ত হওয়া বায়ুসৈনিকদের ছ’মাসের বেসিক ট্রেনিং দেওয়া। এর মধ্যে ড্রিল, পিটি, অস্ত্রের প্রশিক্ষণ, খেলাধুলা এবং জঙ্গল ক্যাম্প, আদবকায়দাও ছিল। তার পর ছ’মাস বাদে শুরু হত ট্রেড ট্রেনিং। সেটাও ছ’মাসের কোর্স।
প্রশ্ন হল, ছ’মাসের ট্রেনিং কি এক জন সঠিক মাপের সৈনিক তৈরি করতে যথেষ্ট? যেখানে মানসিক ও শারীরিক সক্ষমতা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়, অনুশাসন যেখানে সর্বোচ্চ ও প্রধান গুণ, সেখানে এমন পদক্ষেপে সেই সব গুণ ধ্বংস না হয়ে যায়। যদিও বর্তমান শাসক দল বোধ হয় তা-ই চাইছে।
বীরজিৎ ভট্টাচার্য, কলকাতা-৪০
দেশেরই ক্ষতি
‘অগ্নিপথে সঙ্ঘ-স্বার্থের সিদ্ধি’ (২৪-৬) শীর্ষক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের প্রবন্ধ সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ। সেই প্রসঙ্গে কিছু বলার জন্য এই চিঠি। কাজ ও কাজের দায়িত্ব এক রকম। শিক্ষাগত যোগ্যতা ও বয়স এক রকম। কিন্তু পদের নাম আলাদা। স্থায়িত্বকাল আলাদা। বেতন আলাদা। অবসরের সুযোগ-সুবিধা আলাদা। পদের সম্মান আলাদা। যে কোনও প্রতিষ্ঠানে এই রকম দুই ধরনের কর্মী এক সঙ্গে কাজ করলে দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মীরা সব সময় হীনম্মন্যতায় ভোগেন। এই বৈষম্য কর্মীদের মধ্যে একটা বিভাজন সৃষ্টি করে এবং দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মীদের মনে যন্ত্রণা ও কষ্ট প্রতিনিয়ত কাজ করে। ফলে, প্রতিষ্ঠানের কর্মসংস্কৃতি নষ্ট হয় এবং সুনাম কমতে থাকে।
দেশের প্রধানমন্ত্রী তিন সেনাপ্রধানকে পাশে নিয়ে যে ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্পের ঘোষণা করলেন, সেটা নিয়ে দেশব্যাপী যুব আন্দোলন, অবরোধের মূল কারণ এই ‘বৈষম্য’। আমাদের সেনারা দেশরক্ষার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন এই কথা ভেবে যে, তাঁদের অবর্তমানেও তাঁদের পরিবার সব দিক থেকে সুরক্ষিত থাকবে। অগ্নিবীরদের ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য নয়। সেনাবাহিনীতে পারস্পরিক বন্ধুত্ব, বিশ্বাস, ভালবাসা, সহানুভূতি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর উপর ভিত্তি করে ওঁদের প্রতি দিনের লড়াই। এ ক্ষেত্রে সেটাও কার্যকর হবে না। কারণ সেনাবাহিনীর ত্যাগ, তিতিক্ষা, কর্মনিষ্ঠা, সর্বোপরি গভীর দেশপ্রেম অগ্নিবীরদের মধ্যে না থাকার সম্ভাবনা বেশি। তাঁরা ভাববেন, এই জায়গায় আমরা তো মাত্র ক’দিনের অতিথি। সময় শেষ হলে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। তা ছাড়া কোনও অগ্নিবীর মারা গেলে তাঁর পরিবারটি ভেসে যাবে। অভিজ্ঞতার ঝুলিতে সামান্য সঞ্চয়ের আগেই চাকরি জীবন শেষ। চার বছরের চাকরি শেষে এক-চতুর্থাংশ সেনাবাহিনীতে, বাকি কিছু জন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাবেন। যাঁদের কোথাও কাজ জুটবে না, তাঁদের পরিবারকে রক্ষার তাগিদে শাসক দলের ধ্বজা ধরা ছাড়া উপায়ান্তর থাকবে না। এই ভাবে গড়ে উঠবে শাসক দলের সশস্ত্র রক্ষী-বাহিনী। দেশের সুরক্ষার প্রশ্নে চিরাচরিত নিয়মে পরিবর্তন করে সেনাবাহিনীতে এই ধরনের সাময়িক সময়ের নিয়োগে দেশের চরম ক্ষতির সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
গৌতম পতি, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy