সুকান্ত চৌধুরীর ‘এ আমার এ তোমার গ্লানি’ (২১-৬) শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে আমার এই চিঠি। শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির বিষয়টি যোগ হয়ে এক লজ্জাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অন্যান্য রাজ্য আগে দুর্নীতির ক্ষেত্রে যেখানে মধ্যপ্রদেশের ‘ব্যপম’ কেলেঙ্কারির কথা বলত, এখন সেখানে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে। সে দিন টিভির একটি বিতর্কে শুনলাম, শাসক দলের এক প্রতিনিধি বলছেন, এ সবই বিরোধী দলগুলোর চক্রান্ত। শাসক দলের নেতারা এ সব পাত্তা দেন না, কারণ ভোটে তাঁরাই আবার জিতবেন। তার মানে ভোটে জেতাটাই আসল লক্ষ্য, দুর্নীতি নিরসনের কোনও মূল্য নেই। শাসক দলের সবাই যে দোষী, সে কথা যেমন ঠিক নয়, তেমনই এই সব অভিযোগই বিরোধী দলগুলোর চক্রান্ত, এটাও ঠিক নয়। আর একটা কথা, আদালতকে আদালতের মতো চলতে দিতে হবে। দেখা যাচ্ছে, কথায় কথায় শাসক দল ডিভিশন বেঞ্চে চলে যাচ্ছে। এতে অপরাধীদের সাজা বিলম্বিত হচ্ছে।
সুকান্তবাবু এক জায়গায় লিখেছেন, “২০১৬, ২০১৭, এমনকি ২০১৪ সালে যে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, এখনও তার পাট চোকেনি। সেই ব্যর্থতার দায় কর্তৃপক্ষকে বইতেই হবে; কোনও ব্যাখ্যাই যথেষ্ট নয়।” একেবারে সঠিক কথা। কিন্তু শাসক দল নানা ধরনের ‘ব্যাখ্যা’ দিয়েই আড়ালে থাকতে চাইছে। গত দশ বছরে যদি ১ লক্ষ চাকরি হয়েই থাকে, তবে তার মধ্যে শুধুমাত্র ‘৫০-১০০টা ভুল’ নয়, বিস্তর ভুল হয়েছে। এবং সেই ভুলগুলোর সঙ্গে যে দুর্নীতির যোগ আছে, তার প্রমাণ এখন জনপরিসরে চলে এসেছে। এই ব্যাপারে যে সব চাপানউতোর হচ্ছে শাসক ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে, তাতে শাসক দল নিজের যুক্তিতেই ঘায়েল হয়ে যাচ্ছে। এর বিশদ ব্যাখ্যার আর প্রয়োজন নেই। রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থাকে বাঁচাতে হবে, শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াকে সঠিক পদ্ধতিতে চালু করতে হবে। না হলে পশ্চিমবঙ্গ একটি অচল রাজ্যে পরিণত হবে।
অশোক বসু, বারুইপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
শিক্ষায় ঘাটতি
সুকান্ত চৌধুরী তাঁর প্রবন্ধটিতে রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার হাল পরিষ্কার তুলে ধরেছেন। সত্যিই, পশ্চিমবঙ্গবাসী হিসেবে আমাদের লজ্জার শেষ নেই। রাজ্য সরকারের সঙ্গে প্রতিনিয়ত শিক্ষক সমাজের হবু প্রতিনিধিদের সংঘর্ষ সরকারের উৎকট অহং-এর প্রকাশ। কিন্তু নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যে গলদ আছে, তার দায় কর্তৃপক্ষের উপরই বর্তায়। নিয়োগে অস্বচ্ছতার উদাহরণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এটা অত্যন্ত মর্মান্তিক যে, নিয়োগে অব্যবস্থার জন্য হাজার হাজার যুবক-যুবতী চাকরি থেকে বঞ্চিত। তার থেকেও দুঃখের বিষয় এই যে, পরবর্তী প্রজন্ম উপযুক্ত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। স্কুলগুলিতে পূর্ণ সময়ের শিক্ষকের অভাব দেখা যাচ্ছে। কোভিড অতিমারি এমনিতেই শিক্ষায় ভয়াবহ ঘাটতির সৃষ্টি করেছে। তার সঙ্গে গরমের দোহাই দিয়ে স্কুল বন্ধ থেকেছে দীর্ঘ দিন। ফলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ঘাটতি উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। যে সময়ে বেশি সংখ্যক শিক্ষকের দরকার ছিল, এবং ছাত্রছাত্রীদের দরকার ছিল অনেক বেশি যত্ন, সেখানে নতুন শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে না। প্রাথমিক স্তরে বাংলার শিশুদের অক্ষর চেনা ও সংখ্যা গোনার মতো মৌলিক ক্ষমতায় অবনতির যে চিত্র লেখক তুলে ধরেছেন, তা অত্যন্ত মর্মান্তিক। এতে বোঝা যায় যে, আমাদের রাজ্যে বনিয়াদি শিক্ষার অবস্থা কতটা শোচনীয়। স্কুলশিক্ষার হাল ফেরাতে অবিলম্বে চাই সরকারি উদ্যোগ। না হলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমরা অপরাধী হয়ে থেকে যাব।
সুমন চক্রবর্তী, কলকাতা-৬৫
বিপর্যয়ের ইঙ্গিত
‘গুরুত্বহীন’ সম্পাদকীয় (১৫-৬) এবং ‘এ আমার এ তোমার গ্লানি’ প্রবন্ধটির জন্য ধন্যবাদ। শিক্ষাব্যবস্থার এই পচন কয়েক দশকের অবহেলার ফল। শুধুমাত্র বর্তমান সরকারের উপর এর পুরো দায় চাপালে অন্যায় হবে। শিক্ষার প্রসারের জন্য তৎকালীন শিক্ষাবিদরা চটজলদি উপায় হিসেবে ইংরেজিকে গুরুত্বহীন করে দেওয়া এবং পাশ-ফেল তুলে দেওয়ার যে বীজ বপন করেছিলেন, আজ সেই গাছই মহীরুহ হয়ে অধিক ফলনশীল উৎপাদন শুরু করেছে।
স্বাধীনতার পরে দেশ যখন খাদ্য, বস্ত্র ও অন্যান্য মৌলিক চাহিদার সঙ্কটে নিমজ্জিত, তখনও তৎকালীন নেতৃত্ব শিক্ষার মানের সঙ্গে কোনও আপস করেনি। ফলে, হতদরিদ্র পরিবার থেকেও শুধুমাত্র মেধাকে সম্বল করে বহু কৃতী ছাত্র দেশে-বিদেশে তাদের বিজয় নিশান ওড়াতে পেরেছে। এখন সেই পথ বন্ধ।
শিক্ষার পুরোপুরি বেসরকারিকরণ ভাল কথা নয়। কিন্তু এই দ্বৈত শিক্ষাব্যবস্থা ততোধিক খারাপ। এখন সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে দরিদ্রদের জন্য সংরক্ষিত করে, তাদের কার্যত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এটা দুঃখজনক যে, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণের জন্য যতটা চিন্তিত, শিক্ষার বেসরকারিকরণ নিয়ে ততটা নয়। আর যাঁরা এই অন্যায় শিক্ষাব্যবস্থার শিকার, তাঁরা যেন বিভিন্ন জনকল্যাণ প্রকল্প নিয়ে সুখে আছেন। তাঁদের সন্তানদের কাছ থেকে শিক্ষা যে বস্তুত কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, তাঁরা কি তা বুঝতেই পারছেন না? শিক্ষানীতি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা সাধারণ নাগরিকের কাজ নয়, তার জন্য শিক্ষা জগতের বিশেষজ্ঞরা আছেন। তবু ভুল নীতির মূল্য নিম্নবিত্ত জনগণকেই চোকাতে হয়।
বহু দশকের রাজনীতি-লাঞ্ছিত এই সরকারি শিক্ষার সামাজিক উপযোগিতা কমতে কমতে প্রায় শূন্যে ঠেকেছে। যত দিন সরকারি শিক্ষা প্রতিযোগিতায় রাখতে পেরেছে বেসরকারি শিক্ষাকে, তত দিন বেসরকারি শিক্ষা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল। কিন্তু এখন সরকারি শিক্ষা প্রায় মূল্যহীন হয়ে যাওয়ার ফলে বেসরকারি শিক্ষা ক্ষেত্রে একচেটিয়া ‘বাজার’ সৃষ্টি হয়েছে, এবং তার ফলে বাজার অর্থনীতির নিয়মে ‘ক্রেতা’ ঠকানোর নানা পথ তৈরি হয়েছে। সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার এই অধঃপতন আগামী দিনে বেসরকারি শিক্ষার গ্রাহকদেরও বিপদের মুখে ঠেলে দেবে। সরকারি শিক্ষার এই পতন আমাদের সকলের বিপদ— এই বোধ সবার মধ্যে না এলে এক শিক্ষা-বিপর্যয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
অনিন্দ্য কুমার পাল, কলকাতা-৯৬
পরীক্ষার ভয়
রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ঝুড়িভরা অর্থহীন নম্বর’ (১৮-৬) প্রবন্ধটি বাস্তব। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন পরীক্ষা দ্বারা যে গণটোকাটুকির ব্যবস্থা হয়েছিল, সেখান থেকে বার হতে ভয় পাচ্ছে সুবিধাভোগীরা। দীর্ঘ দিন শ্রেণিকক্ষে ক্লাস না হওয়া, হলে বসে পরীক্ষা না হওয়ার ফলে যে জড়তা তৈরি হয়েছে, তা দূর করার দায়িত্ব কার? পরীক্ষাভীতির জন্য ছাত্রছাত্রীরা সহজ পথের পথিক হতেই পারে। দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কথা ভাবার মতো ছাত্রছাত্রী মুষ্টিমেয়। সরকার কি অভিভাবকের ভূমিকা গ্রহণ করে সর্বত্র অফলাইন পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে পারত না?
আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, পড়ুয়াদের এই অন্যায় দাবিকে সমর্থন করল কিছু ছাত্র সংগঠন। সরকার পরীক্ষা পদ্ধতি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর ছেড়ে দিতেই অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অনৈতিক চাপের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হল। নবনির্মিত কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রআন্দোলনের আগেই ঘোষণা করল পরীক্ষা অনলাইনে হবে।
অনলাইন পরীক্ষায় নম্বরের পাহাড় তৈরি হয়। ফলে, ছাত্র বিক্ষোভ হয় না, পরীক্ষা চালানোর খরচ কমে যায়, ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি-কেমিক্যাল লাগে না, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর অভাব জনসমক্ষে আসে না। ফলে, বিশ্ববিদ্যালয় নিঃশব্দে পরিণত হয় মার্কশিট ছাপানোর যন্ত্রে। সরকার যদি পরীক্ষার নম্বরকে অনুদানের তালিকায় রেখে দেয়, তবে এই ধরনের ঘটনা চলতেই থাকবে।
রাজেশ মুখোপাধ্যায়, বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy