বেশির ভাগ ব্যাপারেই পশ্চিমবঙ্গ খুব ভাল বা খুব খারাপ করে না, মাঝামাঝি থাকাই তার ধর্ম। পুজোর ভিড়েও দেখা গেল, সে স্বধর্মে স্থিত। মণ্ডপে ও রাস্তাঘাটে জনসমাগম এ-বার তুলনায় অনেকটাই কম ছিল। আবার, যাঁদের দমিয়ে রাখা গেল না তাঁদের সংখ্যাও কম বলা যাবে না। অনুমান করা চলে, তাঁদের মধ্যেও নানা রকমফের আছে। সম্পূর্ণ বেপরোয়া থেকে পুরোপুরি নির্বোধ, সব রকম মানসিকতার নমুনাই পাওয়া গেছে। তবে অনেকেই বোধ করি মাঝামাঝি অবস্থানে থেকে, অর্থাৎ সাত-পাঁচ না ভেবে, কিঞ্চিৎ ভয়ে ভয়েই বেরিয়ে পড়েছেন। তাঁদের মনের কথা: বাড়িতে বসে হাঁপিয়ে উঠেছি, এটুকুতে কিছু হবে না।
পরিস্থিতি যে এমনটাই দাঁড়াবে, সে-কথা অবশ্য মোটের ওপর জানা ছিল। শুক্লা তৃতীয়ায় হাইকোর্টের নির্দেশ শুনে সমস্ত বঙ্গবাসী যে যার করতলে মাথা রেখে জানালার কাছে বসে পড়বেন, তেমন ভরসা বোধ করি মহামান্য বিচারপতিদেরও ছিল না। তাঁরা শেষ বেলায় যতটা সম্ভব, চেষ্টা করেছেন। এবং সে-চেষ্টা ব্যর্থ হয়নি: মণ্ডপে ঢোকা যাবে না— এই বার্তা অবশ্যই বহু সম্ভাব্য প্যান্ডেল-পর্যটককে নিরস্ত করেছে। সেটা কেবল প্রতিমা দেখতে না-পাওয়ার হতাশায় নয়, আদালতের সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা এবং তা নিয়ে নানা সওয়াল-জবাব ও আবেদন-নিবেদন উৎসবের পরিবেশটাকেই অনেকখানি পাল্টে দিয়ে বহু নাগরিকের উৎসাহে জল ঢেলে দিয়েছিল। তা না হলে আজ দুশ্চিন্তার মাত্রা আরও অনেক বেশি হত।
কিন্তু তার পাশাপাশি অস্বীকার করা যায় না বহু নাগরিকের কাণ্ডজ্ঞান, দায়িত্ববোধ আর সংযমের কথাও। নিজের নিজের বিবেচনাবোধ দিয়েই তাঁরা পরিস্থিতি বিচার করেছেন এবং আপন গতিবিধি যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রিত রেখেছেন। সেই অ-গতি অনেককেই বিমর্ষ করেছে, কিন্তু তাঁরা বিষাদ দূর করার তাগিদে নির্ভাবনায় জনস্রোতে ঝাঁপ দিয়ে পড়েননি। এই নিবৃত্তি সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর আত্মসংযম নয়, তা হওয়ার কথাও নয়। দ্বিতীয়ার দিনে এক তরুণীকে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে বলতে শুনেছিলাম, ‘ঠাকুর দেখতে বেরোব না এ বার... খারাপ তো লাগবেই, কিন্তু কী আর করা যাবে, একটা বছরই তো...’। এই স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি বহু মানুষকে ছেড়ে যায়নি। তাঁরা পুজোর ভিড়ে অ-দৃশ্য ছিলেন। নিজেকে অ-দৃশ্য রাখাই সংযমের লক্ষণ। যাঁদের অসংযম দৃশ্যমান হল, আদালতের প্রথম ধাক্কা সামলে যাঁদের সমাজ-বিরোধী স্পর্ধা মহাষ্টমী থেকে উত্তরোত্তর প্রকট হয়ে উঠল, তাঁদের অপরাধে গোটা সমাজকে দায়ী করলে কেবল অবিচার হবে না, সমাজের অন্তর্নিহিত শুভবুদ্ধিকে কাজে লাগানোর সম্ভাবনাটাকেই অগ্রাহ্য করা হবে। সেই অবিচার কেবল দুঃখের নয়, বিপজ্জনকও বটে।
বিপজ্জনক বিশেষত এই কারণে যে, সমাজের নেতৃত্ব যাঁদের হাতে তাঁরা অনেক সময়েই বহু মানুষের সংযত শুভবুদ্ধিকে তার প্রাপ্য মূল্য না দিয়ে কিছু লোকের অসংযমী আবেগকে মাথায় তোলেন, এবং আপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাকে ব্যবহার করেন। এ-প্রবণতা এখন দুনিয়া জুড়ে। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সবচেয়ে কদর্য নিদর্শন হতে পারেন, কিন্তু রোগটা কেবল তাঁর মহান আমেরিকায় সীমিত নেই, তার আন্তর্জাতিক বিস্তার অতিমারির আকার নিয়েছে। অসুখের চেহারা সব জায়গায় এক রকম নয়, কিন্তু সর্বত্রই এ-ব্যাধির সাধারণ চরিত্র হল সংযম, শুভবুদ্ধি এবং বিচারবোধের ঘাটতিকে কাজে লাগিয়ে জনপ্রিয় থাকার তাড়না। ওই ঘাটতি আকাশ থেকে পড়েনি— কী ভাবে ‘উদার’ গণতন্ত্রের প্রচলিত মডেলগুলি ক্ষমতার বশীভূত হয়ে বহু মানুষকে দীর্ঘ দিন ধরে ঠকিয়ে এসেছে এবং এক সময় তাঁরা সেই মডেলে আস্থা হারিয়ে ট্রাম্পদের উদ্বাহু নাচে যোগ দিয়েছেন, সেই পপুলিস্ট রাজনীতির অভিযান নিয়ে দুনিয়া জুড়ে তত্ত্বচর্চা ও তর্কবিতর্কের শেষ নেই।
এই জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতিতে নেতানেত্রীদের স্বাভাবিক ঝোঁক থাকে জন-আবেগের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেওয়ার। এটা নিজের নেতৃত্ব সম্পূর্ণ বিসর্জন দেওয়ার দুর্বলতা নয়, বরং বহু লোকের আবেগ নিয়ে একটা খেলা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপার। খেলাটা সমস্যাসঙ্কুল। এবং সমস্যার মোকাবিলা করতে গিয়ে নেতৃত্বের প্রাথমিক শর্তটিকেই জলাঞ্জলি দেওয়ার আশঙ্কা থাকে। নেতৃ শব্দটির মূলে আছে নী ধাতু, যার অর্থ নিয়ে যাওয়া। (নায়ক/নায়িকাও ওই ধাতুতেই গড়া।) কিন্তু জন-আবেগের ঝড়তুফানে তরণী ভাসিয়ে রাখার তাড়নায় কান্ডারিরা সেটিকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আত্মবিশ্বাস, এমনকি আকাঙ্ক্ষাও হারিয়ে ফেলতে পারেন। তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে, অবাক হওয়ার কারণ নেই।
আদালতের রায়ের পরে কলকাতার বিভিন্ন ‘বড় পুজো’র কর্তাব্যক্তিদের প্রতিক্রিয়াকে তাই বিস্ময়কর বলা চলে না। তাঁরা অনেকেই রাজ্যের শাসক দলের নেতা, এমনকি মন্ত্রীও। এঁরা প্রায় সমস্বরে জানিয়েছেন: কাউকে তো পুজোয় বেরোতে বারণ করতে পারি না! অর্থাৎ, তাঁদের কাছে সবার উপরে আবেগ সত্য। একাধারে মন্ত্রী এবং পুজো-কর্তার ভূমিকা পালন করা সঙ্গত কি না, সে-প্রশ্ন অন্যত্র। কিন্তু কেবল উদ্যোক্তা নয়, এ-বারের শারদোৎসবে সামগ্রিক ভাবে প্রশাসনের আচরণেই দেখা গেল ওই জন-আবেগের সঙ্গে বিপজ্জনক টানাপড়েন। শাসকরা হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন, এমন কথা বললে তাঁদের প্রতি অবিচার হবে, বরং প্রথম থেকেই পুজোর আয়োজন নিয়ে তাঁরা নানা ভাবে জড়িত থেকেছেন, নানা নিয়ন্ত্রণী নির্দেশ দিয়েছেন, আবেদন-নিবেদন থেকে ধমকধামক সবই চালিয়ে গেছেন। কিন্তু শুরুতেই তাঁরা নিঃশর্ত ভাবে মেনে নিয়েছিলেন আবেগের বিধান: পুজোয় তো কাউকে বেরোতে বারণ করতে পারি না! সাধারণ বুদ্ধি প্রশ্ন তুলবে: কেন পারেন না? এটা তো জানাই ছিল যে, পুজোয় বেরোনো মানে জনসমাগমের ছাড়পত্র, সুতরাং সংক্রমণেরও। তা হলে? এমনকি আদালতের নির্দেশের পরেও, বিচারপতিদের বক্তব্যের সুস্পষ্ট ঝোঁকটির সদ্ব্যবহার করে ওঁরা বলতে পারলেন না: এ-বছরটা কেউ বেরোবেন না! বললেও কিছু লোক নির্ঘাত বেরোতেন। কিন্তু ভিড় আরও কমত। উদ্বেগও। অথচ, কেবল পুজোর উদ্যোক্তারা নয়, সাধারণ ভাবে প্রশাসনের চালকরাও ধরি মাছ না ছুঁই পানি নীতিই বহাল রাখলেন। কেন?
উত্তর অজানা নয়। এক দিকে বড় পুজোর বড় অর্থনীতি ও তার সঙ্গে রাজনীতিকদের নিগূঢ় সংযোগ, অন্য দিকে ধর্মের নামে অধর্মের সাধনায় সদাব্যস্ত একটি বিরোধী গোষ্ঠীর লোক-খেপিয়ে-তোলার ভয়— এই দুইয়ের তাড়নায় প্রশাসন শুরু থেকেই যথেষ্ট কঠোর হতে পারেনি। অথচ এ-বারের পরিস্থিতিই সেই তাড়না অস্বীকার করার একটা সুযোগ দিয়েছিল নেতা-মন্ত্রী-সমাজপতিদের। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে জনস্বাস্থ্য তথা জনস্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে যথার্থ নেতৃত্বের ধর্ম পালন করতে চাইলে সর্বজনীন দুর্গোৎসবের আয়োজন নিয়েও আগাগোড়া অন্য ভাবে ভাবতে পারতেন তাঁরা। এমন আয়োজন, যাতে ভিড়ের সম্ভাবনা কমানো যায়, আবার পুজোর অর্থনীতিও ভেঙে না পড়ে। বস্তুত, বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় উদ্যোগে নানা বিকল্প বন্দোবস্ত হয়েছে, পুজো বন্ধ করা হয়নি, কিন্তু পুজোর জন্য সংগৃহীত অর্থের একটা বড় অংশ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে তাঁদের হাতে, যাঁরা অন্য বার এ-সময় নানা ভাবে উপার্জন করেন।
জানি না, ওই সমাজপতিদের মধ্যেই ব্যতিক্রমী কেউ কেউ হয়তো এমন সৎকাজ করেছেন। এই ভাবে কোথায় কত দূর সুরাহা করা যেত, সে-প্রশ্নের কোনও তৈরি-জবাব নেই। কিন্তু বড় আকারে, সুচিন্তিত পরিকল্পনার পথে একটা সত্যিকারের বিকল্প উত্তর খোঁজার ডাক এ-বার এসেছিল। সেই ডাকে সাড়া দিতে জানলে প্রশাসন ও রাজনীতি হয়তো জনসংযোগের একটা অন্য পথেও কিছুটা এগোতে পারত। কথোপকথনের পথ। আবেগের তালে তাল দিয়ে জনপ্রিয়তা বজায় রাখার চেয়ে সে-পথ কঠিনতর, কিন্তু অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য। তার কারণ, বহু সুস্থবুদ্ধির মানুষ সেই পথে সহযাত্রী হতেন, কথোপকথনে যোগ দিতেন, অন্য অনেকের উথলে-ওঠা আবেগও তার ফলে প্রশমিত হত। সুযোগসন্ধানী বিরোধীদের সস্তা রাজনীতিকে প্রতিহত করাও আদৌ অসম্ভব ছিল না।
সম্ভাবনাই সার হল। যাঁদের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়, তাঁরা জন-আবেগের অনুগমনেই তুষ্ট হলেন। জুজুর ভয়ে কাতর না হলে তাঁরা বুঝতেন, জন-আবেগ বস্তুটি অনেকাংশেই অলীক, সমাজের বহুজনই তার শরিক নন। এ-বার পুজোয় তাঁরা ঘরেই ছিলেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy